ছোট ছোট কথা, অনন্য শিল্পকর্ম বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ভুলিয়ে দেয়- ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়েঈদকার্ড by মোরসালিন মিজান
বড় উৎসব আনন্দের দিনগুলোতে প্রিয়জনকে খুব মিস করে মানুষ। বুকের ভেতরটা তাঁর বা তাঁদের জন্য কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। দূরে থাকলেও নানা উপায়ে একজন আরেকজনকে স্মরণ করেন। আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার চেষ্টা করেন। ঈদে এ আবেগ-অনুভূতি বেড়ে যায়।
আর তখনই বন্ধুজন ও শুভানুধ্যায়ীরা একে অপরকে বিশেষ এক ধরনের চিঠি লেখেন। চিঠির নামÑ ঈদকার্ড। অনন্য সুন্দর এ শিল্পকর্মের মাধ্যমে ছোট ছোট কথায় ভাবভালবাসা বিনিময় হয়। এ রীতি বহুদিনের পুরনো। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এখনও আছে ঈদকার্ড। আর সব কেনাকাটার ফাঁকে অনেকে এটি কিনছেন। রঙিন খামের গায়ে সুগন্ধী কালি দিয়ে ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছেন দূর-দূরান্তে। মামুলিকার্ড। তবে বিচ্ছিন্নতার কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছে দিব্যি। এখানেই বিশেষত্ব ঈদকার্ডের।
শুধু প্রেমিক-প্রেমিকা নন, স্বজন-সুহৃদদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ঈদকার্ডের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। শুধু কি তাই? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার টানাপোড়েনের সম্পর্কটিও অনায়াসে ভুলিয়ে দিচ্ছে শুভেচ্ছা বিনিময়ের অনন্য এ মাধ্যম। ক্রমবর্ধমান বৈরিতার মধ্যেও আসন্ন ঈদে দুই নেত্রী পরস্পরকে ঈদকার্ড পাঠিয়েছেন। উভয়ে উভয়ের জন্য শুভ কামনা করেছেন। বর্তমান বাস্তবতায় এ তো কম বড় কথা নয়!
রাজধানীর পুরানা পল্টন, নিউমার্কেট, ধানম-ি, বসুন্ধরা সিটি শপিংমল, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন এলাকার গিফটশপ ঘুরে দেখা গেছে, হরেক রকমের গ্রিটিংস কার্ডে ভরে উঠেছে অধিকাংশ শোরুম। অন্য উপহার সামগ্রীর পাশাপাশি যতœ করে সাজানো হয়েছে ঈদকার্ড। এ সবের কোন একটি হাতে নিলে মন ভাল হয়ে যায়। ঈদকার্ডগুলোতে নানা কায়দায় ফুল, পাখি প্রজাপতি আঁকা হয়েছে। কার্ডের গায়ে রঙিন নেট কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ফুল। সে ফুলে উজ্জ্বল পাথর বা পুঁতি বসিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে নতুন মাত্রা। কোন ঈদকার্ডে বাংলা, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় লেখা হয়েছেÑ ঈদ মোবারক। কোনোটির গায়ে আঁকা আছে মসজিদের ছবি। শক্ত কাগজ কেটে চমৎকার নকশা করা হয়েছে কিছু কার্ডে। এসব ঈদকার্ডের আকারও অনেক রকম। ছোট মাঝারি আছে। বিশাল মাপের আছে। কোন কোন ঈদকার্ড এত বড় যে বইয়ের মতো দুই হাতে মেলে ধরতে হয়। কোনটি থেকে সুগন্ধ ছড়ায়। কোনটিতে হাত ছোঁয়ালে
আলো জ্বলে। মিষ্টি মিউজিক শোনায় কোন কোন কার্ড। সব মিলিয়ে অসাধারণ শিল্পকর্ম।
