আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন
১. আলবদর এখনও আছে গোলাম আযমের মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বহুদিন পর আলবদর প্রসঙ্গটি উঠে এল। আলবদর কী তা আমাদের জেনারেশনকে বোঝাতে হবে না। আলবদর মানেই নিষ্ঠুর মৃত্যুদূত। আমার শিক্ষকদের হত্যা করেছিল আলবদররা। এই একটি বাক্যই বলে দেয় আলবদরদের চরিত্র।
আমাদের অনেকের ধারণা, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর আলবদররা হয়তো ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে বা ভুল বুঝে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। এটা স্বাভাবিক যে, এদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত। গত শতকের আশির দশকে আলবদরদের পৃষ্ঠপোষক জেনারেল জিয়ার সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির [পূর্বতন ইসলামী ছাত্রসংঘ] যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি শুরু করে তখন তারা নতুন একটি বিষয়ের সূত্রপাত করে, তা হল রগকাটা। এরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরে পায়ের রগ কেটে দিত। এই যে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার চেষ্টা এটাই বাংলাদেশে রগকাটা রাজনীতি হিসেবে পরিচিত। তখন আমাদের অনেকের ধারণা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের তরুণ আলবদররা নতুন এই জেনারেশনকে শিবিরের মাধ্যমে এই টেকনিক শিক্ষা দিয়েছিল।
সেই সময় যারা আলবদরের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা এখন আমাদেরই বয়সী, ষাটোর্ধ্ব। এরা নিষ্ক্রিয় নয়। এরা সক্রিয় এবং তাদের আলবদরীয় আদর্শ তারা জামায়াত-শিবিরের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। জামায়াত-শিবির এখন আলবদরদের প্রকাশ্য ফ্রন্ট। এই ধারণা দৃঢ় হওয়ার একটি কারণ, পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত একটি বই ‘আলবদর’।
শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানে যখন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন তখন এই বইটি নিয়ে আসেন। উর্দুতে বইটি লিখেছেন সেলিম মনসুর খালেদ। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন পরিচিত জমিয়তে তুলাবা পাকিস্তান নামে। তাদের প্রকাশনা ‘তালাবা’ বইটি প্রকাশ করে খুব সম্ভব ২০০৩ সালের পর।
শাহরিয়ার যে বইটি এনেছেন তা চতুর্দশ মুদ্রণ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইটির মুদ্রণ সংখ্যা ১৩,৭০০।
মনসুর ২০০২ সালে ঢাকায় আসেন। খুবই স্বাভাবিক। জামায়াতে ইসলামী তখন ক্ষমতায়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে জামায়াত কখনই কাক্সিক্ষত ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া তাদের ক্ষমতায় আনেন। এদিক থেকে বিচার করলে, বেগম জিয়াও বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন।
মনসুরের বই পড়েই জানতে পারি আলবদররা এখনও বেঁচেবর্তে ভালোই আছে। তাদের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি। মনসুর ঢাকায় এসে আলবদরের সাহায্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। একজন আলবদর আফসোস করে তাকে বলেছে, ‘জাতি এ আত্মত্যাগীদের স্বীকার পর্যন্ত করে না। মুসলিম উম্মাহ এর মর্যাদা বোঝেননি। আমরা ঘরের মধ্যে [বাংলাদেশে] আগন্তুক, আর পাকিস্তানে ভিনদেশী।’
মনসুরকে বিভিন্ন আলবদরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আলবদরদের নেতা বা সুপ্রিম কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী তখন মন্ত্রী, ফলে পুরনো আলবদরদের নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে তোলা হয় এবং তিনি (মনসুর) অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন। মনসুর স্থানীয় অনেক আলবদরের নাম উল্লেখ করেছেন। এগুলো ছদ্মনাম কিনা জানি না, তবে কিছু নামের সঙ্গে আমরা পরিচিত। আলবদর গঠন প্রক্রিয়া থেকে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে তার বইয়ে। কোথাও কোথাও তথ্যে গরমিল থাকলেও আলবদরদের কার্যকলাপ তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তারা মনে করেন, আলবদররা জিহাদী। যেসব আলবদর মারা গেছে তারা শহীদ, যারা বেঁচে আছে তারা গাজী। আর মুক্তিযোদ্ধারা এখনও তাদের কাছে ‘দুষ্কৃতকারী’।
মনসুর ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে আলবদরীয় ঘটনাগুলো উল্লেখ করতে চান, যাতে নতুন কর্মীরা একনিষ্ঠভাবে জামায়াত করতে এবং আলবদর হতে উদ্বুদ্ধ হয়। তার আফসোস, “১৯৭১ সালের এসব শহীদ ও গাজীর নাম পাকিস্তানে আলোচনা করা কেউ পছন্দ করে না। এরা তো আমাদেরই ছিলেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ বনানী ও নদ-নদীতে বুকের তাজা রক্ত উপহার দিয়েছেন। সেই তরুণরা আমাদের জাতীয় সত্তারই তো অংশ ছিল।”
মনসুর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “বাংলার সাংবাদিক, আইনবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতিক মহলের সঙ্গে বিস্তারিত দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। এর ফলে আলবদরের লক্ষ্যসমূহ আরও নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। এছাড়াও আলবদরের মুজাহিদদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।”
সুতরাং ধরে নেয়া যায়, আমার, আপনার আশপাশেই আলবদর ও তার সাথীরা অপেক্ষা করছে। তারা ভাবেনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। তাই এখন তারা খানিকটা শঙ্কার মধ্যে আছে এবং তাই এই বিচার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের শৈথিল্য তাদের এ সুযোগ করে দিচ্ছে। তারা শুধু অপেক্ষা করছে সরকার পতনের বা বিচার বানচালের। তারপরই আপনারা আপনাদের দোরগোড়ায় তাদেরকে দেখতে পাবেন।
২. মুক্তিযুদ্ধ কী?
