হেমায়েতপুরে নিখোঁজ ৪ যুবকের পরিবারে বুকফাটা কান্না by মাজেদুল নয়ন
জোহরা বেগমের বুকফাটা কান্নার চেয়েও বেশি হাহাকার তৈরি করলো দেড় বছরের শিশু রিফাতের অপলক দৃষ্টি। মায়ের কোলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। গত ক’দিনে আগের চঞ্চলতা হারিয়ে ফেলেছে। বল খেলার প্রধান সহযোগী ও প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় বাবা তুষারের সঙ্গে ১৩ দিন দেখা নেই তার।
নিজে নিজে খেলতে পারে না রিফাত। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। মাঝেমধ্যেই কান্না জুড়ে দেয় মা। কিন্তু, রিফাতকে কিছুই বুঝতে দিতে চায় না। দাদীর বুকফাটা কান্না বিচলিত করে তোলে শিশু রিফাতকে। দাদাই বা কেন এতোদিন ধরে অফিসে যান না! কুল-কিনারা করতে পারে না ছোট্ট রিফাত।
গত ১৩ আগস্ট সাভারের হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে আলমনগর সুগন্ধা হাউজিং এর সামনে চায়ের দোকানের পেছন থেকে তুষারসহ ৪ যুবককে র্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু রিফাতের বাবা তুষারও রয়েছেন।
তুষারের বাবা তাজুল ইসলামের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন রুমে প্রবেশ করেন জোহরা বেগম। তুষারের বয়সী বাংলানিউজের এই প্রতিবেদককে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুষার কই?’
প্রতিবেদকের মৌনতা মা’কে বুঝিয়ে দেয়, এর কাছেও তার একমাত্র ছেলের কোন খোঁজ নেই। বুক চাপড়িয়ে বিলাপ শুরু করেন তুষারের মধ্যবয়সী মা। তাজুল ইসলাম এসে জড়িয়ে ধরেন স্ত্রীকে।
জোহরা বেগমের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আলমনগর হাউজিংয়ের ৩ নং রোডের ১২ নম্বর বাড়িটি। থেমে থেমে বুক ফাটা কান্নাই যেন এখন এ বাড়ির ধর্ম।
তুষারের মায়ের গগণবিদারী কান্না যেন আকাশকে মাটিতে নামিয়ে আনতে চায়। চোখের পানি দু’গাল বেয়ে ঝরতে থাকে অঝোর ধারায়। মায়ের কান্নার হাহাকার বাড়ে। ক্ষণেক্ষণে তিনি বলেন, ‘তুষার কই তুমি, আমার ডাক শুনতে পাওনা বাবা?’
তাজুল ইসলামের বাহুবন্ধন ছেড়ে লুটিয়ে পড়েন জোহরা বেগম। চিৎকার করে তিনি জানতে চান, ‘কি করব আমি? কোথায় পাব আমার তুষারকে? কি দিয়ে বোঝাব মনকে? শুধু মনে হয় ওর রুমে ও বসে আছে.. .. মনে হয় ওই চায়ের দোকানেই বসে আছে তুষার... এরা আমাকে যেতে দেয় না... গত রাতেও তুষার বাসায় এসেছিল,..আমার দরজায় এরা তালা লাগিয়ে রেখেছিল। আমাকে তুষারের কাছে যেতে দেয় না।’
তাজুল ইসলাম জানান, তুষারের মা এখন পাগলপ্রায়। একটু পর পর দরজার দিকে ছুটে যান। ছেলেকে খুঁজতে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে চান। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে তার শারীর ভেঙে পড়ছে। ডাক্তার দেখিয়েছি। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখি।
তুষারের বাবা তাজুল ইসলামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। নদী ভাঙ্গনে গ্রামের ঠিকানা এখন বিলীন। প্রথম রোজার দিন বাবাকে হারিয়েছেন তাজুল ইসলাম। তাই বাবাকে হারিয়ে শোকে বিহবল তাজুল ইসলাম এবার ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন। এ দুই শোকের আগেই তার দু’বার স্ট্রোক করেছে। তুষারের বৌ আর বোনকে চিকিৎসক বলেছেন, তাজুল ইসলামের দিকে খেয়াল রাখতে। স্বামী হারানো কিশোরী বৌয়ের পক্ষে সেটাও দুরূহ।
