ক্ষমতাধর নারী, ইয়াসমিন হত্যার সতেরো বছর এবং বাস্তবতা by মিলু শামস
বিশ্বের ক্ষমতাধর এক শ’ নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে ফোর্বস ম্যাগাজিন। এ তাদের বার্ষিক রুটিন কাজ। বিশ্বে নীতি নির্ধারণীতে প্রভাব, আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, গণমাধ্যমে উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় এনে তালিকা তৈরি হয়। এবার শীর্ষে এসেছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। দ্বিতীয় অবস্থান হিলারি ক্লিন্টনের।
তৃতীয় দিলমা রৌসেফ- ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট। প্রথম দশজনের মধ্যে আরও আছেন যথাক্রমে মেলিন্ডা গেটস, নিউইয়র্ক টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক জিল আব্রামসন, সোনিয়া গান্ধী, মিশেল ওবামা, আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ফ্রান্সের এক সময়ের মন্ত্রী ক্রিস্টিন লাগার্দে, যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রী জ্যানেট নাপোলিতানো এবং ফেসবুকের চীফ অপারেটিং অফিসার শেরিল স্যান্ডবগ।
আমাদের এখানে যেদিন এ তালিকা প্রকাশ হয় সেদিন ছিল বাংলাদেশের ক্ষমতাহীন এক নারী ইয়াসমিন হত্যার সতেরোতম বার্ষিকী। উনিশ শ’ পঁচানব্বই সালের চব্বিশ আগস্ট ঢাকার গৃহপরিচারিকা ইয়াসমিন ফিরছিল গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। তের চৌদ্দ বছরের ইয়াসমিন ঢাকা থেকে সরাসরি দিনাজপুরের বাসে উঠতে চেয়েছিল। না পেরে পঞ্চগড়ের বাসে ওঠে। বাসের লোকজন দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় একটি চায়ের দোকানে তাকে নামিয়ে দিয়ে বাসের গতি মুখ বদলায়। ঘটনাক্রমে এরপর একটি পুলিশ ভ্যান তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ‘নিরাপত্তা হেফাজত’-এ নিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা করে। এ ঘটনায় দিনাজপুরসহ সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল। নারীরা সম্মিলিতভাবে আন্দোলনে নেমেছিলেন। চব্বিশ আগস্টকে তারা ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ ঘোষণা দিয়েছিলেন। সতেরো বছর পর এ ‘দিবস’ স্পষ্টই অনেক ম্লান। নারী আন্দোলনের সেই সম্মিলিত রূপ এখন প্রায় অদৃশ্য। সত্যি বলতে আন্দোলনই কি এখন আছে? সামষ্টিক আন্দোলনের চেয়ে ব্যক্তিগত অর্জনই এখন মনোযোগের কেন্দ্রে। ইয়াসমিন হত্যার সেই বছরে, উনিশ শ’ পঁচানব্বই সালে সারা বিশ্বের পঁয়ত্রিশ হাজার নারী বেইজিং শীর্ষ সম্মেলনে বসেছিলেন। পৃথিবীময় অনেক পরিবর্তনের শুরুর সাক্ষী গত শতকের মধ্য নব্বই নারী আন্দোলনের বাঁক বদলেরও সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বেজিংয়ে নারী উন্নয়নের জন্য যে প্লাটফরম ফর এ্যাকশন ঘোষণা করা হয়েছিল তাই বদলে দিয়েছে পরবর্তী নারী আন্দোলনের রূপ। তখন থেকেই নারীর উন্নয়ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অংশ হিসেবে আইডেনটিটি পেতে থাকে। যাতে ভেঙ্গেছে আন্দোলনের নিজস্বতা। তবে এ শুধু নারী আন্দোলনের বেলায় নয়, যে আদর্শিক রাজনীতিকে ভর করে তা বিকশিত হয়েছিল সেই রাজনৈতিক আন্দোলনও সরবতা হারিয়েছে।
বেজিং প্লাটফরম ফর এ্যাকশনে সেই যে নারী উন্নয়নকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অংশ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তারই ধরাবাহিকতাই হয়ত ফোর্বস এর জরিপে এত উজ্জ্বল নারীরা বেরিয়ে এসেছেন, যদিও বিচ্ছন্ন তারা। সারা পৃথিবীই যেখানে বিচ্ছিন্নতার দ্বীপ সেখানে নারীর অর্জনের প্রশ্নে সামগ্রিকতা আশা করা যায় না। এ বাস্তবতায় দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামোর দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নারীর অবস্থা কেমন? জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন মতে যথেষ্ট ইতিবাচক।
নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন রিপোর্ট এ তথ্য দিয়েছে গত নবেম্বরে। এ সফলতার পেছনে মূল কারণ বেরিয়ে এসেছে, নারী শিক্ষার প্রসার, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে অংশ নেয়া, কর্মোদ্যম ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করার মনোবল ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি অর্জন নারী-পুরুষ বৈষম্য কমাতে। আগের বছরের তুলনায় অগ্রগতি বেড়েছে শতকরা পঁচিশ ভাগ। প্রতিবেদনে সবশেষ তথ্য যুক্ত হয়নি তা হলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ভাল হতো। প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান পিছিয়ে রয়েছে। বলা হয়েছে, নারী-পুরুষ বৈষম্যের ক্ষেত্রে এক শ’ ছেচল্লিশটি জাতিসত্তার মধ্যে সমীক্ষায় ভারতের অবস্থান এক শ' ঊনত্রিশতম। বাংলাদেশের এক শ’ বারোতম এবং পাকিস্তানের এক শ’ ষোলোতম।