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ছিল জামায়াত বা আলবদরদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মনসুরের বইতে এ বিষয়টিই উঠে এসেছে।
‘আলবদর’ গ্রন্থের প্রায় অর্ধেক ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ অব্দি ঘটনা প্রবাহের বিবরণ। আমরা ভালোভাবেই জানি তখন কী ঘটেছিল, কিন্তু আলবদরদের ভাষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমাদের সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে পূর্বধারণা ছিল, আলবদরদের ধারণাও অবিকল একই রকম। মূল থিসিসটা এ রকম যে, বাঙালিরা সম্পূর্ণ মুসলমান নয়। তারা হিন্দুÑ ভারত দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালি মুসলমান হল তারা, যারা মুসলিম লীগ বা জামায়াত সমর্থক এবং যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ‘হিজরত করে পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছে’Ñ তারাই ‘সাচ্চা পাকিস্তানি বাঙালি।’
মনসুর মনে করেন, বাঙালিরা মূর্তিপূজক। বাংলাদেশের ‘লোকেরা উর্দু মানে না, আর বাংলা ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যের অভাব এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক সমাজতন্ত্র’ প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুধু তাই নয়, ‘মনের দিক থেকে বাঙালি মুসলমান তরুণ ও হিন্দু তরুণদের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল না।’
যেসব মেয়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে তারাও ছিল হিন্দু মেয়েদের মতো।
বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনাকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী মনে করতেন, বাঙালিদের ওপর ছিল হিন্দু শিক্ষকদের প্রভাব। সে কারণে তারা হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে গিয়েছিল। আলবদর-সমর্থক মনসুরও তাই মনে করেন।
আওয়ামী লীগের কারণে, জানিয়েছেন মনসুর, বাঙালিরা মনে করতে লাগল যে, রামমোহন রায় তাদের ‘জাতীয় বীর’ আর ‘হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্জন্মদাতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে গেলেন ‘জাতীয় কবি’। অর্থাৎ লড়াইটা ছিল মূলত ‘সাচ্চা মুসলমান’ পাকিস্তানিদের সঙ্গে ভারতের এজেন্ট হিন্দুভাবাপন্ন বাঙালিদের।
পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে মনসুর উল্লেখ করেছেন, বাঙালিরা বিহারি ‘হত্যা’ শুরু করে। আলবদররা তাই মনে করে। তবে, অসতর্ক মুহূর্তে মনসুর উল্লেখ করেছেন টিক্কা খানের বরাত দিয়ে যে, ইয়াহিয়া খান স্বীকার করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি এ্যাকশনের প্রস্তাব ভুট্টো তাকে দিয়েছিলেন।
ভারত তো জন্ম থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল। মনসুরের ভাষায়, ১৯৬৮ সাল থেকেই পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য ‘এজেন্টদের’ ভারত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছিল। ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ১৯৭১ সালের শুরুতে ‘খোলামেলাভাবে তারা কাজ শুরু করে দেয়।’
আলবদররা মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে যেসব তথ্য যোগাড় করেছিল সে অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর ছয়টি সংগঠন ছিল
১. মুক্তিবাহিনী (সাবেক ফৌজ, পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও হিন্দুস্তান আর্মির রেগুলার এজেন্ট)
২. মুজিব বাহিনী (আওয়ামী লীগের বাঙালি, হিন্দু ও কমিউনিস্ট)
৩. আর্মড গ্রুপ ও
৪. গুজব রটনাকারী গ্রুপ।
এছাড়া আরো দুটি শাখা ছিল মুক্তিবাহিনীর
১. মহিলা মুক্তি গ্রুপ ও
২. সায়েন্টিফিক গ্রুপ।
এবার মহিলা মুক্তি গ্রুপ সম্পর্কে আলবদরীয় ব্যাখ্যা শুনুন
“এর বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। এরা আওয়ামী লীগ সমর্থন করত। এদের কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সহজ করার জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্যকারীদের কয়েক মুহূর্তের জন্য আত্মভোলা করে রাখার জন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল।” মনসুর যা বলতে চাচ্ছেন, তা হল, এরা পাকিস্তানিদের ভুলিয়েভালিয়ে গোপন তথ্য উদ্ধার করত। তার ভাষায়, প্রাচীন আমল থেকেই “প্রস্টিটিউশন এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ও মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থেকে তৃতীয় শ্রেণির লোকদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় গোপন তথ্য উদ্ধার ও অতর্কিত শিকার করার চেষ্টায় থাকত।”
আর সায়েন্টিফিক গ্রুপ? এরা বিজ্ঞানের ছাত্র। সীমান্তে হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের সাহায্যে এরা “এমন ধ্বংসাত্মক যন্ত্রচালিত জিনিস তৈরি করত, যেগুলো ধ্বংসের সাথে সাথে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত।”
