সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-তর্কপ্রিয় বাঙালি যুক্তিবাদী হবে কবে? by সুভাষ সাহা
আমরা ভুলে যাই, যারা ক্ষমতায় তারা তো পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীনদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত কোনো সংকটও নেই যে, সরকার সহসা পড়ে যাবে। তারা জিয়া বা জেনারেল এরশাদের মতো পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি।
অবশ্য সরকারের দেশ পরিচালনায় দুর্বলতা থাকলে বিরোধীরা বা জনগণের মধ্য থেকে যে কেউ প্রতিবাদ করতে পারে
দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের সমাপ্তির পর প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। নারীনীতির বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে ডাকা একদিনের সহিংস হরতালের মাধ্যমে এর রিহার্সেল হয়ে গেল গত ৪ এপ্রিল। এ আন্দোলনে প্রায় সারাদেশে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে বিরোধী আন্দোলনের চরিত্র কী হবে এবং কারা হবে প্রধানত তাদের ক্যাডার-সমর্থক শক্তি, এরও ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বাংলাদেশ এখনও জঙ্গি হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণের পর কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ জোরালো হয়ে ওঠায় জঙ্গি ও তাদের দোসর প্রধানত মৌলবাদী গোষ্ঠী একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছিল। এ অবস্থায় মরিয়ার্টির বক্তব্যের যৌক্তিকতা কতটুকু তা অনুধাবনের চেষ্টা করছিলাম। ভাবলাম, মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো আর স্ট্যান্টবাজি করার জন্য নীতিনির্ধারণী বিষয়ে হালকা কথা বলার লোক নন। তদুপরি বিচক্ষণ মরিয়ার্টির গুল মারার অতীত ইতিহাসও নেই।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ তাদের খয়ের খাঁ কতিপয় অতিচেনা দেশের মাধ্যমে কূটনৈতিক ও অন্যান্য চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছিল বিরোধীরা। এসব দেশের অধিকাংশই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সুতরাং তাদের অবস্থানটা সহজে বোঝা যায়। যখন বাংলাদেশে আবার প্রগতিশীল ধারা শক্তিশালী হওয়ার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করে, তখন তারা তো এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেই। তবে আমাদের দেশীয় দক্ষিণপন্থি শক্তির সামনাসামনি লড়াইয়ের চেষ্টা নজরে আসেনি এতদিন। হয়তো তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এবার হরতালের মধ্য দিয়ে তারা সরকার এবং ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী জনতাকে পাকিস্তানি শাসকদের কায়দায় ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি রাস্তার সংগ্রাম শুরু করে দিল। একটা হরতালের পর লাগাতার হরতালসহ নানা ধরনের কর্মসূচি, এমনকি সরকার উল্টে দেওয়ার ঘোষণাও সাড়ম্বরে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো যে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাপূর্ণ হবে তা এখনই বলে
দেওয়া যায়।
হরতালে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে পুলিশ পেটানো, কংফু কায়দায় উড়ে গিয়ে পুলিশকে জোড়া পায়ের লাথি মারাসহ টিভি ফুটেজে সংঘর্ষের বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদন দেখার পর মনে প্রশ্ন জেগেছে_ এ আন্দোলনকে বিএনপি তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তো? পাকিস্তানেও মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনী, এমনকি কখনও কখনও পাকিস্তান পিপলস পার্টি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলকে তোষামোদি ও কতক ক্ষেত্রে সক্রিয় সাহায্য দিতে গিয়ে দেশটির কী হাল করেছে তা তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। তাই এই হরতালের পর যদি দেশ দ্রুত পুনরায় জঙ্গিবাদ উত্থানের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে এর দায়দায়িত্ব বিএপি নেতৃত্ব এড়াতে পারবেন না। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মৌলবাদের সঙ্গে আপসের রাস্তা ধরে গদি, সংগঠন ও প্রাণ রক্ষার চেষ্টা নিলে ভুট্টোর মতো তারাও ইতিহাসের কাছে দায়ী হবেন।
আসলে আমাদের দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন_ সবাই যেন আমাদের এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট টিম ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মতো অস্থির। আমাদের ক্রিকেটারদের অধিকাংশের যেমন এক রান, দু'রান করে নিয়ে ভিতটা শক্তিশালী করে পরে পেটানোর মতো ধৈর্যশক্তি নেই, ক্রিকেটপ্রেমী জনতারও নিজেদের দলকে একেবারে পাকিস্তান-ভারতের মতো শক্তিমান ভাবতে ভারি পছন্দ। ভাবখানা এই_ বাঙালি বাবু মার দিলেই ছয় হয়ে যাবে, নিদেনপক্ষে চার তো হবেই। কিন্তু তারা সবাই ভুলে যান, ক্রিকেট ৫০ রানের খেলা নয়, ৫০ ওভারের খেলা। রাজনীতিতেও একই অবস্থা। এ প্রবণতাকে কি আমাদের মুদ্রা দোষ বলব!