তুষারের মার কান্না পেশাদারী কথাকে বেশি দূর এগোতে দেয় না। বলেন, ‘আগামী ২৮ আগস্ট তুষারের জন্মদিন। তুষার কি এর আগে বাড়ি আসবো না! ওরে কারা নিয়ে গেছে, টাকা লাগলে বলুক আমি কোটি টাকা হলেও দেবো তুষারকে আনতে।’
কান্নাজড়ানো সুরেই মার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, আলমনগর হাউজিংয়ে তারা এসেছেন বছর চারেক আগে। ২৩ বছরের তুষারের বিয়ে হয়েছে ১৯ বছর বয়সেই। দু’বার স্ট্রোক করার পর তাজুল ইসলাম একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১ বিষয়ে অকৃতকার্য হলে আর ছেলেকে পরীক্ষা দিতে চাপ দেয়নি তার বাবা-মা। তাই তুষারের লেখাপড়া থেমে যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসা করেছেন তুষার।
তাজুল ইসলাম বলেন, “আলমনগর হাউজিংয়ের ভেতরেই একটি কসমেটিকসের দোকান করে দেই। লোকসানের কারণে সেই দোকান ছেড়ে দেয় তুষার। এরপর হাউজিংয়ের পাশে আলম সাহেবের ইট ব্যবসার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও মিরপুরে বাবার ক্লথ ক্লিনিং ব্যবসাতেও সাহায্য করতো সে।”
১৭ আগস্ট থানায় মামলা করেছে নিখোঁজ ৪ যুবকের পরিবার।
তাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা সবখানে খোঁজ নিয়েছি, পুলিশ বলেছে তারা খোঁজ জানে না। র্যাব বলছে তারা ৪ যুবককে তুলে নেয়নি। ডিবি অফিসে গিয়েছি, তাদের কাছেও কোন খোঁজ নেই। আমরা কোথায় তাদের খুঁজে পাব?”
১৩ আগস্ট সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে কাজীপাড়া বাবার বাড়ি থেকে স্ত্রী নুসরাত জাহান টুম্পাকে নিয়ে আসেন স্বামী তুষার। বৌ আর বাচ্চাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বলেন, ‘আমি সিএনজি ভাড়া দিয়ে আসছি, আর আসেনি তুষার।’
ওড়না দিয়ে চোখের পানি মোছেন টুম্পা।
অপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে তমাল। আবারও কান্না করছে মা, এখনও বাবা ফেরেনি। এদিক ওদিক তাকায়, অসহায়ত্ব ফোটে বিচলিত দৃষ্টিতে।
আলমগর হাউজিংয়ের শেষ মাথায় মোহনের বাড়ি। বেলুন ফোলাচ্ছিল ৬ বছরের ইফাত। বাতাস ভরে গেলেই ছেড়ে দিচ্ছে, আবার ফোলাচ্ছে।
বাবা মোহনের সঙ্গে ১৩ দিন ধরে দেখা নেই ইফাতের। এবারের ঈদেও বাবা ছিল না। মা বলেছে- বাবা বাইরে গেছে বিশেষ কাজে। দু’একদিনের মধ্যেই চলে আসবে।
গত ১৩ আগস্ট তুষারের সঙ্গে আরও যে তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন, তাদেরই একজন মোহন। বয়সে অন্যদের তুলনায় বড় তিনি।
১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে এবারই প্রথম মোহনের স্ত্রী শাহিদা আক্তারের স্বামী ছাড়া ঈদ কেটেছে।
বাংলানিউজকে বললেন, “বড় ছেলে ইমনের বয়স ১০। সে শুনেছে, তার বাবাকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। এখন সারাদিন ছন্নছাড়ার মতো বাইরে বাইরে ঘোরে, খেতে আসে না। রাতেও গ্রাস তোলে না মুখে।
১০ বছরের ইমনের খেতে ভাল লাগে না। খেলতেও ভাল লাগে না। ইমন এই প্রতিবেদককে অনুরোধ করে, ‘আঙ্কেল আপনারা একটু সুন্দরবন, পাহাড়, সাগরের পাশের পাহাড়গুলোতে খুঁজে দেখেন। সন্ত্রাসীরা আব্বুকে ধরে নিয়ে গেছে। আটকে রেখেছে। আব্বু যেতে চায়নি, পরে মেরে নিয়ে গেছে। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল, নাইলে আব্বুর সঙ্গে পারতো না।’
স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তানকে নিয়ে মোহনের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। ইমন তৃতীয় শ্রেণিতে ও ইফাত কেজি শ্রেণিতে পড়ে।
