ঈদ : আনন্দ, ঝুঁকি, আবেগ ও বাস্তবতা by ওয়াহিদ নবি
মানুষের জীবন বেশ বৈচিত্র্যময়। কারো কম, কারো বেশি। মানুষের জীবনে আছে বাস্তবতা। আবার আছে আবেগ। বুদ্ধিমানরা মনে করেন, বাস্তবতার নিরিখেই জীবনটা চালিত করা উচিত। নির্ভেজাল আবেগের দ্বারা জীবনটা নিয়ন্ত্রিত হোক- এ কথা কেউ বলবেন না। তবে জীবনটা আবেগশূন্য হলে জীবন যান্ত্রিক হয়ে পড়বে- এটাও ঠিক।
যান্ত্রিক জীবন কে চাইবে! অন্যদিকে জীবনটা সম্পূর্ণরূপে আবেগতাড়িত হলে জীবন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। জীবনে কতটা বাস্তবতার প্রভাব থাকবে আর কতটা থাকবে আবেগের বা কতটা থাকা উচিত, এ কথা কে বলতে পারে! বিজ্ঞানী আর গবেষকরা পরিমাণ নির্ণয়ের (কোয়ান্টিফিকেশন) কথা বলেন। কিন্তু জীবনে বাস্তবতা আর আবেগের পরিমাণ কে নির্ণয় করবে? সমস্যা আরো আছে। বাস্তবতা বলতে কী বোঝায়। আবার আবেগ বলতেই বা আমরা কী বুঝি? দুটিকে আলাদা করা যায় কি? মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, তার অভিজ্ঞতা আর তার মানসিক গঠনের ওপরও বাস্তবতা আর আবেগের সংজ্ঞা নির্ভর করে।
বাংলাদেশে ঈদ উদ্যাপন সংবাদমাধ্যমে দেখে এসব কথা মনে পড়ল। প্রতিবছর মনে পড়েছে। মানুষ কিছু উদ্যাপন করতে চায়। ঈদ আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এটি ধর্মীয় উৎসব তো বটেই, তবে সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। মনে পড়ে, আমরাও ছোটবেলায় সকালে উঠে নতুন কাপড়চোপড় পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে হৈচৈ করে বেড়িয়েছি। এ আনন্দ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। চাকরির খাতিরে আব্বা থাকতেন শহরে, তবে ঢাকায় নয়। গ্রামে দাদা-দাদি বা নানা-নানিদের কাছে যেবার যেতে পারতাম, সেবার আরো ভালো লাগত। আসলেই 'গ্র্যান্ড প্যারেন্টদের সঙ্গে গ্র্যান্ড চিলড্রেনদের সম্পর্কটা অত্যন্ত আদরের। ছোট শহর থেকে গ্রামে যাওয়া আর আজকের ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়া ভিন্ন ব্যাপার।
স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যম ঢাকার মানুষের গ্রামে ছুটে যাওয়াকে 'নাড়ির টান' বা 'শিকড়ের সন্ধানে' ইত্যাদি আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছে। খুব ভালো লেগেছে রাজধানী আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে হৃদয়ের যোগাযোগ কবিত্বময় ভাষায় বর্ণিত হতে দেখে। এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু একটা কিন্তুর ব্যাপার মনে বিঁধেছে।
এবার অবশ্য মানুষের ভিড়ে লঞ্চডুবি হয়নি। রেল দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাস্তায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। তবে ঈদের জন্য বাসের অতিরিক্ত যাতায়াত এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কি না তা বলতে পারি না পরিসংখ্যান না থাকায়। আমাদের রাস্তায় অন্য সময়ও প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে বিভিন্ন কারণে। প্রাণহানি ছাড়াও রয়েছে দুর্ভোগের ব্যাপার। বাসের ছাদে মানুষ। ট্রেনের ছাদে মানুষ। লঞ্চের ছাদে মানুষ। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব। বড় দুর্ঘটনা যে ঘটেনি, এটা সৌভাগ্যের বিষয়। বিবিসি টেলিভিশনে দেখিয়েছে, একজন মাঝবয়সী মহিলাকে দুই হাত ধরে টেনে ট্রেনের ছাদে ওঠানো হচ্ছে।
