দারিদ্র্যের ফাঁদ ও মুক্তির পথ by এ এম এম শওকত আলী

দারিদ্র্যের ফাঁদের উৎস ও মুক্তির পথ বহুমাত্রিক। এ বিষয়টির চিত্র দারিদ্র্যসংক্রান্ত গবেষণায় পাওয়া যায়। এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশের পরিবারভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা এ কথাই বলেছেন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাস্থ্যরক্ষাসংক্রান্ত ক্ষেত্রটি দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান উৎস।


কোনো পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয়, তাহলে ওই পরিবারের জন্য দারিদ্র্য ঘনীভূত হয়। দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে তারা মুক্ত হয় না। পরিবারভিত্তিক এই তথ্যের ওপর নির্ভর করে রোগমুক্তি : মানুষ কেন দরিদ্র হয় এবং এ থেকে মুক্তির উপায় কী তা বলা হয়েছে। গবেষকের নাম অনিরুদ্ধ কৃষ্ণ। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রটি ছিল ব্যাপক। পশ্চিম কেনিয়া, উগান্ডা, ভারতের কর্ণাটক ও রাজস্থানে কয়েক হাজার পরিবার নিয়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে যে চিত্র এ গবেষণায় পাওয়া যায় তা হলো, পরিবারভিত্তিক দারিদ্র্য বহুলাংশে পরিবর্তনশীল। দারিদ্র্যমুক্তির মাত্রা পরিবারভেদে কমবেশি হয়। বলা হয়, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা দারিদ্র্য নিরসনের রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্যের মাত্রা হ্রাস বা বৃদ্ধির বিষয় বোঝা যায় না। এ জন্য পরিবারভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দারিদ্র্যের প্রকৃত ধারা বোঝা সম্ভব। এ বিষয়ে গবেষকের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমতও পাওয়া যায়। তাঁর মতে, রাষ্ট্র বা এনজিওর সরাসরি সাহায্য গবেষণাভুক্ত কোনো পরিবারের জন্য দারিদ্র্য নিরসন করতে সক্ষম হয়নি। দেখা যায় যে এসব পরিবারের মধ্যে যারা এ ধরনের সাহায্য পেয়েছে, তাদের শতকরা হার ১০-এর বেশি হবে না। এদের মধ্যে নগণ্যসংখ্যক পরিবারই দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে।
বাংলাদেশের চিত্রও একই ধরনের। দারিদ্র্য হ্রাসের মাত্রা অন্য দেশের তুলনায় কমবেশি হতে পারে। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় সংস্থার পাশাপাশি বহুসংখ্যক এনজিও দারিদ্র্য নিরসনের কর্মকাণ্ডে বহু বছর ধরেই কাজ করছে। দারিদ্র্যের মাত্রার হারও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং কিছু ক্ষেত্রে অরাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রকাশ করে থাকে। তবে জনগণ বা অন্য গবেষকরা দারিদ্র্য নিরসনের ফলাফল সম্পর্কে সব সময়ই সন্দেহ প্রকাশ করেন। বলা সম্ভব যে এ ধরনের সন্দেহ থেকে দারিদ্র্য নিরসনের সার্বিক চিত্র অনুধাবন করা যায় না। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনাকারী সরকার এনজিওগুলোর সফলতা সম্পর্কে সন্দিহান। এনজিওগুলোও রাষ্ট্রীয় সফলতা সম্পর্কে একইভাবে সন্দিহান। এ নিয়ে চলে বিরামহীন বিতর্ক। এ নিয়ে নাগরিক সংস্থাসহ গবেষকরা একটি বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। দারিদ্র্য নিরসনের চেষ্টা সফল করতে হলে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এককভাবে দারিদ্র্য নিরসন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ জন্য বহুমুখী উদ্যোগের প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, বহুমুখী উদ্যোগের কি কোনো অভাব এ দেশে আছে?
বহুমাত্রিক চেষ্টার মধ্যে শুধু আয় বৃদ্ধিই নয়, বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। অধুনা পরিবেশ রক্ষার কথাও বলা হচ্ছে। এর ফলে এসব ক্ষেত্রের অপূর্ণতা দূর করার জন্য রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় সংস্থার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। এর মধ্যে কিছু থাকে বৃহৎ আকারের প্রকল্প। এসব প্রকল্প সাধারণত অবকাঠামো নির্মাণসংক্রান্ত। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া হয় বিলম্বিত, নয়তো এর বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়। প্রধান কারণ দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগ। দারিদ্র্যমুক্তির জন্য সাধারণত এ ধরনের প্রকল্প বাধা হয়ে পড়ে। কারণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট জমি অধিগ্রহণ করতে হয়। এর ফলে ক্ষুদ্র কৃষকরা হয় ভূমিহীন। তবে সাম্প্রতিককালে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পুনর্বাসনের বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তবে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য এ ধরনের পন্থা কতটুকু ফলপ্রসূ, তার কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। যে বিষয়টি ধ্রুব সত্য তা হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র কৃষকরা তাদের জীবিকা অর্জনের একমাত্র উৎস থেকে স্থায়ীভাবে বঞ্চিত হয়। জমির বাজারমূল্যের আধিক্যের জন্য বিকল্প জমি ও ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে ক্রয় করা সম্ভব নয়।