শাহীদা আক্তার যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। দু’সন্তানের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতেও পারছেন না। পাছে ইফাত যদি বুঝে যায়, তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শাহীদা জানান, নিজের একটি বাস আছে মোহনের, নিজেই চালান। পাশের চান্দুনিয়া গ্রামেই নিজের শাহীদার বাবা এবং শ্বশুর বাড়ি।
মোহনের নিখোঁজ হওয়ার দিনের কথা উল্লেখ করে জানান, ‘বাসায় এসে গোসল করে বের হয়। একটু পরে ফোন দিয়ে বলেন- হেলপার ছেলেটা আসবে গাড়ির চাবি নিতে। কিন্তু ছেলেটা আসছিল না। পরে ফোন দেই তার নাম্বারে। কিন্তু তা বন্ধ পাই। এখনও বন্ধ।’ আর কান্না ধরে রাখতে পারেন না শাহীদা।
বলেন, ‘কে নেবে, কারও সঙ্গে তো তার শত্রুতা ছিল না। আমি কোন দিন শুনিনি তার সঙ্গে কারও বড় কোন ঝগড়া রয়েছে। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে কারও নাম বলতে পারিনি। এ হাউজিংয়ের সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখেন কেউ বলতে পারবে না, মোহনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আছে।”
শাহীদা বলেন, “আমার স্বামী অন্য তিন ছেলের তুলনায় বয়সে ১০ বছরের বড়। ওদের সঙ্গে তার কোন বন্ধুত্বও ছিল না। দোকানদার বলছে, তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। যেতে চায়নি। পরে কাঁধে অস্ত্র দিয়ে বাড়ি মারে।”
কিন্তু ছেলে দু’টোর মুখের দিকে তাকিয়ে শাহীদা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, ফিরে আসবে মোহন। কিন্তু অজানা আশঙ্কার মেঘ ঢেকে দেয় শাহীদার মুখ।
শোক আর হতাশায় হতবিহ্বল নিখোঁজ চার যুবকের পরিবার। হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ফুলবাড়িয়ায় ভাড়া থাকে ২৫ বছরের মিঠুর পরিবার।
আর জয়নাবাড়িতে ভাড়া থাকে ২৫ বছরের মোস্তফার পরিবার।
যে দোকানের পেছন থেকে নিখোঁজ হয়েছেন যুবকেরা, সেই দোকানদার সোহাগ জানান, প্রতিদিন খোঁজ করেন পরিবারের সদস্যরা। মিঠু, মোস্তফার বাড়ির অবস্থাও তুষার আর মোহন ভাই’র পরিবারের মতো।
ফোনে কথা হয় মোস্তফার ভাই লিটনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের পরিবার হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে জয়নাবাড়ীতে বসবাস করছে প্রায় ২০ বছর ধরে। তার ভাই মোস্তফা স্থানীয় একটি টিভি-ফ্রিজ শোরুমে কর্মরত ছিলেন। তার নামে কোনো থানায় মামলা বা জিডি নেই। কী কারণে মোস্তফাকে কারা নিয়ে গেছে তাই তারা বুঝতে পারছেন না। এদিকে বাসায় মা, বাবার অবস্থা প্রায় মৃত। বৃদ্ধা মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
সাভার থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাকিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, প্রাথমিকভাবে তদন্তকালে তিনি ৪ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আলামত পেয়েছেন।
তিনি বলেন, “আশা করি তাদের উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হবো। তদন্ত চলছে।”
গত ১৩ আগস্ট সাভারের হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে আলমনগর সুগন্ধা হাউজিং এর সামনে চায়ের দোকানের পেছন থেকে তুষারসহ ৪ যুবককে র্যাব পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু রিফাতের বাবা তুষারও রয়েছেন।
তুষারের বাবা তাজুল ইসলামের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন রুমে প্রবেশ করেন জোহরা বেগম। তুষারের বয়সী বাংলানিউজের এই প্রতিবেদককে দেখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুষার কই?’
