বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৯২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম অকুতোভয় এক যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট শেরপুর জেলার নকশী বিওপিতে ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে নেতৃত্ব দেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী নকশী বিওপি দুর্গের আদলে সুসজ্জিত করেছিল। এখানে মোতায়েন ছিল প্রায় এক কোম্পানি সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনা।
মুক্তিযোদ্ধারা বেশির ভাগ ছিলেন মাত্র ২৮ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুদ্ধের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। ওই যুদ্ধই ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বয়ানে।
‘৩ আগস্ট (রাতে ঘড়ির সময় অনুযায়ী ৪ আগস্ট) আমি দুই কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে নকশী বিওপি আক্রমণ করি। অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে যোদ্ধারা অত্যন্ত সাবলীল গতিতে এফইউপিতে (ফর্মিং আপ প্লেস) রওনা হন। মাঝপথে নালা ক্রস করার সময় তাঁরা কোনো শব্দ করেননি। এর আগে যোদ্ধাদের নিয়ে পানির মধ্যে বিনা শব্দে চলার প্র্যাকটিস করেছিলাম। রাত তিনটা ৩৫ মিনিটে এফইউপিতে পজিশন নিই।
তিনটা ৪৫ মিনিটে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধের আগেই এফইউপিতে আমাদের নিজেদের আর্টিলারির কয়েকটি গোলা এসে পড়ে। এতে ছয় যোদ্ধা (গণবাহিনীর) গুরুতর আহত হন। একই সময় পাকিস্তানি আর্টিলারিও গর্জে ওঠে। এর মধ্যেই আমরা এক্সটেনডেড ফরমেশন তৈরি করি।
একটু পর অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে আমি চার্জ বলে হুংকার দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র উঁচু করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যান। শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেট চার্জের জন্য তাঁরা রীতিমতো দৌড়াতে থাকেন। আমাদের মনোবল দেখে পাকিস্তানি সেনারা তখন পলায়নরত।
আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য ‘নারায়ে তকবির’, ‘জয় বাংলা’, ধ্বনি দিলে মুক্তিযোদ্ধারাও ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকবার’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধের ময়দান প্রকম্পিত করে তোলেন।
ঠিক তখনই শত্রুর আর্টিলারির শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়ে আমাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আমার ডান পায়ে একটা শেল লাগে। আঘাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করার আগেই আমি জোশের সঙ্গে এগিয়ে যাই। শত্রু-বাংকার তখন কয়েক গজ দূরে।
দেখতে পেলাম গুটিকতক অতি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পলায়নরত শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের মারছেন। কেউ কেউ মাইন ফিল্ডে ফেঁসে গিয়ে উড়ে যাচ্ছেন। কেউবা শত্রুর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন। আমি তাঁদের মন চাঙা রাখার জন্য জোরে জোরে জয় বাংলা চিৎকার দিয়ে বললাম, আগে অগ্রসর হও। এরপর পাকিস্তানিদের বিওপি তছনছ হয়ে গেল।
এমন সময় আমার বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিঁধে। আমি পড়ে যাই। তখন এক পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র উঁচু করে আমার দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে সালাম (অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, এক সুবেদার মেজরের ছেলে) নামে এক ছেলে তাকে খতম করে দেয়। কিন্তু অন্য জীবিত পাকিস্তানি সেনারা আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি সাইড রোল, ক্রল করে সরে যাওয়ার সময় আবার আমার ডান কনুইয়ে গুলি লাগে। এর পরের ঘটনা সে আরেক কাহিনি।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধকরণে গোপনে নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকা হয়ে ভারতে যান এবং নানা ঘটনাপ্রবাহের পর মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭।
আমীন আহম্মেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাবস্থায় প্রেষণে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে প্রথম সাফ গেমস আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম সুলতান আহম্মেদ চৌধুরী। মা আজিজের নেছা চৌধুরানী। স্ত্রী সৈয়দা লতিফা আমীন। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