তার মতে, মুক্তিবাহিনী আসলে রাজনৈতিক কর্মী বা বাঙালিদের কোনো সংগঠন ছিল না। ভারতীয় সৈনিক, রুশ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-সমর্থক তরুণ, আরএসএস প্রভৃতি ‘সমন্বিত বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী।’
যুদ্ধের খুব একটা বর্ণনা দেননি মনসুর। উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানিদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরনো আমলের। পুরনো আমালের কিছু বিমান ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল নষ্ট; আর ভারতীয় বিমান বাকিগুলো ধ্বংস করে দেয়। তবে, পাকিস্তানি এন্টি এয়ারক্রাফট ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩০টি বিমান ভূপাতিত করে। এটি আবার এক পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকীর মত। অথচ আমরা জানি, এখানে একটি ভারতীয় বিমানও ভূপাতিত করা যায়নি। মনসুর জানিয়েছেন, “আমাদের এই প্রতিরক্ষা পুঁজিতে ৭৩ হাজার রাজাকার, স্কাউট প্রভৃতি নিয়ে সেনা টিম মোতায়েন ছিল।”
এই ইতিহাস পড়ে বোঝা যায়, পাকিস্তানি মন কীভাবে কাজ করে এবং ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা কী। শাহরিয়ার কবির আমাকে জানিয়েছেন, পাকিস্তানে এখন ইতিহাস পড়ানো হয় না। এর একটা কারণ বোধহয়, নিজেদের মনমতো ইতিহাস সৃষ্টি করা। ইতিহাস না জানলে একটি জাতি কী রকম সংকীর্ণ, সাম্প্রদায়িক, উগ্র জঙ্গিবাদী ও বিকৃত মনের অধিকারী হতে পারে পাকিস্তানিরা তার উদাহরণ। দুঃখের বিষয়, এই আমলেও শত চেষ্টা করেও আমরা সব শাখায় ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরাও কি পাকিস্তানি হয়ে যাব? বিএনপি-জামায়াত ও ধর্মব্যবসায়ীদের উত্থান এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করছে।
মনসুরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে জামায়াতের ৭৩ হাজার সশস্ত্র কর্মী ছিল। এ সংখ্যা ৬৫ও করা যেতে পারে; কারণ, রাজাকার-আলবদরদের মধ্যে জামায়াত ছাড়াও উগ্রবাদী এবং অবাঙালি ছিল।
৩. আলবদর কেন প্রতিষ্ঠা করা হলো
আলবদর কেন প্রতিষ্ঠা করা হল, কীভাবে হল, সে সম্পর্কে তথ্য কিন্তু খুব কম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা শুনেছি, জানতাম, ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা প্রতিষ্ঠা করেছে আলবদর এবং তারা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করছে। ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আলবদরদের প্রধানও ছিলেন তিনি।
একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়Ñ বইতেই আলবদর সম্পর্কে যে তথ্য আছে সে তথ্যই এতদিন ব্যবহৃত হত। এখন এর সঙ্গে আরো কিছু সূত্রের সাহায্যে আলবদরদের সম্পর্কে একটি বিবরণ তৈরি করেছি।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই মোটামুটি রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা বুঝতে পারছিলেন, দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে জামায়াতে আলোচনা শুরু হয় এবং করণীয় ঠিক করে জামায়াত নয়, বরং জামায়াতের সংগঠন ইসলাম জামায়াত ই তুলাবা, এখানে যা পরিচিত ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে।
সৈয়দ ভালি রেজা নসর পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো নিয়ে গবেষণা করে একটি বই লিখেছেন, নাম দি ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রিভ্যুলেশন : দি জামায়াত ই ইসলামী অব পাকিস্তান। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস বইটি প্রকাশ করে ১৯৯৪ সালে।
নসর লিখেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ পাকিস্তানের কোনো অংশেই তাদের কোনো স্থান ছিল না। সরকারি সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা পিপিপির বিরুদ্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জামায়াত দেখল, জাতীয় রাজনীতিতে স্থান করে নিতে হলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করাই উত্তম। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছিল ইসলামী জমিয়ত তুলাবাÑ মে মাসে যখন তারা সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে লাগল।
অন্য কথায় বলা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য জামায়াত ও তার সংগঠন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ, আমরা দেখি, মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকাতে যেসব সংস্থা গড়ে উঠেছিলÑ যেমন : রাজাকার, শান্তি কমিটি বা আলবদরÑ সবখানে সর্বতোভাবে যোগ দিয়েছিল জামায়াত ও ছাত্রসংঘের কর্মীরা। অবশ্য, সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর প্রকাশ শুরু করার অর্থ দিয়েছিল আইএসআই। বাংলাদেশ হওয়ার পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান প্রথম সেনাবাহিনীর পাকিস্তানিকরণ শুরু করেন, যা পরে এগিয়ে নেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাকিস্তানের পলিসি সব পর্যায়ে সুচারুরূপে প্রয়োগের জন্য জেনারেল জিয়াউল হক খুশি হয়ে তাকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিশান-ই পাকিস্তান’ প্রদান করেছিলেন। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ২৬ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট কার্যকর করা হয় এবং রংপুরে এরশাদ এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তানিকরণের কারণেই জিয়াউর রহমান জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং মন্ত্রিসভায় রাজাকারদের অন্তর্ভুক্ত করেন। একই পলিসি অনুসরণ করেন এরশাদ। পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া তাদের ক্ষমতার অংশীদার করেন, যা পাকিস্তানেও সম্ভব হয়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শুরু থেকেই জামায়াত প্রধানত সামরিক বাহিনীর সহায়তায় শক্তি সঞ্চয় করেছে। একটি বিষয় খেয়াল করবেন, বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখন কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ও সেক্যুলার আদর্শে বিশ্বাসীদের গ্রেফতার করেছে, নির্যাতন করেছে, জামায়াতীদের নয়।
নসরের বক্তব্যের সমর্থন পাই খালেদের গ্রন্থেও। তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার জন্য ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক মজলিসে শূরা ও জেলা নাজেমদের এক বৈঠক আহ্বান করা হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি আলোচনার পর তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনটি বিকল্প খোলা আছেÑ
১. ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ যা করছে তা সমর্থন
২. যা হবার হোক, নিজেদের সরিয়ে রাখা
৩. পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, যাতে পাকিস্তানের অখ-তা অক্ষুণœ থাকে এবং এ কারণে নিজের দায়িত্ব পালন করা।
এই সভায় প্রাদেশিক শূরার রোকন মুস্তাফা শওকত ইমরান এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন যার মূলকথা হল, পাকিস্তনের এই অংশকে ‘হেফাজত’ করতে হবে যেভাবে মসজিদ ‘হেফাজত’ করা হয়। একজনও ‘বিচ্ছিন্নতা’বাদীদের সমর্থন করেনি। চারদিন এই বৈঠক হয়। ঐকমত্যের যে সিদ্ধান্ত হয় তাহল, এখানকার জনগণ দুটি শক্তির মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে। একদিকে রয়েছে ‘দুঃশাসন’ [অর্থাৎ ভারত] নিয়োজিত হিন্দু ও কমিউনিস্ট, যারা দেশকে টুকরো টুকরো করে হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দিতে চায়। অন্যদিকে, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে এদের মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন। সুতরাং কী করতে হবে? এই দু’পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। “আমরা একদিকে ইসলামী শক্তি নিয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে ময়দানে সংঘাতে অবতীর্ণ হব; অন্যদিকে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে তা সংশোধনে; জন্য আমাদের মতো করে চেষ্টা করব।”
এরপর ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের এক বৈঠক হয়। সেখানে ঢাকা জামায়াতের নাজেম শাহ জালাল চৌধুরী তাদের পলিসি ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, কোনো সার্কুলার জারি করা যাবে না, কারণ ‘তা হবে মৃত্যুকে আহ্বান করার শামিল।’ এ সিদ্ধান্তটি উল্লেখযোগ্য। জামায়াত যে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তর্গত হয়ে কাজ করেছিল বা বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করেছিল সে সম্পর্কে তারা কাগজে-কলমে খুব কম প্রমাণ রেখেছে। এ বিষয়ে তারা খুব সর্তক ছিল। তাদের কার্যকলাপের প্রধান প্রমাণ তাই তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রাদেশিক শূরার চারজন সদস্য সারা ‘পূর্ব পাকিস্তান সফর’ করে তাদের পলিসি কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। ১৫ ও ১৬ মার্চ চারজন সফর শুরু করলেন। কর্মীদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানালেন। খালেদ লিখেছেন, “এই সফরে কর্মীসমাবেশে ফি আমানিল্লাহ বলা হত। আল্লাহ্র দরবারে আহাজারি করে ইসলাম ও পাকিস্তানের অক্ষুণœতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হত। দোয়া নিয়ে সাথীরা পরস্পরের নিকট থেকে এমনভাবে বিদায় নিত যেন আর কখনো এই দুনিয়ায় পরস্পরের দেখা হবে না।”
ছাত্রসংঘ তৃতীয় বিকল্প বেছে নিয়েছিল অর্থাৎ হিন্দুস্তানের অনুচরদের হাত থেকে পাকিস্তান রক্ষা। এবং পাকিস্তান রক্ষার জন্য কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানি শাসক অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সর্বত্র প্রচার করা যে, পাকিস্তানকে হেফাজত করাই মূল কাজ। এ কারণেই গণহত্যা শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে জামায়াতের আমির গোলাম আযম সদলে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। এবং শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আলশামসে জামায়াত ও ছাত্র সংঘ-কর্মীরা দলে দলে যোগদান করে।