এসব ঘটা স্বাভাবিক। ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায় এমন সব উৎসবের সময়। ঢাকার লোকসংখ্যা এখন বোধ হয় দেড় কোটির কম নয়। কেউ কেউ বলেন, দুই কোটি। ঠিক কতজন ঢাকার বাইরে যান হয়তো বলা যাবে না, তবে এটা বলা যায় যে যতজন বাইরে যান, তাদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো যানবাহন আমাদের নেই। এর ফলে যা ঘটা স্বাভাবিক, তা-ই ঘটে। ট্রেন সময়মতো ছাড়েনি। বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে হাসাহাসি হলেও তারও একটা সীমা আছে। বাসের জন্যও দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে সবাইকে। রেলস্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করার বা বসার প্রচুর জায়গা নেই। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে বাচ্চাদের আর মহিলাদের দুর্ভোগের সীমা-পরিসীমা নেই। কোনো কোনো বাসস্ট্যান্ডে কাদা-পানিও হয়েছিল।
'মুক্ত অর্থনীতির' যুগে যাত্রীর আধিক্য আর যানবাহনের স্বল্পতা। পরিণামে যা ঘটা স্বাভাবিক, তা-ই ঘটেছে। বকশিশের ব্যাপার ঘটেছে। ভাড়া বেশি নিয়েছে যানবাহনের কর্তারা। চাঁদাবাজি হয়েছে কোথাও কোথাও। এবার মোবাইল ফোনে টাকা লোডের জন্য বেশি পয়সার কথা শুনলাম, যা আগে শুনিনি।
এবার জলপথ বা রেলপথে দুর্ঘটনার জন্য প্রাণহানি ঘটেনি। অত্যন্ত স্বস্তির বিষয় এটি। এটি কি এমনিতেই ঘটেছে? যোগাযোগমন্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় নিজে গেছেন। নিজের চোখে সব দেখেছেন। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছেন সমস্যা দূর করার। নৌমন্ত্রীও ছুটে বেড়িয়েছেন। পত্রিকায় দেখলাম, সদরঘাট থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত 'যাত্রীসেবা কার্যক্রম'-এর অধীনে পাঁচটি পয়েন্টে ১২ জন করে ক্যাডেট রাখা হয়েছিল, যারা যাত্রীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছিল। সরকার চেষ্টা করেছে কিছুটা হলেও সীমিত সংগতি নিয়ে। ভালো ফল পাওয়া গেছে। কাজেই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দেওয়া উচিত। বাজারে ইলিশ মাছ সস্তা ছিল বলে বাণিজ্যমন্ত্রীর রপ্তানিনীতির প্রশংসা করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবার বেড়ে যায়নি খুব একটা। বিদ্যুৎ সরবরাহ সন্তোষজনক ছিল বলে প্রকাশ। এটি একটি বড় খবর। এমন চলতে থাকলে তো খুব ভালো হয়।
সাধারণত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে ঈদের সময়। এবারে তা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ জন্য প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বাড়িঘর তালাবদ্ধ করে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উপদেশ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ সমালোচনার পাত্রী হয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের ভাষা অবশ্যই আরো উন্নতমানের হতে হবে। তবে এবারের ঈদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের প্রশংসা পাবেন।
শুনে ভালো লেগেছে যে জেলখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উন্নততর খাদ্য পরিবেশন করা হয়েছে। টেলিভিশনে অনেক সময় ব্যয় করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎকার দেখানো হয় এবং সব সময়ই দেখানো হয়েছে। যাঁরা সাক্ষাৎ করার জন্য যান, তাঁরা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে হওয়ায় এই প্রোগ্রামগুলো যখন দেখানো হয়, তখন আমি অন্য চিন্তা করি।