আমরা ভুলে যাই, যারা ক্ষমতায় তারা তো পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে এসেছে। তদুপরি ক্ষমতাসীনদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত কোনো সংকটও নেই যে, সরকার সহসা পড়ে যাবে। তদুপরি তারা জিয়া বা জেনারেল এরশাদের মতো পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। অবশ্য সরকারের দেশ পরিচালনায় দুর্বলতা থেকে থাকলে বিরোধীরা বা জনগণের মধ্য থেকে যে কেউ প্রতিবাদ ও সমালোচনামুখর হতে পারে। এ জন্য হরতাল ডাকার কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি?
আসলে ইতিবাচক রাজনীতি করার কোনো মানসিকতাই আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল এখনও অর্জন করতে পারেনি। তাই যারা ক্ষমতায় থাকে তারা হরতালের বিরোধিতা করে এবং যারা বিরোধী দলে থাকে তারা হরতালকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার করে। যেহেতু প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই এখনও পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার গঠনে পালা করে দায়িত্ব বর্তাচ্ছে, তাই ক্ষমতায় গিয়ে হরতালবিরোধী অবস্থান নিয়ে আর হরতাল করবেন না_ এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বিরোধী দলে এসে তা পালন না করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য লজ্জিত পর্যন্ত হন না। এতে নেতৃত্বের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধও সম্ভবত নেই। কারণ তারা মনে করেন, নির্বাচনে তাদেরই একপক্ষ ক্ষমতায় যাবে। দেশের মানুষও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতোই অস্থির এবং কতক ক্ষেত্রে অবিবেচকও। তারা যে দলকে বা জোটকে যেবার নির্বাচিত করে তাদের কাছে অতিদ্রুত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চায়। যদি এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে তাহলে তারা মানি না মানব না বলে বিরোধী দলের রাস্তার মিছিলকে লম্বা করে। সম্ভবত জনগণের এমনতর মনোভাবকে রিড করতে পেরেছেন বলেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনের উদাহরণ টেনে বর্তমান সরকারকেও টেনে নামানোর হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে আমলে নিতে হলে তাকে সরকার বদলের জন্য আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষে গেলে তবেই না তিনি হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে পারবেন, নচেৎ নয়। আসলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অভাব ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় আমাদের এখানে রাজনীতিও চর দখলের মতো কেবল নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। দেশ ও দেশের মানুষের অবস্থার উন্নয়নে নির্দিষ্ট নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। অমর্ত্য সেনের তর্কপ্রিয় ভারতীয়র মতো তর্কপ্রিয় বাঙালি একদা তর্কে যুক্তিবাদকে আশ্রয় করলেও এখন যুক্তিহীনতাকেই যেন জীবন ও সমাজ-সংসারের সারাৎসার করেছে। এখানে তর্কপ্রিয়তা এখনও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানি আমল ও এরপর পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই আজও এ দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরই অঙ্গ হয়ে রয়েছে।
রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে এই যে বিকৃত ধারার অনুপ্রবেশ, সেটাই এখন ডালপালা বিস্তার করে আমাদের সব অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে উদ্যত। এই বিকৃতি আমাদের জাতীয় মানসিকতা, মূল্যবোধ, চিন্তা, কর্ম তথা সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে। সে কারণেই আমাদের তর্কপ্রিয়তায় এখন যুক্তিবাদ অনুপস্থিত। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, কোনো জাতীয় প্রয়োজনেই এখন আমাদের জাতীয় ঐকমত্য নেই। যে কোনো অর্থনৈতিক বা জনসমস্যার বিষয়েও একই কথা খাটে।