প্রতিবেদকের মৌনতা মা’কে বুঝিয়ে দেয়, এর কাছেও তার একমাত্র ছেলের কোন খোঁজ নেই। বুক চাপড়িয়ে বিলাপ শুরু করেন তুষারের মধ্যবয়সী মা। তাজুল ইসলাম এসে জড়িয়ে ধরেন স্ত্রীকে।
জোহরা বেগমের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আলমনগর হাউজিংয়ের ৩ নং রোডের ১২ নম্বর বাড়িটি। থেমে থেমে বুক ফাটা কান্নাই যেন এখন এ বাড়ির ধর্ম।
তুষারের মায়ের গগণবিদারী কান্না যেন আকাশকে মাটিতে নামিয়ে আনতে চায়। চোখের পানি দু’গাল বেয়ে ঝরতে থাকে অঝোর ধারায়। মায়ের কান্নার হাহাকার বাড়ে। ক্ষণেক্ষণে তিনি বলেন, ‘তুষার কই তুমি, আমার ডাক শুনতে পাওনা বাবা?’
তাজুল ইসলামের বাহুবন্ধন ছেড়ে লুটিয়ে পড়েন জোহরা বেগম। চিৎকার করে তিনি জানতে চান, ‘কি করব আমি? কোথায় পাব আমার তুষারকে? কি দিয়ে বোঝাব মনকে? শুধু মনে হয় ওর রুমে ও বসে আছে.. .. মনে হয় ওই চায়ের দোকানেই বসে আছে তুষার... এরা আমাকে যেতে দেয় না... গত রাতেও তুষার বাসায় এসেছিল,..আমার দরজায় এরা তালা লাগিয়ে রেখেছিল। আমাকে তুষারের কাছে যেতে দেয় না।’
তাজুল ইসলাম জানান, তুষারের মা এখন পাগলপ্রায়। একটু পর পর দরজার দিকে ছুটে যান। ছেলেকে খুঁজতে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে চান। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে তার শারীর ভেঙে পড়ছে। ডাক্তার দেখিয়েছি। ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখি।
তুষারের বাবা তাজুল ইসলামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। নদী ভাঙ্গনে গ্রামের ঠিকানা এখন বিলীন। প্রথম রোজার দিন বাবাকে হারিয়েছেন তাজুল ইসলাম। তাই বাবাকে হারিয়ে শোকে বিহবল তাজুল ইসলাম এবার ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন। এ দুই শোকের আগেই তার দু’বার স্ট্রোক করেছে। তুষারের বৌ আর বোনকে চিকিৎসক বলেছেন, তাজুল ইসলামের দিকে খেয়াল রাখতে। স্বামী হারানো কিশোরী বৌয়ের পক্ষে সেটাও দুরূহ।
তুষারের মার কান্না পেশাদারী কথাকে বেশি দূর এগোতে দেয় না। বলেন, ‘আগামী ২৮ আগস্ট তুষারের জন্মদিন। তুষার কি এর আগে বাড়ি আসবো না! ওরে কারা নিয়ে গেছে, টাকা লাগলে বলুক আমি কোটি টাকা হলেও দেবো তুষারকে আনতে।’
কান্নাজড়ানো সুরেই মার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, আলমনগর হাউজিংয়ে তারা এসেছেন বছর চারেক আগে। ২৩ বছরের তুষারের বিয়ে হয়েছে ১৯ বছর বয়সেই। দু’বার স্ট্রোক করার পর তাজুল ইসলাম একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ১ বিষয়ে অকৃতকার্য হলে আর ছেলেকে পরীক্ষা দিতে চাপ দেয়নি তার বাবা-মা। তাই তুষারের লেখাপড়া থেমে যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসা করেছেন তুষার।
