বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন করতে চায় আ.লীগ by টিপু সুলতান
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহাল নয়, বর্তমান সংবিধানের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার ব্যাপারে নীতিগতভাবে শক্ত অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি না এলে তাদের ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারের মধ্যে দৃঢ় অবস্থান রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
বিএনপিকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন মহাজোটের শরিক এরশাদের জাতীয় পার্টিকে (জাপা) সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে চায়। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি করা হতে পারে। বিএনপির একাধিক নেতাও এই আশঙ্কার কথা বলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এ জন্য বিএনপিকে আরও দুর্বল করতে বিভিন্ন মামলায় শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাবু করাসহ বিভিন্ন তৎপরতার ছক কষা হচ্ছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাজানো নির্বাচন করতে সরকারের নীলনকশার কথা আমরা জানি, এটা মোকাবিলা করার সামর্থ্য বিএনপির আছে।’
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন দেশের ভেতরেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পাবে না। আর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে কোনো দল বেশি দিন টিকতে পারবে না। বিএনপিও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ রকম নির্বাচন করে টিকতে পারেনি।
সরকার ঘনিষ্ঠ একাধিক মহল থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যে চিন্তা-পরিকল্পনা, তাতে আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে পুলিশ, বিডিআর, র্যাব, আনসার মোতায়েন করে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সে জন্য বিভাগ ধরে একাধিক দিনেও ভোট গ্রহণ করা হতে পারে। এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে আছে। এ ছাড়া সরকার আকস্মিক আগাম নির্বাচন দিতে পারে বলেও আলোচনা আছে। তবে আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দলের ভেতর কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা নাকচ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল। আওয়ামী লীগ চায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’
বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ, আগামী বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া তাঁর দল নির্বাচনে যাবে না। ওই নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। আর আওয়ামী লীগ বলছে, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে আসছেন, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা দেওয়া হবে না।
এই অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা; বরং সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন।
হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার: আওয়ামী লীগের নেতারা বরাবরই দাবি করে আসছেন, তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে, বর্তমান সংবিধানের আওতায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন করা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন যে অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলা হচ্ছে, প্রকারান্তরে তা দলীয় সরকারই হবে। আর তাতে প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই থাকবেন। তবে এমন আলোচনাও আছে, শেষ মুহূর্তে উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতির কারণে যদি শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে দলের ভেতর থেকেই কাউকে প্রধান করা হতে পারে। কিন্তু অনির্বাচিত কাউকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হবে না।
অবশ্য এর আগে বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব করেছেন, বিএনপি চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। বিএনপি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ রকম নির্বাচন জনগণ যাতে বর্জন করে, বিএনপি সর্বাত্মক সে চেষ্টাই করবে।
বিএনপিকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা: দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য সম্ভাব্য সব রকম কৌশল, চেষ্টা-তৎপরতা চালানো হবে। এরই অংশ হিসেবে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হতে পারে। মামলায় সাজা হলে এসব নেতা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন না। আবার বিএনপির একাংশকে চাপে ফেলে নির্বাচনে আনার চিন্তাও আছে ক্ষমতাসীন দলের।
সরকার বিএনপিকে ভাঙতে ষড়যন্ত্র করছে বলে কয়েক মাস আগে দলের পক্ষ থেকে অভিযোগও করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এই অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও সরকারের একটি সংস্থার মাধ্যমে বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষুব্ধ-বঞ্চিত নেতাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার হিংসাত্মকভাবে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাঁর দাবি, বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও হয়েছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের চেষ্টাও ব্যর্থ হবে।
আন্তর্জাতিক মহলের দিকে চেয়ে আছে বিএনপি: বিএনপির কেন্দ্রীয় আরেক নেতা জানান, তাঁরা মনে করছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। আর, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে এবং বিদেশিদের চাপে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হবে। মির্জা ফখরুলও এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁরা নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরবেন। বিএনপির অনেক নেতার বিশ্বাস, পশ্চিমা প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে একটা সমঝোতা হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, সমঝোতার সম্ভাবনা খুবই কম। পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশ্নে সরকারের সাম্প্রতিক যে ভূমিকা, তাতে নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বের চাপকে শেখ হাসিনা কতটা আমলে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ ছাড়া আন্দোলন করে দাবি আদায়ের মতো সাংগঠনিক সামর্থ্য বিএনপি এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি। তার ওপর দলটির নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাসসহ দলটির ভেতরে অনেক সংকট রয়েছে। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ব্যাপারে অনেক নেতার মধ্যে অস্বস্তি আছে। অনেকে সম্পত্তি রক্ষা ও মামলা থেকে বাঁচতে সরকারের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করতে পারেন।
জামায়াত নিয়ে সতর্কতা: এ ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে বিএনপির পর জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনো দলের উল্লেখ করার মতো সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ্য নেই। সরকারি মহলগুলো মনে করে, বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি দিলে মাঠে মারদাঙ্গা ভূমিকা রাখার মতো কিছু সামর্থ্য আছে জামায়াতের। তাই বর্তমান সরকার শুরু থেকেই জামায়াতকে চাপে রেখেছে। দলটিকে দুর্বল করতে কিছু কৌশল নিয়ে সরকারের ভেতরে চিন্তাভাবনা আছে। এমনিতে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় আটজন নেতা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি আছেন। এ সরকারের বাকি মেয়াদের মধ্যে তাঁদের মামলার বিচার শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর, এ বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপিও সতর্ক। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে সরাতে এসব মামলাকে পুঁজি করে সরকার কিছু কৌশল আঁটতে পারে বলে দল দুটির একাধিক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এরশাদ ও আ.লীগের একই লক্ষ্য: দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এরশাদের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে, যেভাবে হোক বিএনপিকে দুর্বল করতে হবে, ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না।
দল দুটির একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে এরশাদ জোটগতভাবে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি না গেলে এরশাদ আলাদা ভোট করবেন।
ঈদের আগ দিয়ে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এরশাদ এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন বলে তাঁর দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এরশাদ এ ব্যাপারে মিত্রদের সহযোগিতা চেয়েছেন। ভারত থেকে এসে তিনি আগামী নির্বাচনে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথাও বলেছেন। জাপার নেতারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে, তাদের সব ভোট জাপার বাক্সে পড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি বর্জন করলে নির্বাচন কত বেশি সুষ্ঠু করা যায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে সরকার। তাতে এরশাদের জাতীয় পার্টি কোনো কারণে বেশি আসন পেলে সেটাও আওয়ামী লীগ মেনে নেবে।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদ মনে করছেন, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এরশাদের দল জিতলে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আওয়ামী লীগও বড় গলায় বলতে পারবে, বিএনপি আসেনি, কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আর এরশাদ ক্ষমতায় যেতে পারলে তাঁর প্রধান লক্ষ্য হবে বিএনপিকে বিপর্যস্ত করে ফেলা, যাতে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। এরশাদ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে এ রকম একটা সমঝোতার কথা বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এরশাদের ভারত সফরের পর মূলত এ আলোচনা ডালপালা মেলেছে।
অবশ্য জাপার মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, দুই দলের শাসন দেশের মানুষ দেখেছে। এখন জনগণ এরশাদকে চায়। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তারাও চায় এ দেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে সেই নির্বাচন দেশের ভেতরেই শুধু নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃতি পাবে না। আর একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে কোনো দল বেশি দিন টিকতে পারবে না। বিএনপিও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ রকম নির্বাচন করে টিকতে পারেনি।
সরকার ঘনিষ্ঠ একাধিক মহল থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যে চিন্তা-পরিকল্পনা, তাতে আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে পুলিশ, বিডিআর, র্যাব, আনসার মোতায়েন করে যাতে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সে জন্য বিভাগ ধরে একাধিক দিনেও ভোট গ্রহণ করা হতে পারে। এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে আছে। এ ছাড়া সরকার আকস্মিক আগাম নির্বাচন দিতে পারে বলেও আলোচনা আছে। তবে আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দলের ভেতর কোনো আলোচনা হয়নি বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বিএনপি ছাড়া নির্বাচনের পরিকল্পনার কথা নাকচ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দল। আওয়ামী লীগ চায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন।’
বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন করতে হবে। অর্থাৎ, আগামী বছরের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী শক্ত অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া তাঁর দল নির্বাচনে যাবে না। ওই নির্বাচন হবে না, হতে দেওয়া হবে না। আর আওয়ামী লীগ বলছে, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে আসছেন, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তির কাছে ক্ষমতা দেওয়া হবে না।
এই অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা; বরং সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন।
হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার: আওয়ামী লীগের নেতারা বরাবরই দাবি করে আসছেন, তাঁদের লক্ষ্য হচ্ছে, বর্তমান সংবিধানের আওতায় অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন করা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সংবিধানের আলোকে নির্বাচনকালীন যে অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলা হচ্ছে, প্রকারান্তরে তা দলীয় সরকারই হবে। আর তাতে প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই থাকবেন। তবে এমন আলোচনাও আছে, শেষ মুহূর্তে উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতির কারণে যদি শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে দলের ভেতর থেকেই কাউকে প্রধান করা হতে পারে। কিন্তু অনির্বাচিত কাউকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হবে না।
অবশ্য এর আগে বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাব করেছেন, বিএনপি চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দিতে পারে। বিএনপি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো অবস্থাতেই বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এ রকম নির্বাচন জনগণ যাতে বর্জন করে, বিএনপি সর্বাত্মক সে চেষ্টাই করবে।
বিএনপিকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা: দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য সম্ভাব্য সব রকম কৌশল, চেষ্টা-তৎপরতা চালানো হবে। এরই অংশ হিসেবে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন নেতার বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হতে পারে। মামলায় সাজা হলে এসব নেতা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবেন না। আবার বিএনপির একাংশকে চাপে ফেলে নির্বাচনে আনার চিন্তাও আছে ক্ষমতাসীন দলের।
সরকার বিএনপিকে ভাঙতে ষড়যন্ত্র করছে বলে কয়েক মাস আগে দলের পক্ষ থেকে অভিযোগও করা হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক এই অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও সরকারের একটি সংস্থার মাধ্যমে বিএনপিতে নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষুব্ধ-বঞ্চিত নেতাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
মির্জা ফখরুল প্রথম আলোকে বলেন, সরকার হিংসাত্মকভাবে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাঁর দাবি, বিএনপিকে ধ্বংস করার চেষ্টা এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও হয়েছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান সরকারের চেষ্টাও ব্যর্থ হবে।
আন্তর্জাতিক মহলের দিকে চেয়ে আছে বিএনপি: বিএনপির কেন্দ্রীয় আরেক নেতা জানান, তাঁরা মনে করছেন, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। আর, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের মুখে এবং বিদেশিদের চাপে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হবে। মির্জা ফখরুলও এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাঁরা নির্দলীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরবেন। বিএনপির অনেক নেতার বিশ্বাস, পশ্চিমা প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নির্দলীয় সরকার প্রশ্নে একটা সমঝোতা হবে।
কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, সমঝোতার সম্ভাবনা খুবই কম। পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশ্নে সরকারের সাম্প্রতিক যে ভূমিকা, তাতে নির্বাচন প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্বের চাপকে শেখ হাসিনা কতটা আমলে নেবেন, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ ছাড়া আন্দোলন করে দাবি আদায়ের মতো সাংগঠনিক সামর্থ্য বিএনপি এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারেনি। তার ওপর দলটির নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাসসহ দলটির ভেতরে অনেক সংকট রয়েছে। দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের ব্যাপারে অনেক নেতার মধ্যে অস্বস্তি আছে। অনেকে সম্পত্তি রক্ষা ও মামলা থেকে বাঁচতে সরকারের সঙ্গে গোপনে সমঝোতা করতে পারেন।
জামায়াত নিয়ে সতর্কতা: এ ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটে বিএনপির পর জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনো দলের উল্লেখ করার মতো সাংগঠনিক শক্তি-সামর্থ্য নেই। সরকারি মহলগুলো মনে করে, বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি দিলে মাঠে মারদাঙ্গা ভূমিকা রাখার মতো কিছু সামর্থ্য আছে জামায়াতের। তাই বর্তমান সরকার শুরু থেকেই জামায়াতকে চাপে রেখেছে। দলটিকে দুর্বল করতে কিছু কৌশল নিয়ে সরকারের ভেতরে চিন্তাভাবনা আছে। এমনিতে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় আটজন নেতা একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি আছেন। এ সরকারের বাকি মেয়াদের মধ্যে তাঁদের মামলার বিচার শেষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর, এ বিচার শুরু হওয়ার পর জামায়াতের ব্যাপারে বিএনপিও সতর্ক। বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এ অবস্থায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট থেকে জামায়াতকে সরাতে এসব মামলাকে পুঁজি করে সরকার কিছু কৌশল আঁটতে পারে বলে দল দুটির একাধিক নেতা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এরশাদ ও আ.লীগের একই লক্ষ্য: দলীয় সূত্রগুলো জানায়, এরশাদের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে, যেভাবে হোক বিএনপিকে দুর্বল করতে হবে, ক্ষমতায় আসতে দেওয়া যাবে না।
দল দুটির একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিলে এরশাদ জোটগতভাবে নির্বাচন করবে। আর বিএনপি না গেলে এরশাদ আলাদা ভোট করবেন।
ঈদের আগ দিয়ে ভারত সফর শেষে দেশে ফিরে এরশাদ এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন বলে তাঁর দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এরশাদ এ ব্যাপারে মিত্রদের সহযোগিতা চেয়েছেন। ভারত থেকে এসে তিনি আগামী নির্বাচনে এককভাবে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথাও বলেছেন। জাপার নেতারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে, তাদের সব ভোট জাপার বাক্সে পড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিএনপি বর্জন করলে নির্বাচন কত বেশি সুষ্ঠু করা যায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবে সরকার। তাতে এরশাদের জাতীয় পার্টি কোনো কারণে বেশি আসন পেলে সেটাও আওয়ামী লীগ মেনে নেবে।
জাপার একাধিক সূত্র জানায়, এরশাদ মনে করছেন, বিএনপিবিহীন নির্বাচনে এরশাদের দল জিতলে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। আওয়ামী লীগও বড় গলায় বলতে পারবে, বিএনপি আসেনি, কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আর এরশাদ ক্ষমতায় যেতে পারলে তাঁর প্রধান লক্ষ্য হবে বিএনপিকে বিপর্যস্ত করে ফেলা, যাতে পরবর্তী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসতে পারে। এরশাদ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে এ রকম একটা সমঝোতার কথা বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। এরশাদের ভারত সফরের পর মূলত এ আলোচনা ডালপালা মেলেছে।
অবশ্য জাপার মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, দুই দলের শাসন দেশের মানুষ দেখেছে। এখন জনগণ এরশাদকে চায়। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তারাও চায় এ দেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক।
No comments