এটি ছিল প্রকাশ্য দিক। অপ্রকাশ্য পলিসি ছিল অন্য। তারা ধরে নিয়েছিল, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ ও বামধারার দলগুলোকে দমন করে ফেলবে। দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেবে। পাকিস্তানপন্থী দলগুলো তখন সুযোগ পাবে সেই শূন্যতা ভরাট করার। সেনাবাহিনী যদি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে জামায়াত হয়ে উঠবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজা হয়ে যাবে তারা। অন্যদিকে রাজকার, শান্তি কমিটির সদস্য এবং আলবদর হয়ে পাকিস্তান রক্ষার নামে বিরোধীদের নিঃশেষ করে দিতে পারবে। (চলবে)
সেই সময় যারা আলবদরের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা এখন আমাদেরই বয়সী, ষাটোর্ধ্ব। এরা নিষ্ক্রিয় নয়। এরা সক্রিয় এবং তাদের আলবদরীয় আদর্শ তারা জামায়াত-শিবিরের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। জামায়াত-শিবির এখন আলবদরদের প্রকাশ্য ফ্রন্ট। এই ধারণা দৃঢ় হওয়ার একটি কারণ, পাকিস্তানের লাহোর থেকে প্রকাশিত একটি বই ‘আলবদর’।
শাহরিয়ার কবির পাকিস্তানে যখন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন তখন এই বইটি নিয়ে আসেন। উর্দুতে বইটি লিখেছেন সেলিম মনসুর খালেদ। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন পরিচিত জমিয়তে তুলাবা পাকিস্তান নামে। তাদের প্রকাশনা ‘তালাবা’ বইটি প্রকাশ করে খুব সম্ভব ২০০৩ সালের পর।
শাহরিয়ার যে বইটি এনেছেন তা চতুর্দশ মুদ্রণ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইটির মুদ্রণ সংখ্যা ১৩,৭০০।
মনসুর ২০০২ সালে ঢাকায় আসেন। খুবই স্বাভাবিক। জামায়াতে ইসলামী তখন ক্ষমতায়। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে জামায়াত কখনই কাক্সিক্ষত ক্ষমতার স্বাদ পায়নি। বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি হওয়া সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়া তাদের ক্ষমতায় আনেন। এদিক থেকে বিচার করলে, বেগম জিয়াও বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন।
মনসুরের বই পড়েই জানতে পারি আলবদররা এখনও বেঁচেবর্তে ভালোই আছে। তাদের আদর্শ থেকে তারা বিচ্যুত হয়নি। মনসুর ঢাকায় এসে আলবদরের সাহায্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। একজন আলবদর আফসোস করে তাকে বলেছে, ‘জাতি এ আত্মত্যাগীদের স্বীকার পর্যন্ত করে না। মুসলিম উম্মাহ এর মর্যাদা বোঝেননি। আমরা ঘরের মধ্যে [বাংলাদেশে] আগন্তুক, আর পাকিস্তানে ভিনদেশী।’
মনসুরকে বিভিন্ন আলবদরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। আলবদরদের নেতা বা সুপ্রিম কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী তখন মন্ত্রী, ফলে পুরনো আলবদরদের নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে তোলা হয় এবং তিনি (মনসুর) অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন। মনসুর স্থানীয় অনেক আলবদরের নাম উল্লেখ করেছেন। এগুলো ছদ্মনাম কিনা জানি না, তবে কিছু নামের সঙ্গে আমরা পরিচিত। আলবদর গঠন প্রক্রিয়া থেকে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য আছে তার বইয়ে। কোথাও কোথাও তথ্যে গরমিল থাকলেও আলবদরদের কার্যকলাপ তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তারা মনে করেন, আলবদররা জিহাদী। যেসব আলবদর মারা গেছে তারা শহীদ, যারা বেঁচে আছে তারা গাজী। আর মুক্তিযোদ্ধারা এখনও তাদের কাছে ‘দুষ্কৃতকারী’।
মনসুর ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে আলবদরীয় ঘটনাগুলো উল্লেখ করতে চান, যাতে নতুন কর্মীরা একনিষ্ঠভাবে জামায়াত করতে এবং আলবদর হতে উদ্বুদ্ধ হয়। তার আফসোস, “১৯৭১ সালের এসব শহীদ ও গাজীর নাম পাকিস্তানে আলোচনা করা কেউ পছন্দ করে না। এরা তো আমাদেরই ছিলেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ বনানী ও নদ-নদীতে বুকের তাজা রক্ত উপহার দিয়েছেন। সেই তরুণরা আমাদের জাতীয় সত্তারই তো অংশ ছিল।”
মনসুর স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, “বাংলার সাংবাদিক, আইনবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনীতিক মহলের সঙ্গে বিস্তারিত দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। এর ফলে আলবদরের লক্ষ্যসমূহ আরও নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। এছাড়াও আলবদরের মুজাহিদদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।”
সুতরাং ধরে নেয়া যায়, আমার, আপনার আশপাশেই আলবদর ও তার সাথীরা অপেক্ষা করছে। তারা ভাবেনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। তাই এখন তারা খানিকটা শঙ্কার মধ্যে আছে এবং তাই এই বিচার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য নানা ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের শৈথিল্য তাদের এ সুযোগ করে দিচ্ছে। তারা শুধু অপেক্ষা করছে সরকার পতনের বা বিচার বানচালের। তারপরই আপনারা আপনাদের দোরগোড়ায় তাদেরকে দেখতে পাবেন।
২. মুক্তিযুদ্ধ কী?