মুক্তিযোদ্ধারা বেশির ভাগ ছিলেন মাত্র ২৮ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুদ্ধের পূর্ব-অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। ওই যুদ্ধই ছিল তাঁদের জীবনের প্রথম যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ঘটনা শোনা যাক আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বয়ানে।
‘৩ আগস্ট (রাতে ঘড়ির সময় অনুযায়ী ৪ আগস্ট) আমি দুই কোম্পানি যোদ্ধা নিয়ে নকশী বিওপি আক্রমণ করি। অ্যাসেম্বলি এরিয়া থেকে যোদ্ধারা অত্যন্ত সাবলীল গতিতে এফইউপিতে (ফর্মিং আপ প্লেস) রওনা হন। মাঝপথে নালা ক্রস করার সময় তাঁরা কোনো শব্দ করেননি। এর আগে যোদ্ধাদের নিয়ে পানির মধ্যে বিনা শব্দে চলার প্র্যাকটিস করেছিলাম। রাত তিনটা ৩৫ মিনিটে এফইউপিতে পজিশন নিই।
তিনটা ৪৫ মিনিটে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, যুদ্ধের আগেই এফইউপিতে আমাদের নিজেদের আর্টিলারির কয়েকটি গোলা এসে পড়ে। এতে ছয় যোদ্ধা (গণবাহিনীর) গুরুতর আহত হন। একই সময় পাকিস্তানি আর্টিলারিও গর্জে ওঠে। এর মধ্যেই আমরা এক্সটেনডেড ফরমেশন তৈরি করি।
একটু পর অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে আমি চার্জ বলে হুংকার দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র উঁচু করে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যান। শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের বেয়নেট চার্জের জন্য তাঁরা রীতিমতো দৌড়াতে থাকেন। আমাদের মনোবল দেখে পাকিস্তানি সেনারা তখন পলায়নরত।
আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য ‘নারায়ে তকবির’, ‘জয় বাংলা’, ধ্বনি দিলে মুক্তিযোদ্ধারাও ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকবার’, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে যুদ্ধের ময়দান প্রকম্পিত করে তোলেন।
ঠিক তখনই শত্রুর আর্টিলারির শেলভো ফায়ার (এয়ার ব্রাস্ট) এসে পড়ে আমাদের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এতে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। আমার ডান পায়ে একটা শেল লাগে। আঘাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করার আগেই আমি জোশের সঙ্গে এগিয়ে যাই। শত্রু-বাংকার তখন কয়েক গজ দূরে।
দেখতে পেলাম গুটিকতক অতি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা পলায়নরত শত্রু পাকিস্তানি সেনাদের মারছেন। কেউ কেউ মাইন ফিল্ডে ফেঁসে গিয়ে উড়ে যাচ্ছেন। কেউবা শত্রুর গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছেন। আমি তাঁদের মন চাঙা রাখার জন্য জোরে জোরে জয় বাংলা চিৎকার দিয়ে বললাম, আগে অগ্রসর হও। এরপর পাকিস্তানিদের বিওপি তছনছ হয়ে গেল।
এমন সময় আমার বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিঁধে। আমি পড়ে যাই। তখন এক পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র উঁচু করে আমার দিকে ধেয়ে আসতে থাকলে সালাম (অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, এক সুবেদার মেজরের ছেলে) নামে এক ছেলে তাকে খতম করে দেয়। কিন্তু অন্য জীবিত পাকিস্তানি সেনারা আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি সাইড রোল, ক্রল করে সরে যাওয়ার সময় আবার আমার ডান কনুইয়ে গুলি লাগে। এর পরের ঘটনা সে আরেক কাহিনি।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে তিনি চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধকরণে গোপনে নানা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে নিজ এলাকা হয়ে ভারতে যান এবং নানা ঘটনাপ্রবাহের পর মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭।
আমীন আহম্মেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকাবস্থায় প্রেষণে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে প্রথম সাফ গেমস আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। তাঁর বাবার নাম সুলতান আহম্মেদ চৌধুরী। মা আজিজের নেছা চৌধুরানী। স্ত্রী সৈয়দা লতিফা আমীন। তাঁদের দুই ছেলে।
সূত্র: আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments