আল বিদা মাহে রমজান by অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক
পবিত্র ইসলাম ধর্মের কোন বিধানই কল্যাণ ও দর্শন থেকে খালি নয়। রমজানে মাসব্যাপী সিয়াম পালনের মাধ্যমে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে অফুরন্ত কল্যাণ ও বরকত লাভের অনুশীলন করে যাচ্ছি। মাহে রমজান আমাদের শুধু উপবাসের শিক্ষা দেয় না, এটি আনে আত্মার পরিগঠন।
একজন মানুষকে সঠিকভাবে নিষ্পাপ ও নির্মল জীবনের সন্ধান দেয় এ মাস। আর যদি তা রোজাদারের তনুমনে উপলব্ধি সৃষ্টি করতে না পারল তাহলে হাদীস মতে নিছক উপোস থাকাই সার হয়।
হুজুরে আকরাম (স) ইরশাদ করেছেন ‘এমন অনেক রোজাদার আছে যাদের রোজা নিছক ক্ষুধা পিপাসার নামান্তর। এদের ভুখা রাখা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নাই।’ রোজা অন্যান্য চরিত্র সৃষ্টির পাশাপাশি আামাদের জন্য নিয়ে এসেছে সহনশীলতার বার্তা। রমজান মাসের গোটা দর্শন জুড়েই ত্যাগ ও সহনশীলতার প্রাধান্য রয়েছে। রোজার এক অর্থ হলো মৌনতা অবলম্বন করা। আর এ মৌনতার মাঝেই সহনশীলতা, সমাজশান্তি ও স্থিতিশীলতার বাণী নিহিত। এ জন্য বলা হয়েছে ‘মান সাকাতা নাজা’Ñ ‘যে চুপ থাকতে পেরেছে সে নাজাত পেয়েছে।’ অনেক চুপ থাকার মাঝে যেমন শান্তি আত্মার ও ব্যক্তির, তেমনি মানুষের ও সমাজের। অতিকথা ও বাড়াবাড়ির মধ্য থেকে উৎপত্তি হয় সমস্ত অনভিপ্রেত ঘটনার। এর দ্বারা সমাজে সহানুভূতি ও সহনশীলতার বাণী উপেক্ষিত হয়। আরবরা তাই একটি সুন্দর কথা বলে থাকে Ñ‘সর্বোত্তম বাক্য হলো যা ছোট ও যৌক্তিক।’
মাহে রমজান এ সংযত আচরণ, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা ও ধৈর্যময় আচরণই শিক্ষা দেয়। রমজানের ই’তিক্বাফ পালনের পুরো ব্যবস্থাই একজন মুমিনের কথাবার্তা, কাজ-কাম ও লেনদেনে সংযত ও সহনশীলতার দিকে পুরোদমে নিয়ে যায়।
হযরত আবু বকর (রাদি) একদিন নিজের জিহ্বাকে টেনে ধরে বলেছেন, এটি থেকে নিজেকে সংবরণ কর। অর্থাৎ জিহ্বা বা মুখ গুণে মানুষ দুনিয়া আখিরাতে সম্মানিত হয় অথবা অপমানিত হয়। রমজানের গোটা মাসই যেন মৌনতা, সহনশীলতা ও ধৈর্যের। সূরা মরিয়মে সিয়াম অর্থ মৌনতাই নির্দেশ করা হয়েছে। আল্লাহ ঈসা জননী মরিয়মকে (আ) সম্বোধন করে বলেছেন, ‘যদি মানুষের মধ্যে কাউকে তুমি দেখ তবে বলে দিও আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে আজ সিয়াম মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কিছুতেই কারও সঙ্গে কথা বলব না।’ হাদীস শরীফে আছে প্রকৃত রোজাদার কখনও অশ্লীল কথা বলবেনা। বাড়াবাড়ি করবে না। আর যখনই কেউ গায়ে পড়ে তার সঙ্গে ঝগড়া লাগাতে আসে তখন সে যেন বলে, ‘আমি আজ তর্কাতর্কি করতে পারব না। আমি যে দয়াময়ের উদ্দেশ্যে রোজা রেখেছি, মৌনতা অবলম্বন করেছি।’ চরম বিশৃঙ্খলা ও ঝগড়া অবস্থায় একজন রোজাদারের এ ত্যাগী মনোভাব সমাজকে এক অনিন্দ-সুন্দর সহনশীলতার শিক্ষায় উজ্জীবিত করে। বাড়াবাড়ি পরিত্যাগের মাধ্যমেই সম্ভব স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি। আল কুরআন ও আল হাদীসে বারে বারে বাড়াবাড়িকে সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংসের বিষবাষ্প হিসেবে চিহ্নিত করে এ থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রমজান শেষ আর ক’দিন পরে ঈদ-উল-ফিতর আসবে এবং এ দিন পরস্পর পরস্পরকে আপন করে নেয়ার, ভেদাভেদ ও শত্রুতা ভুলে সবাইকে আলিঙ্গন করার যে শিক্ষা তাও মাহে রমজান থেকে নির্গত। ঈদের খুশি তো রোজাদারের জন্য। যারা রমজানকে সদ্ব্যবহার করেছে তাদের জন্য।
মাহে রমজান ও পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর দু’টোই যেন আল্লাহ আমাদের নাজাতের জারিয়া বানিয়ে দেন। আমিন।
No comments