আনন্দের বিষয় এই যে এবারের ঈদ তুলনামূলক অনেক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু এই ভালোকে ধরে রাখতে হলে প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আমাদের আরো ভালো করতে হবে। ঈদে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন আমরা হই, তা আসলে আমাদের প্রাত্যহিক সমস্যার বর্ধিত রূপ। এগুলো আলোচিত হওয়া উচিত। হয়তো আবেগের বশে ঈদকে ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদি বলে কোনো আলোচনায় কেউ সায় দেবে না। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সবার এসব ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত করার চেষ্টা করা উচিত।
আমাদের সব কিছুই ঢাকায়। সব সুযোগ ঢাকায়। কাজেই সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। আমাদের থানাগুলো উপজেলা হয়েছে। মহকুমাগুলো জেলা হয়েছে। অনেক জেলা শহর এখন বিভাগীয় শহর হয়েছে। যদি আমরা বিভাগগুলোকে প্রদেশ বানাই, তবে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে এই শহরগুলো বেশ গুরুত্ব পাবে। অনেক অফিস-আদালত স্থাপিত হবে। এতে করে হয়তো ঢাকার ওপর চাপ কমে যাবে। প্রাদেশিক রাজধানী শহরগুলো থেকে অনেকের বাড়ি কাছাকাছি হবে, কাজেই বাড়ি যাওয়া সহজ হবে ঈদের সময়।
ঈদ উদ্যাপন করতে সবাই চান। ঈদে মা-বাবাকে দেখতে কে না যেতে চায়? কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত না করাই ভালো। ঈদের বিস্ময়- ঢাকায় ঈদ উদ্যাপন করে দু-এক সপ্তাহ পর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনেক ঝুঁকি আর অনেক দুর্ভোগ পরিহার করা সম্ভব। নিকট-ভবিষ্যতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়- এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। ঢাকায় আমাদের কর্মস্থল। ছেলেমেয়েরা এখানে মানুষ হচ্ছে। এসব চিন্তা করে ঢাকাকে আরেকটু বেশি আপন করে নেওয়ার চেষ্টা আমাদের করে নেওয়া উচিত নয় কি?
অমিয় চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা- 'বড় বাবুর কাছে নিবেদন' মনে পড়ল। কাজে আসার পথে একজন ডেইলি প্যাসেঞ্জারের চোখে কি পড়ে কবিতাটি, তারই মর্মস্পর্শী বর্ণনা। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার সঙ্গে রাজ্যের সব জায়গার ভালো রেল যোগাযোগ রয়েছে। আমরা এমনটা করতে পারলে অনেকেই নিজের বাড়ি থেকে কাজে আসতে পারবেন। ঢাকার ওপর চাপ কম পড়বে। এমনি অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব আলোচনা করলে।
আমাদের কিছু একটা করা উচিত। আসলে আমাদের কিছু একটা করতেই হবে। কত দিন আর দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ দেবে? কত দিন আর দুর্ভোগ পোহাবে মানুষ?
লেখক : ফেলো, রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট, লন্ডন।
বাংলাদেশে ঈদ উদ্যাপন সংবাদমাধ্যমে দেখে এসব কথা মনে পড়ল। প্রতিবছর মনে পড়েছে। মানুষ কিছু উদ্যাপন করতে চায়। ঈদ আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এটি ধর্মীয় উৎসব তো বটেই, তবে সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক উৎসবও বটে। মনে পড়ে, আমরাও ছোটবেলায় সকালে উঠে নতুন কাপড়চোপড় পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে হৈচৈ করে বেড়িয়েছি। এ আনন্দ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। চাকরির খাতিরে আব্বা থাকতেন শহরে, তবে ঢাকায় নয়। গ্রামে দাদা-দাদি বা নানা-নানিদের কাছে যেবার যেতে পারতাম, সেবার আরো ভালো লাগত। আসলেই 'গ্র্যান্ড প্যারেন্টদের সঙ্গে গ্র্যান্ড চিলড্রেনদের সম্পর্কটা অত্যন্ত আদরের। ছোট শহর থেকে গ্রামে যাওয়া আর আজকের ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়া ভিন্ন ব্যাপার।