তাজুল ইসলাম বলেন, “আলমনগর হাউজিংয়ের ভেতরেই একটি কসমেটিকসের দোকান করে দেই। লোকসানের কারণে সেই দোকান ছেড়ে দেয় তুষার। এরপর হাউজিংয়ের পাশে আলম সাহেবের ইট ব্যবসার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও মিরপুরে বাবার ক্লথ ক্লিনিং ব্যবসাতেও সাহায্য করতো সে।”
১৭ আগস্ট থানায় মামলা করেছে নিখোঁজ ৪ যুবকের পরিবার।
তাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা সবখানে খোঁজ নিয়েছি, পুলিশ বলেছে তারা খোঁজ জানে না। র্যাব বলছে তারা ৪ যুবককে তুলে নেয়নি। ডিবি অফিসে গিয়েছি, তাদের কাছেও কোন খোঁজ নেই। আমরা কোথায় তাদের খুঁজে পাব?”
১৩ আগস্ট সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে কাজীপাড়া বাবার বাড়ি থেকে স্ত্রী নুসরাত জাহান টুম্পাকে নিয়ে আসেন স্বামী তুষার। বৌ আর বাচ্চাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বলেন, ‘আমি সিএনজি ভাড়া দিয়ে আসছি, আর আসেনি তুষার।’
ওড়না দিয়ে চোখের পানি মোছেন টুম্পা।
অপলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে তমাল। আবারও কান্না করছে মা, এখনও বাবা ফেরেনি। এদিক ওদিক তাকায়, অসহায়ত্ব ফোটে বিচলিত দৃষ্টিতে।
আলমগর হাউজিংয়ের শেষ মাথায় মোহনের বাড়ি। বেলুন ফোলাচ্ছিল ৬ বছরের ইফাত। বাতাস ভরে গেলেই ছেড়ে দিচ্ছে, আবার ফোলাচ্ছে।
বাবা মোহনের সঙ্গে ১৩ দিন ধরে দেখা নেই ইফাতের। এবারের ঈদেও বাবা ছিল না। মা বলেছে- বাবা বাইরে গেছে বিশেষ কাজে। দু’একদিনের মধ্যেই চলে আসবে।
গত ১৩ আগস্ট তুষারের সঙ্গে আরও যে তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন, তাদেরই একজন মোহন। বয়সে অন্যদের তুলনায় বড় তিনি।
১৩ বছরের বিবাহিত জীবনে এবারই প্রথম মোহনের স্ত্রী শাহিদা আক্তারের স্বামী ছাড়া ঈদ কেটেছে।
বাংলানিউজকে বললেন, “বড় ছেলে ইমনের বয়স ১০। সে শুনেছে, তার বাবাকে র্যাব ধরে নিয়ে গেছে। এখন সারাদিন ছন্নছাড়ার মতো বাইরে বাইরে ঘোরে, খেতে আসে না। রাতেও গ্রাস তোলে না মুখে।
১০ বছরের ইমনের খেতে ভাল লাগে না। খেলতেও ভাল লাগে না। ইমন এই প্রতিবেদককে অনুরোধ করে, ‘আঙ্কেল আপনারা একটু সুন্দরবন, পাহাড়, সাগরের পাশের পাহাড়গুলোতে খুঁজে দেখেন। সন্ত্রাসীরা আব্বুকে ধরে নিয়ে গেছে। আটকে রেখেছে। আব্বু যেতে চায়নি, পরে মেরে নিয়ে গেছে। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল, নাইলে আব্বুর সঙ্গে পারতো না।’
স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তানকে নিয়ে মোহনের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। ইমন তৃতীয় শ্রেণিতে ও ইফাত কেজি শ্রেণিতে পড়ে।
শাহীদা আক্তার যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। দু’সন্তানের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতেও পারছেন না। পাছে ইফাত যদি বুঝে যায়, তার বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শাহীদা জানান, নিজের একটি বাস আছে মোহনের, নিজেই চালান। পাশের চান্দুনিয়া গ্রামেই নিজের শাহীদার বাবা এবং শ্বশুর বাড়ি।
