ফৌদারি মামলায় আপস-মীমাংসা by আবদুল্লাহ আল মামুন
বর্তমানে দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি করা হয়ে থাকে আদালতের সংশ্লিষ্ট বিচারক বা আদালতের বাইরে স্বীকৃত কোনো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে এর সুফলও নগণ পাচ্ছে।
আমাদের ফৌদারি বিচারব্যবস্থায়ও এর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে, তা দেওয়ানি বিচারব্যবস্থার মতো প্রবলভাবে নয়; বরং নীরবভাবে।
ফৌদারি কার্যবিধির ধারা ৩৪৫-এ অপরাধের আপসযোগ্যতা-সংক্রান্ত বিধানগুলো বিধৃত রয়েছে। এই ধারায় আপসযোগ্যতাকে দুভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথমত, আদালতের অনুমতি ছাড়াই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও অভিযুক্তের মধ্যে আপস এবং দ্বিতীয়ত, আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও অভিযুক্তের মধ্যে আপস। দণ্ডবিধিতে সর্বমোট ধারা ৫১১টি। এর মধ্যে শাস্তি বর্ণিত আছে এমন ধারা ৪০২টি। মার বিষয় হলো, ৬৬টি আপসযোগ্য ধারা ছাড়া বাকি সব ধারাই আপস-অযোগ্য। তাই আদালত কর্তৃক অভিযোগ একবার গঠন করা হলে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস হয়ে গেলেও মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বিজ্ঞ কৌঁসুলিদের পরামর্শে সাক্ষীরা আদালতে শপথ নিয়ে ‘ানি না, শুনি নাই, দেখি নাই’ রকমের আপসমূলক মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে আসামিদের খালাস করিয়ে নেন।
আপসযোগ্যতার এই বিধানগুলো আদালতের ওপর বাধ্যকরও নয় এবং আদালতকে কোনো কিছু বলতে বা করতে ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি। শুধু পক্ষগুলো যদি আদালতে উপস্থিত হয়ে বলে যে ‘আপস হয়ে গিয়েছে। মামলা পরিচালনা করতে আগ্রহী নই; আসামি খালাস পেলে আপত্তি নেই’—তখনই আদালত এতদ্সংক্রান্ত আইন অনুসরণ করে আদেশ দিয়ে থাকেন। আপসের মূল বিষয়টিই হলো—পক্ষগুলোর মধ্যে সমা েশান্তি, শৃঙ্খলা, সহাবস্থান নিশ্চিত করা। আদালতে যে পরিমাণ মামলা মে আছে এবং ভবিষ্যতে যে পরিমাণ আসবে, তাতে এই ৩৪৫ ধারার বিধানকে আরও বিস্তৃত এবং সুসংহত করা প্রয়োন। আশার বিষয় হলো, সরকার মামলাট কমানোর ন্য এ-সংক্রান্ত আইনকে পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। দেরিতে হলেও আমরা আশা করি বিধানগুলো যুগোপযোগী হবে। তবে, আইনটি যেন প্রকৃত অর্থেই বিচারপ্রার্থী নগণের উপকারে আসে, সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত, বিচার নিষ্পত্তির ন্য নথি এলে বিজ্ঞ ম্যাস্ট্রেট যেন প্রথম তারিখেই উভয় পক্ষকে নিয়ে আপস-মীমাংসার লক্ষ্যে বসেন। এ ধরনের বিধান আমাদের দেশের প্রচলিত দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় রয়েছে। যদি আপস সম্ভব হয়, তাহলে মামলা এভাবেই নিষ্পত্তি হবে।
দ্বিতীয়ত, বিচারকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বারের প্রবীণ কৌঁসুলি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, বিচারককেও আপস-মীমাংসার লক্ষ্যে প্যানেলভুক্ত করার বিধান রাখা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই মীমাংসাকারীদের ব্যয়ভার বহন করতে পারে।
তৃতীয়ত, প্রতিটি লোয়ই বর্তমানে একন বিচারক ‘াতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ কর্তৃক পরিচালিত ‘সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান’-এর লক্ষ্যে ‘সহায়ক কর্মকর্তা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিটি লোয়ই এ ন্য স্বতন্ত্র বিচারিক কর্মকর্তা নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যিনি শুধু সহায়ক কর্মকর্তা হিসেবেই কা করবেন। এ কর্মকর্তা বিচারিক কারে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকবেন না বলে তিনি মুক্তভাবে বিষয়টি পরিচালনা করতে পারবেন। আপস-মীমাংসার চেষ্টা ব্যর্থ হলে অতঃপর মামলাটি পুনরায় বিচারিক আদালতে প্রেরণ করার বিধান রাখা যেতে পারে।