স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যম ঢাকার মানুষের গ্রামে ছুটে যাওয়াকে 'নাড়ির টান' বা 'শিকড়ের সন্ধানে' ইত্যাদি আবেগময় ভাষায় বর্ণনা করেছে। খুব ভালো লেগেছে রাজধানী আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মধ্যে হৃদয়ের যোগাযোগ কবিত্বময় ভাষায় বর্ণিত হতে দেখে। এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু একটা কিন্তুর ব্যাপার মনে বিঁধেছে।
এবার অবশ্য মানুষের ভিড়ে লঞ্চডুবি হয়নি। রেল দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাস্তায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। তবে ঈদের জন্য বাসের অতিরিক্ত যাতায়াত এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কি না তা বলতে পারি না পরিসংখ্যান না থাকায়। আমাদের রাস্তায় অন্য সময়ও প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে বিভিন্ন কারণে। প্রাণহানি ছাড়াও রয়েছে দুর্ভোগের ব্যাপার। বাসের ছাদে মানুষ। ট্রেনের ছাদে মানুষ। লঞ্চের ছাদে মানুষ। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এসব। বড় দুর্ঘটনা যে ঘটেনি, এটা সৌভাগ্যের বিষয়। বিবিসি টেলিভিশনে দেখিয়েছে, একজন মাঝবয়সী মহিলাকে দুই হাত ধরে টেনে ট্রেনের ছাদে ওঠানো হচ্ছে।
এসব ঘটা স্বাভাবিক। ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায় এমন সব উৎসবের সময়। ঢাকার লোকসংখ্যা এখন বোধ হয় দেড় কোটির কম নয়। কেউ কেউ বলেন, দুই কোটি। ঠিক কতজন ঢাকার বাইরে যান হয়তো বলা যাবে না, তবে এটা বলা যায় যে যতজন বাইরে যান, তাদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মতো যানবাহন আমাদের নেই। এর ফলে যা ঘটা স্বাভাবিক, তা-ই ঘটে। ট্রেন সময়মতো ছাড়েনি। বাঙালির সময়জ্ঞান নিয়ে হাসাহাসি হলেও তারও একটা সীমা আছে। বাসের জন্যও দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে সবাইকে। রেলস্টেশনে বা বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করার বা বসার প্রচুর জায়গা নেই। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে বাচ্চাদের আর মহিলাদের দুর্ভোগের সীমা-পরিসীমা নেই। কোনো কোনো বাসস্ট্যান্ডে কাদা-পানিও হয়েছিল।
'মুক্ত অর্থনীতির' যুগে যাত্রীর আধিক্য আর যানবাহনের স্বল্পতা। পরিণামে যা ঘটা স্বাভাবিক, তা-ই ঘটেছে। বকশিশের ব্যাপার ঘটেছে। ভাড়া বেশি নিয়েছে যানবাহনের কর্তারা। চাঁদাবাজি হয়েছে কোথাও কোথাও। এবার মোবাইল ফোনে টাকা লোডের জন্য বেশি পয়সার কথা শুনলাম, যা আগে শুনিনি।
এবার জলপথ বা রেলপথে দুর্ঘটনার জন্য প্রাণহানি ঘটেনি। অত্যন্ত স্বস্তির বিষয় এটি। এটি কি এমনিতেই ঘটেছে? যোগাযোগমন্ত্রী বিভিন্ন জায়গায় নিজে গেছেন। নিজের চোখে সব দেখেছেন। যতদূর সম্ভব চেষ্টা করেছেন সমস্যা দূর করার। নৌমন্ত্রীও ছুটে বেড়িয়েছেন। পত্রিকায় দেখলাম, সদরঘাট থেকে লঞ্চঘাট পর্যন্ত 'যাত্রীসেবা কার্যক্রম'-এর অধীনে পাঁচটি পয়েন্টে ১২ জন করে ক্যাডেট রাখা হয়েছিল, যারা যাত্রীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও উপদেশ দিয়েছিল। সরকার চেষ্টা করেছে কিছুটা হলেও সীমিত সংগতি নিয়ে। ভালো ফল পাওয়া গেছে। কাজেই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ দেওয়া উচিত। বাজারে ইলিশ মাছ সস্তা ছিল বলে বাণিজ্যমন্ত্রীর রপ্তানিনীতির প্রশংসা করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবার বেড়ে যায়নি খুব একটা। বিদ্যুৎ সরবরাহ সন্তোষজনক ছিল বলে প্রকাশ। এটি একটি বড় খবর। এমন চলতে থাকলে তো খুব ভালো হয়।