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ছিল জামায়াত বা আলবদরদের ‘মুক্তিযুদ্ধ’। মনসুরের বইতে এ বিষয়টিই উঠে এসেছে।
‘আলবদর’ গ্রন্থের প্রায় অর্ধেক ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সালের মার্চ অব্দি ঘটনা প্রবাহের বিবরণ। আমরা ভালোভাবেই জানি তখন কী ঘটেছিল, কিন্তু আলবদরদের ভাষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আমাদের সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে পূর্বধারণা ছিল, আলবদরদের ধারণাও অবিকল একই রকম। মূল থিসিসটা এ রকম যে, বাঙালিরা সম্পূর্ণ মুসলমান নয়। তারা হিন্দুÑ ভারত দ্বারা প্রভাবিত। বাঙালি মুসলমান হল তারা, যারা মুসলিম লীগ বা জামায়াত সমর্থক এবং যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ‘হিজরত করে পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছে’Ñ তারাই ‘সাচ্চা পাকিস্তানি বাঙালি।’
মনসুর মনে করেন, বাঙালিরা মূর্তিপূজক। বাংলাদেশের ‘লোকেরা উর্দু মানে না, আর বাংলা ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যের অভাব এবং হিন্দু সাংস্কৃতিক সমাজতন্ত্র’ প্রভাব বিস্তার করে আছে। শুধু তাই নয়, ‘মনের দিক থেকে বাঙালি মুসলমান তরুণ ও হিন্দু তরুণদের মধ্যে আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল না।’
যেসব মেয়ে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে তারাও ছিল হিন্দু মেয়েদের মতো।
বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনাকারী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী মনে করতেন, বাঙালিদের ওপর ছিল হিন্দু শিক্ষকদের প্রভাব। সে কারণে তারা হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে গিয়েছিল। আলবদর-সমর্থক মনসুরও তাই মনে করেন।
আওয়ামী লীগের কারণে, জানিয়েছেন মনসুর, বাঙালিরা মনে করতে লাগল যে, রামমোহন রায় তাদের ‘জাতীয় বীর’ আর ‘হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্জন্মদাতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে গেলেন ‘জাতীয় কবি’। অর্থাৎ লড়াইটা ছিল মূলত ‘সাচ্চা মুসলমান’ পাকিস্তানিদের সঙ্গে ভারতের এজেন্ট হিন্দুভাবাপন্ন বাঙালিদের।
পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে মনসুর উল্লেখ করেছেন, বাঙালিরা বিহারি ‘হত্যা’ শুরু করে। আলবদররা তাই মনে করে। তবে, অসতর্ক মুহূর্তে মনসুর উল্লেখ করেছেন টিক্কা খানের বরাত দিয়ে যে, ইয়াহিয়া খান স্বীকার করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের আর্মি এ্যাকশনের প্রস্তাব ভুট্টো তাকে দিয়েছিলেন।
ভারত তো জন্ম থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল। মনসুরের ভাষায়, ১৯৬৮ সাল থেকেই পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য ‘এজেন্টদের’ ভারত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেছিল। ১৯৭০ সালের শেষ থেকে ১৯৭১ সালের শুরুতে ‘খোলামেলাভাবে তারা কাজ শুরু করে দেয়।’
আলবদররা মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে যেসব তথ্য যোগাড় করেছিল সে অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর ছয়টি সংগঠন ছিল
১. মুক্তিবাহিনী (সাবেক ফৌজ, পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও হিন্দুস্তান আর্মির রেগুলার এজেন্ট)
২. মুজিব বাহিনী (আওয়ামী লীগের বাঙালি, হিন্দু ও কমিউনিস্ট)
৩. আর্মড গ্রুপ ও
৪. গুজব রটনাকারী গ্রুপ।
এছাড়া আরো দুটি শাখা ছিল মুক্তিবাহিনীর
১. মহিলা মুক্তি গ্রুপ ও
২. সায়েন্টিফিক গ্রুপ।
এবার মহিলা মুক্তি গ্রুপ সম্পর্কে আলবদরীয় ব্যাখ্যা শুনুন
“এর বেশিরভাগ ছিল হিন্দু। এরা আওয়ামী লীগ সমর্থন করত। এদের কাজ ছিল মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা সহজ করার জন্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহায্যকারীদের কয়েক মুহূর্তের জন্য আত্মভোলা করে রাখার জন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল।” মনসুর যা বলতে চাচ্ছেন, তা হল, এরা পাকিস্তানিদের ভুলিয়েভালিয়ে গোপন তথ্য উদ্ধার করত। তার ভাষায়, প্রাচীন আমল থেকেই “প্রস্টিটিউশন এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ও মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থেকে তৃতীয় শ্রেণির লোকদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় গোপন তথ্য উদ্ধার ও অতর্কিত শিকার করার চেষ্টায় থাকত।”
আর সায়েন্টিফিক গ্রুপ? এরা বিজ্ঞানের ছাত্র। সীমান্তে হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের সাহায্যে এরা “এমন ধ্বংসাত্মক যন্ত্রচালিত জিনিস তৈরি করত, যেগুলো ধ্বংসের সাথে সাথে আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত।”
তার মতে, মুক্তিবাহিনী আসলে রাজনৈতিক কর্মী বা বাঙালিদের কোনো সংগঠন ছিল না। ভারতীয় সৈনিক, রুশ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টি-সমর্থক তরুণ, আরএসএস প্রভৃতি ‘সমন্বিত বাহিনীর নাম ছিল মুক্তিবাহিনী।’
যুদ্ধের খুব একটা বর্ণনা দেননি মনসুর। উল্লেখ করেছেন, পাকিস্তানিদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল পুরনো আমলের। পুরনো আমালের কিছু বিমান ছিল, যার মধ্যে একটি ছিল নষ্ট; আর ভারতীয় বিমান বাকিগুলো ধ্বংস করে দেয়। তবে, পাকিস্তানি এন্টি এয়ারক্রাফট ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩০টি বিমান ভূপাতিত করে। এটি আবার এক পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকীর মত। অথচ আমরা জানি, এখানে একটি ভারতীয় বিমানও ভূপাতিত করা যায়নি। মনসুর জানিয়েছেন, “আমাদের এই প্রতিরক্ষা পুঁজিতে ৭৩ হাজার রাজাকার, স্কাউট প্রভৃতি নিয়ে সেনা টিম মোতায়েন ছিল।”
এই ইতিহাস পড়ে বোঝা যায়, পাকিস্তানি মন কীভাবে কাজ করে এবং ইতিহাস সম্পর্কে তাদের ধারণা কী। শাহরিয়ার কবির আমাকে জানিয়েছেন, পাকিস্তানে এখন ইতিহাস পড়ানো হয় না। এর একটা কারণ বোধহয়, নিজেদের মনমতো ইতিহাস সৃষ্টি করা। ইতিহাস না জানলে একটি জাতি কী রকম সংকীর্ণ, সাম্প্রদায়িক, উগ্র জঙ্গিবাদী ও বিকৃত মনের অধিকারী হতে পারে পাকিস্তানিরা তার উদাহরণ। দুঃখের বিষয়, এই আমলেও শত চেষ্টা করেও আমরা সব শাখায় ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরাও কি পাকিস্তানি হয়ে যাব? বিএনপি-জামায়াত ও ধর্মব্যবসায়ীদের উত্থান এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করছে।
মনসুরের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে জামায়াতের ৭৩ হাজার সশস্ত্র কর্মী ছিল। এ সংখ্যা ৬৫ও করা যেতে পারে; কারণ, রাজাকার-আলবদরদের মধ্যে জামায়াত ছাড়াও উগ্রবাদী এবং অবাঙালি ছিল।
৩. আলবদর কেন প্রতিষ্ঠা করা হলো
আলবদর কেন প্রতিষ্ঠা করা হল, কীভাবে হল, সে সম্পর্কে তথ্য কিন্তু খুব কম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা শুনেছি, জানতাম, ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীরা প্রতিষ্ঠা করেছে আলবদর এবং তারা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের হত্যা করছে। ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আলবদরদের প্রধানও ছিলেন তিনি।
একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়Ñ বইতেই আলবদর সম্পর্কে যে তথ্য আছে সে তথ্যই এতদিন ব্যবহৃত হত। এখন এর সঙ্গে আরো কিছু সূত্রের সাহায্যে আলবদরদের সম্পর্কে একটি বিবরণ তৈরি করেছি।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই মোটামুটি রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা বুঝতে পারছিলেন, দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে জামায়াতে আলোচনা শুরু হয় এবং করণীয় ঠিক করে জামায়াত নয়, বরং জামায়াতের সংগঠন ইসলাম জামায়াত ই তুলাবা, এখানে যা পরিচিত ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ নামে।
সৈয়দ ভালি রেজা নসর পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো নিয়ে গবেষণা করে একটি বই লিখেছেন, নাম দি ভ্যানগার্ড অব দি ইসলামিক রিভ্যুলেশন : দি জামায়াত ই ইসলামী অব পাকিস্তান। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস বইটি প্রকাশ করে ১৯৯৪ সালে।
নসর লিখেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে দাঁড়ায়, কারণ পাকিস্তানের কোনো অংশেই তাদের কোনো স্থান ছিল না। সরকারি সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানে তারা পিপিপির বিরুদ্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিল। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জামায়াত দেখল, জাতীয় রাজনীতিতে স্থান করে নিতে হলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করাই উত্তম। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছিল ইসলামী জমিয়ত তুলাবাÑ মে মাসে যখন তারা সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতে লাগল।
অন্য কথায় বলা যেতে পারে, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে নিজের জায়গা করে নেওয়ার জন্য জামায়াত ও তার সংগঠন সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। কারণ, আমরা দেখি, মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেকাতে যেসব সংস্থা গড়ে উঠেছিলÑ যেমন : রাজাকার, শান্তি কমিটি বা আলবদরÑ সবখানে সর্বতোভাবে যোগ দিয়েছিল জামায়াত ও ছাত্রসংঘের কর্মীরা। অবশ্য, সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ সব সময়ই ছিল। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর প্রকাশ শুরু করার অর্থ দিয়েছিল আইএসআই। বাংলাদেশ হওয়ার পরও এই ধারা অব্যাহত থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান প্রথম সেনাবাহিনীর পাকিস্তানিকরণ শুরু করেন, যা পরে এগিয়ে নেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পাকিস্তানের পলিসি সব পর্যায়ে সুচারুরূপে প্রয়োগের জন্য জেনারেল জিয়াউল হক খুশি হয়ে তাকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিশান-ই পাকিস্তান’ প্রদান করেছিলেন। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ২৬ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট কার্যকর করা হয় এবং রংপুরে এরশাদ এই অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তানিকরণের কারণেই জিয়াউর রহমান জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন এবং মন্ত্রিসভায় রাজাকারদের অন্তর্ভুক্ত করেন। একই পলিসি অনুসরণ করেন এরশাদ। পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া তাদের ক্ষমতার অংশীদার করেন, যা পাকিস্তানেও সম্ভব হয়নি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, শুরু থেকেই জামায়াত প্রধানত সামরিক বাহিনীর সহায়তায় শক্তি সঞ্চয় করেছে। একটি বিষয় খেয়াল করবেন, বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখন কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ ও সেক্যুলার আদর্শে বিশ্বাসীদের গ্রেফতার করেছে, নির্যাতন করেছে, জামায়াতীদের নয়।
নসরের বক্তব্যের সমর্থন পাই খালেদের গ্রন্থেও। তিনি উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১ সালের ১০ মার্চ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার জন্য ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক মজলিসে শূরা ও জেলা নাজেমদের এক বৈঠক আহ্বান করা হয়। সামগ্রিক পরিস্থিতি আলোচনার পর তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনটি বিকল্প খোলা আছেÑ
১. ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ যা করছে তা সমর্থন
২. যা হবার হোক, নিজেদের সরিয়ে রাখা
৩. পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দেওয়া, যাতে পাকিস্তানের অখ-তা অক্ষুণœ থাকে এবং এ কারণে নিজের দায়িত্ব পালন করা।
এই সভায় প্রাদেশিক শূরার রোকন মুস্তাফা শওকত ইমরান এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন যার মূলকথা হল, পাকিস্তনের এই অংশকে ‘হেফাজত’ করতে হবে যেভাবে মসজিদ ‘হেফাজত’ করা হয়। একজনও ‘বিচ্ছিন্নতা’বাদীদের সমর্থন করেনি। চারদিন এই বৈঠক হয়। ঐকমত্যের যে সিদ্ধান্ত হয় তাহল, এখানকার জনগণ দুটি শক্তির মাঝখানে পড়ে পিষ্ট হচ্ছে। একদিকে রয়েছে ‘দুঃশাসন’ [অর্থাৎ ভারত] নিয়োজিত হিন্দু ও কমিউনিস্ট, যারা দেশকে টুকরো টুকরো করে হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দিতে চায়। অন্যদিকে, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে এদের মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন। সুতরাং কী করতে হবে? এই দু’পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। “আমরা একদিকে ইসলামী শক্তি নিয়ে দুশমনের বিরুদ্ধে ময়দানে সংঘাতে অবতীর্ণ হব; অন্যদিকে ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে তা সংশোধনে; জন্য আমাদের মতো করে চেষ্টা করব।”
এরপর ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের এক বৈঠক হয়। সেখানে ঢাকা জামায়াতের নাজেম শাহ জালাল চৌধুরী তাদের পলিসি ঘোষণা করেন। সিদ্ধান্ত হয়, কোনো সার্কুলার জারি করা যাবে না, কারণ ‘তা হবে মৃত্যুকে আহ্বান করার শামিল।’ এ সিদ্ধান্তটি উল্লেখযোগ্য। জামায়াত যে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তর্গত হয়ে কাজ করেছিল বা বিভিন্ন বাহিনী তৈরি করেছিল সে সম্পর্কে তারা কাগজে-কলমে খুব কম প্রমাণ রেখেছে। এ বিষয়ে তারা খুব সর্তক ছিল। তাদের কার্যকলাপের প্রধান প্রমাণ তাই তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রাদেশিক শূরার চারজন সদস্য সারা ‘পূর্ব পাকিস্তান সফর’ করে তাদের পলিসি কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। ১৫ ও ১৬ মার্চ চারজন সফর শুরু করলেন। কর্মীদের প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানালেন। খালেদ লিখেছেন, “এই সফরে কর্মীসমাবেশে ফি আমানিল্লাহ বলা হত। আল্লাহ্র দরবারে আহাজারি করে ইসলাম ও পাকিস্তানের অক্ষুণœতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হত। দোয়া নিয়ে সাথীরা পরস্পরের নিকট থেকে এমনভাবে বিদায় নিত যেন আর কখনো এই দুনিয়ায় পরস্পরের দেখা হবে না।”
ছাত্রসংঘ তৃতীয় বিকল্প বেছে নিয়েছিল অর্থাৎ হিন্দুস্তানের অনুচরদের হাত থেকে পাকিস্তান রক্ষা। এবং পাকিস্তান রক্ষার জন্য কর্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানি শাসক অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং সর্বত্র প্রচার করা যে, পাকিস্তানকে হেফাজত করাই মূল কাজ। এ কারণেই গণহত্যা শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে জামায়াতের আমির গোলাম আযম সদলে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। এবং শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর ও আলশামসে জামায়াত ও ছাত্র সংঘ-কর্মীরা দলে দলে যোগদান করে।
এটি ছিল প্রকাশ্য দিক। অপ্রকাশ্য পলিসি ছিল অন্য। তারা ধরে নিয়েছিল, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ ও বামধারার দলগুলোকে দমন করে ফেলবে। দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দেবে। পাকিস্তানপন্থী দলগুলো তখন সুযোগ পাবে সেই শূন্যতা ভরাট করার। সেনাবাহিনী যদি জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে জামায়াত হয়ে উঠবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজা হয়ে যাবে তারা। অন্যদিকে রাজকার, শান্তি কমিটির সদস্য এবং আলবদর হয়ে পাকিস্তান রক্ষার নামে বিরোধীদের নিঃশেষ করে দিতে পারবে। (চলবে)
No comments