মোহনের নিখোঁজ হওয়ার দিনের কথা উল্লেখ করে জানান, ‘বাসায় এসে গোসল করে বের হয়। একটু পরে ফোন দিয়ে বলেন- হেলপার ছেলেটা আসবে গাড়ির চাবি নিতে। কিন্তু ছেলেটা আসছিল না। পরে ফোন দেই তার নাম্বারে। কিন্তু তা বন্ধ পাই। এখনও বন্ধ।’ আর কান্না ধরে রাখতে পারেন না শাহীদা।
বলেন, ‘কে নেবে, কারও সঙ্গে তো তার শত্রুতা ছিল না। আমি কোন দিন শুনিনি তার সঙ্গে কারও বড় কোন ঝগড়া রয়েছে। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে কারও নাম বলতে পারিনি। এ হাউজিংয়ের সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখেন কেউ বলতে পারবে না, মোহনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আছে।”
শাহীদা বলেন, “আমার স্বামী অন্য তিন ছেলের তুলনায় বয়সে ১০ বছরের বড়। ওদের সঙ্গে তার কোন বন্ধুত্বও ছিল না। দোকানদার বলছে, তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে। যেতে চায়নি। পরে কাঁধে অস্ত্র দিয়ে বাড়ি মারে।”
কিন্তু ছেলে দু’টোর মুখের দিকে তাকিয়ে শাহীদা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, ফিরে আসবে মোহন। কিন্তু অজানা আশঙ্কার মেঘ ঢেকে দেয় শাহীদার মুখ।
শোক আর হতাশায় হতবিহ্বল নিখোঁজ চার যুবকের পরিবার। হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ফুলবাড়িয়ায় ভাড়া থাকে ২৫ বছরের মিঠুর পরিবার।
আর জয়নাবাড়িতে ভাড়া থাকে ২৫ বছরের মোস্তফার পরিবার।
যে দোকানের পেছন থেকে নিখোঁজ হয়েছেন যুবকেরা, সেই দোকানদার সোহাগ জানান, প্রতিদিন খোঁজ করেন পরিবারের সদস্যরা। মিঠু, মোস্তফার বাড়ির অবস্থাও তুষার আর মোহন ভাই’র পরিবারের মতো।
ফোনে কথা হয় মোস্তফার ভাই লিটনের সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের পরিবার হেমায়েতপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে জয়নাবাড়ীতে বসবাস করছে প্রায় ২০ বছর ধরে। তার ভাই মোস্তফা স্থানীয় একটি টিভি-ফ্রিজ শোরুমে কর্মরত ছিলেন। তার নামে কোনো থানায় মামলা বা জিডি নেই। কী কারণে মোস্তফাকে কারা নিয়ে গেছে তাই তারা বুঝতে পারছেন না। এদিকে বাসায় মা, বাবার অবস্থা প্রায় মৃত। বৃদ্ধা মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
সাভার থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাকিবুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, প্রাথমিকভাবে তদন্তকালে তিনি ৪ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আলামত পেয়েছেন।
তিনি বলেন, “আশা করি তাদের উদ্ধার করতে আমরা সক্ষম হবো। তদন্ত চলছে।”
No comments