মোটামুটি সব গিফটশপে ঈদকার্ড থাকলেও আর্চিস গ্যালারি, হলমার্কসহ কিছু ব্র্যান্ড বেশ এগিয়ে। বিদেশী হলেও গিফটশপ দুটির সঙ্গে বহু দিনের জানাশোনা বাংলাদেশের মানুষের। আর্চিসের হাতিরপুলের একটি শোরুমে গিয়ে দেখা গেল ভাল কেনাকাটা। দোকানি মামুন জানালেন, এবার ১৫টির মতো নতুন ডিজাইনের কার্ড এনেছেন তাঁরা। এ সব ঈদকার্ডের দাম ধরা হয়েছে ৪০ টাকা থেকে ২শ’ ৫০ টাকা পর্যন্ত। একই এলাকার হলমার্কের শোরুমটি ঘুরে দেখা যায়, নতুন-পুরনো মিলিয়ে ২০ থেকে ৩৫টির মতো ডিজাইন। এ দোকানের সেলসম্যান আব্দুল হক জানালেন, তাঁদের কার্ডগুলোর দাম ১শ’ ২০ থেকে ৩শ’ ৫০ টাকার মধ্যে। ঈদের শুভেচ্ছা বাণী হিসেবে কার্ডে লেখা হয়েছেÑ ‘ওয়ার্ম উইশেস লাইক ফ্লাওয়ার্স আর সেন্ট, ফর সামওয়ান অন স্পেশাল ডে।’ কোনটির গায়ে লেখা আছেÑ ‘হু এভার আই এম উইথ, হুয়াট এভার আই ডু, নো ম্যাটার হয়্যার আই এম, আই কীপ থিংকিং অব ইউ।’ অথবা ছোট্ট করে লেখা আছেÑ ‘মিস ইউ অন ঈড ডে।’ এভাবে নানা ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করা হয়েছে মনের আবেগ-অনুভূতিগুলো। এখানে কার্ড কিনতে এসেছিলেন রুহী। একটি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিতে চাকরি করেন। তথ্যপ্রযুক্তির এই সময়ে ঈদকার্ড কতটা আবেদন রাখতে সক্ষম? জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আবেদন বেশি বলেই ঈদকার্ড কিনতে এসেছি। চমৎকার একটি কার্ড হাতে নিয়ে খুশি না হয়ে পারা যায় না। আমি জানি, আমার বন্ধুরাও এ কার্ড পেয়ে খুশি হবে। সে জন্যই ঈদকার্ড কিনতে এসেছি। নিউমার্কেটের আর্চিস গ্যালারিতে ঈদকার্ড কিনতে আসা তরুণ ব্যবসায়ী অপূর্ব জানালেন, ঈদে অনেক কিছুই কেনেন তিনি। তবে ঈদকার্ড না কিনলে চলে না। কারণ, তাঁর মেয়ে বন্ধুটিকে অনেক মজার মজার কথা তিনি এ কার্ডের মাধ্যমে লিখতে পারেন, যা সরাসরি বা ফোনে বলা সম্ভব হয় না।
তবে এত আবেদ সত্ত্বেও ঈদকার্ডের সে সুদিন আর এখন নেই। বিক্রি অনেক কমে গেছে। দেশীয় ঈদকার্ডের সবচেয়ে বড়বাজার পুরানা পল্টন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আজাদ প্রডাক্টস, আইডিয়াল প্রডাক্টসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান পাইকারি ও খুচরা ঈদকার্ড বিক্রি করছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শোরুম বিয়ের কার্ডে ঠাঁসা। ঈদকার্ড আছে নামে মাত্র। জানা যায়, বর্তমান প্রজন্ম মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটসহ তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পেতে বেশি আগ্রহী। মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ভালই চলে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়। আর টুইটার, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলোর কথা তো বলাইবাহুল্য। দিবসের বড় একটি সময় এ সব সাইটে কাটান শহুরে মানুষ। খুব সহজেই তাঁরা শেয়ার করতে পারেন সবকিছু। এসব কারণে দিন দিন কমছে গ্রিটিংস কার্ডের বিক্রি। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি অচিরেই হারিয়ে যাবে ঈদকার্ড? উত্তরটি সময় বলতে পারবে। তবে এটুকু বলা যায়, কেবল ঈদকার্ডেই স্পর্শ থাকে প্রিয় মানুষটির। স্মৃতি হিসেবে দিব্যি রেখে দেয়া যায় অনন্য এ শিল্পকর্ম। শৌখিন মানুষরা তাই অত সহজে এ মোহ কাটিয়ে উঠতে পারবেন না।
No comments