সাধারণত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে ঈদের সময়। এবারে তা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ জন্য প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। বাড়িঘর তালাবদ্ধ করে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উপদেশ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেশ সমালোচনার পাত্রী হয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের ভাষা অবশ্যই আরো উন্নতমানের হতে হবে। তবে এবারের ঈদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনগণের প্রশংসা পাবেন।
শুনে ভালো লেগেছে যে জেলখানাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উন্নততর খাদ্য পরিবেশন করা হয়েছে। টেলিভিশনে অনেক সময় ব্যয় করে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎকার দেখানো হয় এবং সব সময়ই দেখানো হয়েছে। যাঁরা সাক্ষাৎ করার জন্য যান, তাঁরা সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে হওয়ায় এই প্রোগ্রামগুলো যখন দেখানো হয়, তখন আমি অন্য চিন্তা করি।
আনন্দের বিষয় এই যে এবারের ঈদ তুলনামূলক অনেক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু এই ভালোকে ধরে রাখতে হলে প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আমাদের আরো ভালো করতে হবে। ঈদে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন আমরা হই, তা আসলে আমাদের প্রাত্যহিক সমস্যার বর্ধিত রূপ। এগুলো আলোচিত হওয়া উচিত। হয়তো আবেগের বশে ঈদকে ধর্মীয়, সামাজিক, পারিবারিক ইত্যাদি বলে কোনো আলোচনায় কেউ সায় দেবে না। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সবার এসব ব্যাপারে আলোচনার সূত্রপাত করার চেষ্টা করা উচিত।
আমাদের সব কিছুই ঢাকায়। সব সুযোগ ঢাকায়। কাজেই সবাই ঢাকায় থাকতে চায়। আমাদের থানাগুলো উপজেলা হয়েছে। মহকুমাগুলো জেলা হয়েছে। অনেক জেলা শহর এখন বিভাগীয় শহর হয়েছে। যদি আমরা বিভাগগুলোকে প্রদেশ বানাই, তবে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে এই শহরগুলো বেশ গুরুত্ব পাবে। অনেক অফিস-আদালত স্থাপিত হবে। এতে করে হয়তো ঢাকার ওপর চাপ কমে যাবে। প্রাদেশিক রাজধানী শহরগুলো থেকে অনেকের বাড়ি কাছাকাছি হবে, কাজেই বাড়ি যাওয়া সহজ হবে ঈদের সময়।
ঈদ উদ্যাপন করতে সবাই চান। ঈদে মা-বাবাকে দেখতে কে না যেতে চায়? কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত না করাই ভালো। ঈদের বিস্ময়- ঢাকায় ঈদ উদ্যাপন করে দু-এক সপ্তাহ পর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে অনেক ঝুঁকি আর অনেক দুর্ভোগ পরিহার করা সম্ভব। নিকট-ভবিষ্যতে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়- এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। ঢাকায় আমাদের কর্মস্থল। ছেলেমেয়েরা এখানে মানুষ হচ্ছে। এসব চিন্তা করে ঢাকাকে আরেকটু বেশি আপন করে নেওয়ার চেষ্টা আমাদের করে নেওয়া উচিত নয় কি?
অমিয় চক্রবর্তীর বিখ্যাত কবিতা- 'বড় বাবুর কাছে নিবেদন' মনে পড়ল। কাজে আসার পথে একজন ডেইলি প্যাসেঞ্জারের চোখে কি পড়ে কবিতাটি, তারই মর্মস্পর্শী বর্ণনা। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার সঙ্গে রাজ্যের সব জায়গার ভালো রেল যোগাযোগ রয়েছে। আমরা এমনটা করতে পারলে অনেকেই নিজের বাড়ি থেকে কাজে আসতে পারবেন। ঢাকার ওপর চাপ কম পড়বে। এমনি অনেক কিছুই আমরা জানতে পারব আলোচনা করলে।
আমাদের কিছু একটা করা উচিত। আসলে আমাদের কিছু একটা করতেই হবে। কত দিন আর দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ দেবে? কত দিন আর দুর্ভোগ পোহাবে মানুষ?
লেখক : ফেলো, রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্ট, লন্ডন।
No comments