বালু উত্তোলন-তথাকথিত বৈধতার দায়
ঢাকার ধামরাই এলাকার গাজীখালী ও বংশী নদীতে 'অবৈধভাবে' বালু উত্তোলনকে সমকালের লোকালয় পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে যথার্থই 'মহোৎসব' বলা হয়েছে। সামান্য কয়েক কিলোমিটার এলাকায় যদি দিনে-রাতে শতাধিক ড্রেজার চলতে থাকে, সেটাকে আর কী বিশেষণ দেওয়া যায়? বালু উত্তোলনের এই চিত্র কিন্তু সারাদেশেরই।
বড় কথা, বালু উত্তোলন সবসময় 'অবৈধ'ও নয়। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এমনিতেই নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন নদীগুলোর জন্য এই নতুন আপদ খোদ সরকারই ডেকে এনেছে। ২০১০ সালে 'বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন' প্রণয়নের মধ্য দিয়ে নদী নষ্টের এই আয়োজনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কী ক্ষতি হয়; নদী ভাঙন, ভূমিধস ও উর্বরতা শক্তি হ্রাসে কী অবদান রাখে; সড়ক কিংবা সেতুর মতো মূল্যবান স্থাপনার জন্য কতটা হুমকি তৈরি হয়_ এসব বিবেচনা না করেই গত এক দশকে নির্বিচারে বালু লুট চলছিল। পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল যে, ২০০৯ সালের মাঝামাঝি একটি নদীর বালু উত্তোলন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রয়োজন হয়েছিল। ওই বছরের শেষ দিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীও এ ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআইডবি্লউটিএ থেকে কয়েকটি থানায় আনুষ্ঠানিক চিঠিও পাঠানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এই অপতৎপরতা বন্ধ করা যায়নি। এর দাওয়াই হিসেবে ২০১০ সালে এসেছিল নতুন আইন। আমাদের পর্যবেক্ষণে তাতে বরং পরিস্থিতির অবনতিই হয়েছে। বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেট প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ' করে, রাজনৈতিক আশীর্বাদ নিয়ে মহাসমারোহে চালিয়ে যাচ্ছে নদী হত্যার আয়োজন। অবৈধ উত্তোলনকারীদের না হয় সাময়িক তাড়িয়ে দেওয়া যায়; বৈধতার নাম ভাঙিয়ে যারা নদীতে নামে, তাদের কী করা হবে? এটা ঠিক, ওই আইনে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ব্যাপারে নানা বিধিনিষেধ আছে; কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ শূন্য। ফলে আমরা মনে করি, বিধানের মারপ্যাঁচের বদলে নদী থেকে বালু উত্তোলন এক কথায় নিষিদ্ধ হওয়া দরকার। তাতে করে বালু সিন্ডিকেট, কতিপয় সরকারি কর্মচারী ও স্থানীয় রাজনীতিকের বাড়তি আয় হয়তো মারা পড়বে; বেঁচে যাবে শত শত জীবন ও জীবিকা। মনে রাখা জরুরি, তথাকথিত বৈধতার নামে নদী ও জীবনের এমন ক্ষতি আত্মঘাত ছাড়া আর কিছু নয়। এই সর্বনাশা তৎপরতা যত বেশিদিন চলবে, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ ততই কঠিন হয়ে পড়বে।
No comments