জোর যার মুল্লুক তার- আইনের তোয়াক্কা করল না অবৈধ দখলদার
জোর যার মুল্লুক তার প্রবাদটি সত্যে প্রমাণিত হলো মঙ্গলবার একটি উচ্ছেদ অভিযানে। আইনের তোয়াক্কা না করে অবৈধ দখলদার জমিটির দখল নিয়েছে। যদিও মঙ্গলবার বরাদ্দ দেয়ার আঠারো বছর পর এক ব্যবসায়ী আতাউর রহমানকে প্লট বুঝিয়ে দিয়েছিল রাজউক।
কিন্তু রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম ও চার প্লাটুন পুলিশের উপস্থিতিতে প্লটের মালিক ব্যবসায়ী আতাউর রহমানকে অবৈধ দখলদারের গু-া বাহিনী ব্যাপক মারপিট করে। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশও আতাউর রহমানকে রক্ষা করতে পারেননি। গুরুতর আহত আতাউর রহমান হাসপাতালে মারাত্মক আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। ডাক্তারের পরামর্শে আতাউর রহমান মঙ্গলবার হাসপাতাল থেকে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অবৈধ দখলদার আবারও জমিটির দখল নিয়ে নেয়। এ ব্যাপারে বনানী থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলা নং ১৭ (১৪-৮-১২)।
বনানী থানার মামলায় বলা হয়েছে, রাজউক কর্তৃক বরাদ্দ লালা সড়াই মৌজায় সিএস দাগ নং ৫৫৭ জমির পরিমাণ ৩৩ শতাংশ। প্লট নং যথাক্রমে ৪৪/এ ৪৮ ও ৬০। সড়ক নং ১৮। এই জমিটি দীর্ঘদিন ধরে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা দখল করে রেখেছেন। তার পোষা ৩০/৩৫ জনের গু-া বাহিনী উচ্ছেদ অভিযান চলার সময় অতর্কিত আক্রমণ চালায়। গু-া বাহিনীর মধ্যে কয়েক জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলামকে সাক্ষী করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সকাল থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। অভিযান দুপুর পর্যন্ত ভালভাবেই চলছিল। হঠাৎ এক পর্যায়ে কিছু লোক অভিযান স্থানে চলে আসে। বিকেল তিনটার দিকে অবৈধ দখলদার সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্নেল শহীদের পক্ষে র্যাবের এক কর্মকর্তা আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। ততক্ষণে উচ্ছেদ অভিযান শেষ হয়ে গেছে। ওই স্থগিতাদেশে বলা হয়েছে, জমিতে কোন পক্ষই কোন স্থাপনা নির্মাণ বা দখলে যেতে পারবে না। পরে আমরা উভয় পক্ষকে জমিতে না যেতে মানা করে আসি। এই ফাঁকেই প্রকৃত মালিক আতাউর রহমানকে ৩০/৩৫ জনের একটি গ্রুপ মারপিট করতে থাকে। আমি পুলিশ নিয়ে দৌড়ে তাঁকে রক্ষা করতে যাই। এ সময় সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এই জমিটির জন্য উচ্চ পর্যায়ের কিছু লোক জড়িত রয়েছে। স্থগিতাদেশ থাকার পরও অবৈধ দখলদার ওই জমিতে বুধবার স্থাপনা নির্মাণ করে যাচ্ছে। পুলিশ পাহারায় তারা এ কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। রাজউক আমার নামে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল। সেই সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে তাদের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। এটা ছিল তাদের পূর্বপরিকল্পনা।
এ ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলাম বলেন, আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পর সেখানে কোন পক্ষই যেতে পারবে না। এখন তাঁরা যে স্থাপনা নির্মাণ করছেন তা আদালত অবমাননা করছেন। এটা তাঁরা করতে পারেন না।
মামলার বাদী আতাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রচ্ছায়া নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানি এই জমিটি গ্রাস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ রাজউক এই জমিটি ১৮ বছর আগে আমাকে বরাদ্দ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এক উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা জড়িত আছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