সরকার দেশের গ্যাস ঘাটতির কথা বিবেচনা করে পাইপলাইনের মাধ্যমে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নিশ্চয়ই বিষয়টির পক্ষে জোরালো সমর্থন মিলবে না। এর পক্ষে যুক্তি হালে পানি পাবে না। জনমনোরঞ্জন নয় বলে সরকারের অনেক নেতাই তাদের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে যাবেন না।
তবে এটা ঠিক, সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এ জন্য সরকারকে নতুন কারখানা স্থাপন করতে হবে। সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকারীদের ব্যয়ের সঙ্গে পাইপে গ্যাস ব্যবহারকারীদের মাসিক ব্যয়ের অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে একইসঙ্গে। পাইপে গ্যাস ব্যবহারকারী পরিবার যেখানে সাড়ে চারশ' টাকার মধ্যেই গৃহস্থালিতে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে সিলিন্ডার ব্যবহারকারীরা মাসে দুই-আড়াই হাজার টাকা গুনতে যাবেন কেন! এ ব্যয়বৈষম্য অবশ্যই দূর করতে হবে।
ষাটের দশকে পাইপের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে গ্যাস ব্যবহারের দিন সারাবিশ্বেই প্রায় গত হয়েছে। এখন জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশেও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। ষাটের দশকে গ্যাসের বহুবিধ ব্যবহার জানা ছিল না। গ্যাস দিয়ে যে সার উৎপাদন সম্ভব তা আমরা রপ্ত করতে শুরু করি আশির দশকে। এখন গাড়ি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। আর আমরা যেহেতু গ্যাসের ওপর ভাসছি না, তাই এই জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারে এখন থেকেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। তবে সিলিন্ডার গ্যাস যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়, এর দশাও যেন ভোজ্যতেল-চিনির দামের মতো সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারটিতে বিশেষভাবে সরকারকেই নজর রাখতে হবে।
দেখা যাক তর্কপ্রিয় বাঙালির মধ্যে যুক্তির ধারা আবার ফিরে এলো কি-না!
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
দশম বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরের সমাপ্তির পর প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। নারীনীতির বিরুদ্ধে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের শরিক ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির ব্যানারে ডাকা একদিনের সহিংস হরতালের মাধ্যমে এর রিহার্সেল হয়ে গেল গত ৪ এপ্রিল। এ আন্দোলনে প্রায় সারাদেশে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে বিরোধী আন্দোলনের চরিত্র কী হবে এবং কারা হবে প্রধানত তাদের ক্যাডার-সমর্থক শক্তি, এরও ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি বাংলাদেশ এখনও জঙ্গি হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণের পর কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ জোরালো হয়ে ওঠায় জঙ্গি ও তাদের দোসর প্রধানত মৌলবাদী গোষ্ঠী একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গিয়েছিল। এ অবস্থায় মরিয়ার্টির বক্তব্যের যৌক্তিকতা কতটুকু তা অনুধাবনের চেষ্টা করছিলাম। ভাবলাম, মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো আর স্ট্যান্টবাজি করার জন্য নীতিনির্ধারণী বিষয়ে হালকা কথা বলার লোক নন। তদুপরি বিচক্ষণ মরিয়ার্টির গুল মারার অতীত ইতিহাসও নেই।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ তাদের খয়ের খাঁ কতিপয় অতিচেনা দেশের মাধ্যমে কূটনৈতিক ও অন্যান্য চাপ প্রয়োগের কৌশল নিয়েছিল বিরোধীরা। এসব দেশের অধিকাংশই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। সুতরাং তাদের অবস্থানটা সহজে বোঝা যায়। যখন বাংলাদেশে আবার প্রগতিশীল ধারা শক্তিশালী হওয়ার আলামত স্পষ্ট হতে শুরু করে, তখন তারা তো এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবেই। তবে আমাদের দেশীয় দক্ষিণপন্থি শক্তির সামনাসামনি লড়াইয়ের চেষ্টা নজরে আসেনি এতদিন। হয়তো তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এবার হরতালের মধ্য দিয়ে তারা সরকার এবং ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী জনতাকে পাকিস্তানি শাসকদের কায়দায় ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি রাস্তার সংগ্রাম শুরু করে দিল। একটা হরতালের পর লাগাতার হরতালসহ নানা ধরনের কর্মসূচি, এমনকি সরকার উল্টে দেওয়ার ঘোষণাও সাড়ম্বরে দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আগামী দিনগুলো যে প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাপূর্ণ হবে তা এখনই বলে
দেওয়া যায়।
হরতালে মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে পুলিশ পেটানো, কংফু কায়দায় উড়ে গিয়ে পুলিশকে জোড়া পায়ের লাথি মারাসহ টিভি ফুটেজে সংঘর্ষের বিভিন্ন সচিত্র প্রতিবেদন দেখার পর মনে প্রশ্ন জেগেছে_ এ আন্দোলনকে বিএনপি তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে তো? পাকিস্তানেও মুসলিম লীগ ও সেনাবাহিনী, এমনকি কখনও কখনও পাকিস্তান পিপলস পার্টি মৌলবাদী রাজনৈতিক দলকে তোষামোদি ও কতক ক্ষেত্রে সক্রিয় সাহায্য দিতে গিয়ে দেশটির কী হাল করেছে তা তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। তাই এই হরতালের পর যদি দেশ দ্রুত পুনরায় জঙ্গিবাদ উত্থানের দিকে ধাবিত হয়, তাহলে এর দায়দায়িত্ব বিএপি নেতৃত্ব এড়াতে পারবেন না। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মৌলবাদের সঙ্গে আপসের রাস্তা ধরে গদি, সংগঠন ও প্রাণ রক্ষার চেষ্টা নিলে ভুট্টোর মতো তারাও ইতিহাসের কাছে দায়ী হবেন।
আসলে আমাদের দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন_ সবাই যেন আমাদের এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট টিম ও দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মতো অস্থির। আমাদের ক্রিকেটারদের অধিকাংশের যেমন এক রান, দু'রান করে নিয়ে ভিতটা শক্তিশালী করে পরে পেটানোর মতো ধৈর্যশক্তি নেই, ক্রিকেটপ্রেমী জনতারও নিজেদের দলকে একেবারে পাকিস্তান-ভারতের মতো শক্তিমান ভাবতে ভারি পছন্দ। ভাবখানা এই_ বাঙালি বাবু মার দিলেই ছয় হয়ে যাবে, নিদেনপক্ষে চার তো হবেই। কিন্তু তারা সবাই ভুলে যান, ক্রিকেট ৫০ রানের খেলা নয়, ৫০ ওভারের খেলা। রাজনীতিতেও একই অবস্থা। এ প্রবণতাকে কি আমাদের মুদ্রা দোষ বলব!
আমরা ভুলে যাই, যারা ক্ষমতায় তারা তো পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে এসেছে। তদুপরি ক্ষমতাসীনদের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত কোনো সংকটও নেই যে, সরকার সহসা পড়ে যাবে। তদুপরি তারা জিয়া বা জেনারেল এরশাদের মতো পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। অবশ্য সরকারের দেশ পরিচালনায় দুর্বলতা থেকে থাকলে বিরোধীরা বা জনগণের মধ্য থেকে যে কেউ প্রতিবাদ ও সমালোচনামুখর হতে পারে। এ জন্য হরতাল ডাকার কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি?