চতুর্থত, বর্তমান বিচারব্যবস্থায় শুধু অপরাধীর সাাই হতে পারে। কিন্তু, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতির ন্য উপযুক্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। ক্ষতিপূরণের ন্য তাকে পৃথকভাবে দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে হবে। ফৌদারি কার্যবিধির ৫৪৫(১) ধারায় রিমানা থেকে ক্ষতিপূরণের বিধান থাকলেও তা অপ্রতুল। কারণ, বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কোনো কোনো অপরাধীর কাছে (যেমন—বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে নরহত্যাকারী গাড়িচালক) সর্বোচ্চ রিমানা (১০,০০০ টাকা) হাস্যকর পরিমাণ বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই, আপস-মীমাংসার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ অর্থের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
পঞ্চমত, আপস-মীমাংসার প্রক্রিয়ার ন্য সুনির্দিষ্ট সময় (যেমন—৩০ কার্যদিবস) নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে। আপস-মীমাংসাকালে মামলা নিষ্পত্তির ন্য নির্ধারিত সময়-সংক্রান্ত ‘ধারা-৩৩৯সি’ সংশোধন করে সময় গণনার ক্ষেত্রে বাদ দেওয়ার বিধান রাখা যেতে পারে।
ষষ্ঠত, বর্তমান বিধান ৩৪৫(৬) অনুযায়ী আপস-মীমাংসা হলে আসামি খালাসপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু, রায়ের মাধ্যমে গুণাগুণের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়নি বলে আপস-পরবর্তী সময়ে মনোমালিন্য হলে পুনরায় একই বিষয় নিয়ে মামলা দায়েরের আশঙ্কা থেকে যায়। নতুন ফৌদারি মামলার দায়েরে বাধা না হওয়া সংক্রান্ত ধারা ৪০৩ এক্ষেত্রে নীরব। তাই, ধারা ৪০৩-এর মূল অংশে বা ব্যাখ্যা অংশে বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে।
আপসের সুবিধা হলো, এতে সদ্ভাব বায় থাকে। তবে, এক্ষেত্রে হত্যা (৩০২ ধারা) প্রভৃতির মতো গুরুতর হীন অপরাধকে মীমাংসার আওতা-বহির্ভূত রাখা উচিত। আপস-মীমাংসা প্রক্রিয়া এবং ক্ষতিপূরণ অর্থ এই দুটোর সমন্বিত সংযোগে আমরা আশা করতে পারি আদালতসমূহ মামলার অকিঞ্চি পাহাড় থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবেন। বিচারপ্রার্থীরা প্রকৃত পক্ষেই আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা অভিযুক্তের সাার মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাবেন।
লেখক গবেষণা কর্মকর্তা, (সিনিয়র ুডিশিয়াল ম্যাস্ট্রেট), বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
আব্দুল বাসেত মুমদার
্যেষ্ঠ আইনীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
ফৌদারি কার্যবিধিতে কিছু ধারা আছে, যেগুলো মীমাংসাযোগ্য। আর কিছু ধারা আছে যেগুলো মীমাংসাযোগ্য নয়। মীমাংসাযোগ্য ধারাগুলো প্রকৃতিতে আবার দুই ধরনের—কিছু ধারার মামলা পক্ষ নি উদ্যোগে আদালতের অনুমতি ছাড়া পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সরাসরি মামলা মীমাংসা করতে পারে। মীমাংসা হওয়ার পর সেটা আদালতকে আনুষ্ঠানিকভাবে ানালেই বিষয়টি চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকরণে আদালত প্রয়োনীয় পদক্ষেপ নেবেন। আর কিছু ধারা আছে, যেখানে মামলার আপস-মীমাংসা করতে চাইলে আদালতের অনুমতি লাগে। আদালত অনুমতি দিলে ওই ধারার মামলাগুলো পক্ষ নিরো নিরোই মীমাংসা করে ফেলতে পারে, না দিলে পারে না। তবে আমাদের ফৌদারি বিচারব্যবস্থায় মামলা আপস-মীমাংসার সুযোগটা খুবই সীমিত। আর নি উদ্যোগে মামলা আপসের সুযোগ তো আরও কম। আমি মনে করি, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও মামলার ট কমাতে এ সুযোগ আরও বাড়ানো উচিত। সে ক্ষেত্রে আইন সংশোধন করে মীমাংসাযোগ্য ধারার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। ওই মীমাংসাযোগ্য ধারাগুলোকে ‘আদালতের অনুমতি সাপেক্ষ’ না করে মামলার পক্ষের নিদের উদ্যোগে মীমাংসার বিধান রাখতে হবে। আইনীবীদেরও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, ফৌদারি মামলায় যে আপসের বিধান আছে কিংবা কোন কোন মামলায় আপস করা যায়—এসব কিন্তু সাধারণ মানুষ ানে না। তাই নিরে মক্কেলকে আইনীবীদেরই ানাতে হবে, ‘আপনার মামলা আপনি চাইলে আপস করতে পারেন।’ ফৌদারি মামলায় আপস-মীমাংসা বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ন্য আইন কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে। ওই প্রস্তাব যত দ্রুত বাস্তবায়িত হয়, ততই বিচার বিভাগের ন্য মঙ্গল।
No comments