পুলিশের ডিসি লুৎফুল কবির জনকণ্ঠকে জানান, রাজউক জমিটিতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং জমির মালিককে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রাজউক আমার কাছে পুলিশ চেয়েছিল। আমি পুলিশ দিয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সামনে জমির মালিক আতাউর রহমানকে মারপিট করেছে গু-া বাহিনী। সত্যিই এটা দুঃখজনক। বুধবার ওই জমিতে অবৈধ দখলদার পুলিশ পাহারায় স্থাপনা নির্মাণ করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি দেখছি। স্থগিতাদেশ থাকার পর ওই জমিতে আর কোন পক্ষই কোন কিছু করতে পারবে না।
মঙ্গলবার বনানী ১৮ নং সড়কের ৪৮ নং প্লটে অবৈধভাবে দখল করে রাখা জমি ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলামের নেতৃতে রাজউকের একটি দল বুলডোজার দিয়ে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে। পরে সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং আতাউর রহমানের মালিকানার সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একই সঙ্গে বুলডোজার দিয়ে অবৈধ বস্তি ভাঙ্গা হচ্ছে এবং নতুন সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। এ সময় এক পাশে অবৈধ দখলদারের কিছু ক্যাডারকেও ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। স্থানীয়রা জানান, এক যুবলীগ নেতা অবৈধ দখলদার অবসরপ্রাপ্রপ্ত সেনা কর্মকর্তার পক্ষে বস্তি থেকে ঘর ভাড়া তুলতেন। ওই যুবলীগ নেতার ক্যাডাররাই বস্তি উচ্ছেদের সময় সেখানে অবস্থান নেয়। তবে পুলিশের উপস্থিতির কারণে তাদের তৎপরতা ঘোরাফেরার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে তাদের দফায় দফায় চিৎকার করে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে দেখা যায়।
রাজউকের নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৯৪ সালে ব্যবসায়ী আতাউর রহমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কোটায় গুলশান-বনানী এলাকায় প্লট বরাদ্দ পান। বরাদ্দ দেয়ার সাত বছর পর ২০০১ সালে আতাউর রহমানকে গুলশানের ১২১ নং সড়কে ২২ নং প্লট বুঝিয়ে দেয়া হয়। এই প্লটটি ছিল ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু হত্য মামলার রায় ঘোষণাকারী বিচারক গোলাম রসুলকে বরাদ্দ দেয়া প্লটের সঙ্গে। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০২ সালে গোলাম রসুলকে দেয়া প্লট কেটে লেকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। সে সময় পাশের আতাউর রহামনের প্লটটিও একইভাবে লেকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়। পরে রাজউক বনানী এবং গুলশান এলাকায় আরও দু’বার আতাউর রহমানকে প্লটটি বরাদ্দ দিয়েও দখল বুঝে দিতে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ বনানী লেকের পাড়ে ১৮ নং সড়কের ৪৮ নং প্লটটি বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু আগে থেকেই একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এই প্লট অবৈধভাবে দখল করে সেখানে বস্তি গড়ে তুলে ঘর ভাড়া দেন। মঙ্গলবার সেই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার অবৈধ দখল থেকে ৩৩ শতাংশ জায়গা মুক্ত করে বৈধ বরাদ্দপ্রাপ্ত আতাউর রহমানকে বুঝিয়ে দেয় রাজউক।
প্লট বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ী আতাউর রহমান বলেন, ১৯৯৪ সালে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর বাস্তবে সেই প্লট বরাদ্দ পাওয়ার জন্য ১৮ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। অনেক অনিশ্চয়তা, হয়রানি, ছোটাছুটির পর শেষ পর্যন্ত প্লটের দখল বুঝে পাওয়ায় স্বস্তি অনুভব করছি। কিন্তু বিকেলেই তাঁর এই স্বস্তি ম্লান হয়ে যায়। অবৈধ দখলদারের গু-া বাহিনী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের সামনে আমাকে পিটিয়ে মারাত্মক জখম করে। পরে তারা আবার জমির দখল নিয়ে নেয়।
No comments