দেশে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের শিক্ষার হার বেশি। শতকরা প্রায় নব্বই ভাগ শিশু প্রাইমারী স্কুলে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঊননব্বই দশমিক নয় ভাগ মেয়ে এবং বিরাশি দশমিক নয় ভাগ ছেলে। গড় আয়ুর হিসেবেও বাংলাদেশ এগিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর গড় আয়ু ছেষট্টি বছর। বাংলাদেশে এ হার আটষট্টি দশমিক নয় বছর। শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির সুফল হিসেবে নারীর প্রজনন হার ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে উল্লেযোগ্যভাবে। এসব উপাদান বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন হার বৃদ্ধিতে স্পষ্ট অবদান রাখছে। যার ফলে জাতিসংঘ প্রকাশিত মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে দুই ধাপ উপরে উঠেছে। মানব উন্নয়নে নারীর প্রত্যক্ষ ভূমিকার কারণে জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রেও আগের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচক যার প্রতিফলন ঘটেছে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত জেন্ডার গ্যাপ প্রতিবেদনে, দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর ব্যাপক অবদান, বিশেষত মানব উন্নয়ন সূচক বৃদ্ধি মূল চালিকা শক্তি হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার চার দশক পরও দারিদ্র্যপীড়িত ও অধিকার বঞ্চিত জনগণের সিংহভাগ কেন নারী এ প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গত। এর উত্তর রয়েছে সম্ভবত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির ’৯৭-এর প্রস্তাবনায়। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের শতকরা ছিচল্লিশ ভাগ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশই নারী। চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থান দু’ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় নারী পিছিয়ে আছে। ১৯৯০-৯১ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি একান্ন দশমিক দুই মিলিয়ন। এর মধ্যে পুরুষ একত্রিশ দশমিক এক ও নারী বিশ দশমিক এক মিলিয়ন। অন্যদিকে এখনো পর্যন্ত নারীর অনেক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হয়নি। সংসারের পরিসরে নারীর শ্রম বিনিয়োগের কোন মাপকাঠি এখনো উদ্ভাবন করা যায়নি এবং কৃষি অর্থনীতিতে নারীর অবদানের সঠিক মূল্যায়ন নিরূপিত হয়নি বলেই নারী শ্রমশক্তি হিসেবে অনেক সময় চিহ্নিত হয়নি। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে ১৯৮০ সালে শ্রমবাজারে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার ছিল শতকরা পয়ষট্টি দশমিক পাঁচ ভাগ ২০০৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা মাত্র আটান্ন দশমিক সাত ভাগ, অথচ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মূল অবদান এদেশের পোশাক শিল্পের নারীদের। বিশ্বব্যাংকই বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার ভিত্তিক মজুরি বৈষম্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের তুলনায় কম হলেও অন্যান্য দেশেও এ বৈষম্য রয়েছে। সিডও দলিলে বলা হয়েছে এ বিষয়ে এটি উদ্বেগজনক যে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও নারীর প্রতি ব্যাপক বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে। নারীর প্রতি বৈষম্য, অধিকারের সমতা ও মানব মর্যাদার প্রতি সম্মানের নীতি ঠিকভাবে প্রতিফলিত না হওয়ায় সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো নিজেদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে পুরুষের মতো সমান শর্তে নারীর অংশ নেয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে সমাজ ও পরিবারের সমৃদ্ধি ও বিকাশ ব্যাহত হয় এবং নিজ দেশ ও মানবতার সেবায় নারীর সম্ভাবনার পূর্ণবিকাশ আরও কঠিন করে তোলে। অভাবের পরিস্থিতিতে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং চাকরির সুযোগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়ার সম্ভাবনা নারীর সবচেয়ে কম থাকে। পরিবারের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে নারীর বিরাট অবদান রয়েছে যার পুরো স্বীকৃতি এখনও আসেনি। সিডও সনদের কনসেপ্ট হচ্ছে মাতৃত্বের সামাজিক গুরুত্ব এবং পরিবারে ও সন্তান পরিচর্যায় মা বাবা দু’জনার ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া সন্তান জন্ম দেয়ায় নারীর ভূমিকা বৈষ্যম্যের ভিত্তি হবে না বরং সন্তান পালনে মা বাবার মধ্যে এবং সার্বিকভাবে সমাজের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনাযোগ্য। পুরুষ ও নারীর মধ্যে পূর্ণ সমতা অর্জনের জন্য সমাজে ও পরিবারে পুরুষ ও নারীর প্রচলিত ভূমিকায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
ফোর্বস এর তালিকায় আমাদের দেশের নারীরা স্থান না পেলেও সব ধরনের পেশায় তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি বাড়ছে। তবে বিচ্ছিন্ন অর্জনের পাশাপাশি সামগ্রিকতার দিকে এগিয়ে চলার গতিমুখ ঘোরাতে হবে। কারণ সম্মিলিত অর্জনই সমাজকে স্বাভাবিক গতিতে বিকশিত করে।
No comments