আসলে ইতিবাচক রাজনীতি করার কোনো মানসিকতাই আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল এখনও অর্জন করতে পারেনি। তাই যারা ক্ষমতায় থাকে তারা হরতালের বিরোধিতা করে এবং যারা বিরোধী দলে থাকে তারা হরতালকেই সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার করে। যেহেতু প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই এখনও পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার গঠনে পালা করে দায়িত্ব বর্তাচ্ছে, তাই ক্ষমতায় গিয়ে হরতালবিরোধী অবস্থান নিয়ে আর হরতাল করবেন না_ এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও বিরোধী দলে এসে তা পালন না করে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য লজ্জিত পর্যন্ত হন না। এতে নেতৃত্বের মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধও সম্ভবত নেই। কারণ তারা মনে করেন, নির্বাচনে তাদেরই একপক্ষ ক্ষমতায় যাবে। দেশের মানুষও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মতোই অস্থির এবং কতক ক্ষেত্রে অবিবেচকও। তারা যে দলকে বা জোটকে যেবার নির্বাচিত করে তাদের কাছে অতিদ্রুত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন চায়। যদি এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে তাহলে তারা মানি না মানব না বলে বিরোধী দলের রাস্তার মিছিলকে লম্বা করে। সম্ভবত জনগণের এমনতর মনোভাবকে রিড করতে পেরেছেন বলেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া মধ্যপ্রাচ্যের আন্দোলনের উদাহরণ টেনে বর্তমান সরকারকেও টেনে নামানোর হুশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। অথচ গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে আমলে নিতে হলে তাকে সরকার বদলের জন্য আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর নির্বাচনের ফলাফল তাদের পক্ষে গেলে তবেই না তিনি হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে পারবেন, নচেৎ নয়। আসলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থার অভাব ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে না ওঠায় আমাদের এখানে রাজনীতিও চর দখলের মতো কেবল নির্দিষ্ট সময় অন্তর ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হয়ে রয়েছে। দেশ ও দেশের মানুষের অবস্থার উন্নয়নে নির্দিষ্ট নীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি। অমর্ত্য সেনের তর্কপ্রিয় ভারতীয়র মতো তর্কপ্রিয় বাঙালি একদা তর্কে যুক্তিবাদকে আশ্রয় করলেও এখন যুক্তিহীনতাকেই যেন জীবন ও সমাজ-সংসারের সারাৎসার করেছে। এখানে তর্কপ্রিয়তা এখনও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তানি আমল ও এরপর পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই আজও এ দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরই অঙ্গ হয়ে রয়েছে।
রাজনীতি, সংস্কৃতিসহ সর্বক্ষেত্রে এই যে বিকৃত ধারার অনুপ্রবেশ, সেটাই এখন ডালপালা বিস্তার করে আমাদের সব অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে উদ্যত। এই বিকৃতি আমাদের জাতীয় মানসিকতা, মূল্যবোধ, চিন্তা, কর্ম তথা সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে আছে। সে কারণেই আমাদের তর্কপ্রিয়তায় এখন যুক্তিবাদ অনুপস্থিত। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, কোনো জাতীয় প্রয়োজনেই এখন আমাদের জাতীয় ঐকমত্য নেই। যে কোনো অর্থনৈতিক বা জনসমস্যার বিষয়েও একই কথা খাটে।
সরকার দেশের গ্যাস ঘাটতির কথা বিবেচনা করে পাইপলাইনের মাধ্যমে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নিশ্চয়ই বিষয়টির পক্ষে জোরালো সমর্থন মিলবে না। এর পক্ষে যুক্তি হালে পানি পাবে না। জনমনোরঞ্জন নয় বলে সরকারের অনেক নেতাই তাদের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে যাবেন না।
তবে এটা ঠিক, সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা এখনও পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। এ জন্য সরকারকে নতুন কারখানা স্থাপন করতে হবে। সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারকারীদের ব্যয়ের সঙ্গে পাইপে গ্যাস ব্যবহারকারীদের মাসিক ব্যয়ের অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে একইসঙ্গে। পাইপে গ্যাস ব্যবহারকারী পরিবার যেখানে সাড়ে চারশ' টাকার মধ্যেই গৃহস্থালিতে গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে সিলিন্ডার ব্যবহারকারীরা মাসে দুই-আড়াই হাজার টাকা গুনতে যাবেন কেন! এ ব্যয়বৈষম্য অবশ্যই দূর করতে হবে।
ষাটের দশকে পাইপের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে গ্যাস ব্যবহারের দিন সারাবিশ্বেই প্রায় গত হয়েছে। এখন জ্বালানিসমৃদ্ধ দেশেও সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। ষাটের দশকে গ্যাসের বহুবিধ ব্যবহার জানা ছিল না। গ্যাস দিয়ে যে সার উৎপাদন সম্ভব তা আমরা রপ্ত করতে শুরু করি আশির দশকে। এখন গাড়ি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই গ্যাসের ব্যবহার বাড়ছে। আর আমরা যেহেতু গ্যাসের ওপর ভাসছি না, তাই এই জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারে এখন থেকেই আমাদের সতর্ক হতে হবে। তবে সিলিন্ডার গ্যাস যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়, এর দশাও যেন ভোজ্যতেল-চিনির দামের মতো সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারটিতে বিশেষভাবে সরকারকেই নজর রাখতে হবে।
দেখা যাক তর্কপ্রিয় বাঙালির মধ্যে যুক্তির ধারা আবার ফিরে এলো কি-না!
সুভাষ সাহা :সাংবাদিক
No comments