দারিদ্র্যের চক্রে আবর্তিত হওয়ার আরো কিছু বিষয় আছে। এর একটি প্রধান উৎস হলো পরিবহনব্যবস্থার মরণফাঁদ। প্রায় প্রতিদিন রাজপথে দুর্ঘটনার জন্য বহু মানুষ নিহত হয়। অনেকে পঙ্গুত্বও বরণ করে। যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় অথবা পঙ্গুত্ববরণ করে, সেই পরিবার দারিদ্র্যের শিকার হয়। অন্য একটি প্রধান উৎস হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের কারণে যারা মৃত্যু অথবা পঙ্গুত্ববরণ করে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিবার দারিদ্র্যের আবর্তে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে দুটি কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব_এক. মামলাজনিত ব্যয়, দুই. চিকিৎসাজনিত ব্যয়। এসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত পরিবারের দারিদ্র্যের মাত্রা জানা যায় না।
কয়েক বছর ধরে দারিদ্র্যের শিকার হওয়ার অন্য একটি উৎসের কথাও বলা যায়। বিষয়টি সরকারি পদে নিয়োগের সঙ্গে জড়িত, যাকে মিডিয়া 'নিয়োগ বাণিজ্য' হিসেবে আখ্যায়িত করে। এসব পদে নিয়োগের জন্য দরিদ্র পরিবারের তরুণ-তরুণীদের পদভেদে তিন থেকে সাত লাখ টাকা অযথা ব্যয় করতে হয়। এই ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট পরিবারের মা-বাবাকেই বহন করতে হয়। প্রদত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারের জন্য নয়। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে যে সংশ্লিষ্ট পরিবার দারিদ্র্যের শিকার হয়, তা অস্বীকার করা যায় না। এসব পরিবার এই ব্যয় মেটাতে কী ধরনের ঋণের চক্রে আবদ্ধ হয়, তা অজানা। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এ প্রথাও কোনো পরিবারের জন্য দরিদ্র হওয়ার অন্যতম উৎস। সাম্প্রতিককালে রেলওয়ে বিভাগে এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যও মিডিয়া প্রকাশ করেছে। ৬০ লাখ টাকারও বেশি অর্থ রেলওয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাবেক রেলমন্ত্রীর ব্যক্তিগত দপ্তরের এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে জড়িত ছিলেন বলে বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন এদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। বিষয়টিকে মিডিয়া রেলওয়ে গেট কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এর ফলে কত পরিবার দারিদ্র্যের আবর্তে নিপতিত হবে, তা কি কোনো দিন জানা যাবে? এদের জন্য দারিদ্র্যমুক্তির পথ কী?
বলা যায়, এক দশকেরও অধিককাল ধরে অর্থের বিনিময়ে সরকারি পদে নিয়োগ বাণিজ্য প্রথায় কিছুসংখ্যক তরুণ-তরুণী হয়তো কাজ পেয়েছে। অর্থাৎ তাদের জীবিকা অর্জনের সুযোগ হয়েছে। এ জন্য সব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা এত অর্থ প্রদানের ফলে কি দরিদ্র হয়নি? এদের জন্য দারিদ্র্যমুক্তির উপায় কী? এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে সরকারি পদের মাসিক আয় থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দারিদ্র্য নিরসন হবে না। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে যাঁরা নিজ উদ্যোগে কাজ করার সুযোগ পান, তাঁদের অবস্থাও একই রকম। এ বিষয়ে সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস গার্মেন্ট শিল্পে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছে। বলা হয়েছে, এ খাতে শ্রমিকদের যথেষ্ট অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের দুঃখ-দুর্দশার অন্ত নেই। গার্মেন্ট শিল্প কয়েক মিলিয়ন তরুণীকে কাজ দিয়েছে। এতে কি দারিদ্র্য থেকে তারা মুক্তি পেয়েছে?
চিকিৎসাসুবিধার জন্য রাষ্ট্র ও বেসরকারি খাতে অনেক প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে। তবে অনিয়ম ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি খাতে চিকিৎসাজনিত ব্যয় নিয়ে সব সময় বিতর্ক হয়। বলা হয় যে রাষ্ট্রীয় খাতে এ ব্যয় বেসরকারি খাতের তুলনায় কম। আসলে কি তা-ই? এ বিষয়ে মিডিয়ায় সময় সময় কিছু সংবাদ প্রকাশ করা হয়। রোগীর বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালের বাইরেই করতে হয়। ওষুধ কেনার জন্যও একই পথ রোগীরা অনুসরণ করতে বাধ্য হয়। এসব ব্যয় হিসাবে নিলে কত হবে তা এখনো অজানা। তবে এসব ব্যয় মোট ব্যয়ের সঙ্গে যোগ করলে সরকারি খাতে চিকিৎসা ব্যয় কম তা হয়তো বলা যাবে না। চিকিৎসা ব্যয়সংক্রান্ত কিছু গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণত বেশির ভাগ মানুষই প্রথমে খুচরা ওষুধ বিক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে; সরাসরি চিকিৎসকদের সঙ্গে নয়। অত্যধিক চিকিৎসা ব্যয় এড়াতেই তাদের এ ধরনের প্রবণতা।
নগরে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট। ১৯৯৮ সাল থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প এখনো চালু আছে। এর আগে গঠিত সব কটি সিটি করপোরেশনসহ কয়েকটি পৌরসভা এর আওতাভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের মূল্যায়নে দেখা যায়, প্রকল্পটি বহুলাংশে ফলপ্রসূ হয়েছে। এই মূল্যায়নে বলা হয়েছে, প্রকল্পভুক্ত ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনা মূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৭০ শতাংশের কী হবে? এর জন্য অবশ্য অরাষ্ট্রীয় খাতে কিছু একই ধরনের প্রকল্প রয়েছে। তবে শত ভাগ দরিদ্র মানুষ সেবা পাবে কি না তা জানা যায়নি।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.