পরিবেশ-আসুন সুন্দরকে সুন্দর রাখি by সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
এ লেখাটি লিখছি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশের একটি বাংলোয় বসে। আমাকে বলা হয়েছে পরিবেশগত দিক থেকে ২০১১ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি এবং ২০১২ সালের বা আগামী দিনের প্রত্যাশাগুলো নিয়ে লিখতে। লেখাটি যেহেতু প্রথম আলো নববর্ষের শুভেচ্ছাসহ তার পাঠকের কাছে উপস্থাপন করবে, তাই এটিকে ইতিবাচক করার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। পরিবেশের অতীত ও ভবিষ্যৎ সুখকর করে পাঠকের কাছে উপস্থাপন সত্যিই সহজ নয়। ২০১১ সালে
জনগণ যা প্রত্যক্ষ করেছে, বিষয়াবলি তার চেয়ে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ২০১১ সাল বা তার পরের বছরগুলো ভিন্নভাবে সাজানোর সুযোগ ও প্রয়োজন আছে বলেই লেখার তাগিদ অনুভব করছি।
সত্যি বলতে কি, ২০১১ সালে বা বিগত কয়েকটি বছর পরিবেশের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাকে বেশি বিচলিত করেছে, তা হলো নিবেদিত ও সৎ নেতৃত্বের অভাব। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা না হলেও এযাত্রায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনের দিকে ইঙ্গিত করছি। জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা কোটি মানুষ যখন আশায় ছিল যে বিশ্বনেতারা তাদের রক্ষায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে একটি আইনি কাঠামোতে সম্মত হবেন, নেতারা তখন কালক্ষেপণের কৌশল বেছে নিলেন। ২০১৫ সালের আগে এ-সংক্রান্ত কোনো আইনি কাঠামোতে সম্মতি দিতে নেতারা অস্বীকৃতি জানালেও ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০১৫ সাল নাগাদ সম্মত হওয়ার যে সম্মতি তাঁরা দিলেন, এটি আমাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে গৃহীতব্য আইনি কাঠামো যাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য নিচু ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, সে বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় জনমত গড়ে তুলতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সব আলোচনায় তহবিল একটি বড় আলোচিত বিষয়। কত টাকা হলে তা জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য যথেষ্ট হবে, এটা নিয়ে আলোচনার কোনো অভাব নেই। টাকাপ্রাপ্তির পাশাপাশি যে বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে, তা হলো প্রাপ্ত টাকার সদ্ব্যবহার। ২০১১ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জলবায়ু তহবিলের অব্যবস্থাপনার যে চিত্র উঠে এসেছিল, তাতে আমি নিশ্চিত যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সুশাসন নিশ্চিত না করে অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা করা অনুচিত। বিশ্বের অনেক সুশীল সমাজ সে দেশের জলবায়ু তহবিল কীভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা তদারকের জন্য ওয়াচগ্রুপ গঠন করেছে। এসব গ্রুপ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে জলবায়ু তহবিলে অর্থের জোগান, প্রাপ্ত/বরাদ্দ অর্থের বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমার মতে, পরিবেশবাদীদের উচিত ভবিষ্যতে এমন একটি ওয়াচগ্রুপ গড়ে তোলা, যা জলবায়ু তহবিলের সর্বোচ্চ ও স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং সরকারের উচিত হবে আতঙ্কিত না হয়ে এমন উদ্যোগকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া, যাতে সুশাসনের বিষয়ে তীব্র সংকট থাকা সরকারের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হয়।
এবার জাতীয় কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। দেশের অভ্যন্তরীণ যেসব পরিবেশ বিষয়ে আমরা বিগত দশক থেকেই সোচ্চার, তার মধ্যে রয়েছে নদী দখল ও দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এসব সমস্যা এখনো সমস্যাই রয়ে গেছে এবং কাঙ্ক্ষিত সমাধান না আসায় ২০১২ সালেও পরিবেশবাদীদের এসব বিষয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।
আমার মতে, ২০১১ সালে আলোচিত পরিবেশগত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ঢাকার নদীগুলোর সীমানা চিহ্নিতকরণে জেলা প্রশাসকদের চাতুর্যপূর্ণ গাফিলতি, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের জন্য বারবার আদালতের কাছে সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন, জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা প্রণয়নে ও এ শিল্প তদারকিতে সরকারের তীব্র অনীহা, সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদের পাশ ঘেঁষে মেট্রোরেল স্থাপনের প্রস্তাব ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আশার চেয়ে হতাশার পরিমাণ বেশি হলেও যে দুটি বিষয়ে জনগণ সামান্য আশার সঞ্চার করেছে তার মধ্যে রয়েছে, অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও মাটি ভরাট রোধে রাজউকের স্বল্পস্থায়ী অভিযান এবং দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ নিঃসরণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রয়োগ) নিরলস প্রয়াস। ধারাবাহিকতার অভাবে প্রথম ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বিষয়ে জনমনে আস্থার সঞ্চার না হলেও শেষোক্ত ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনাকারী পরিচালকের সততা ও প্রতিশ্রুতির কারণে জনমনে আস্থার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকার যদিও আপিল কর্তৃপক্ষ গঠন করে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দূষণকারী বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা থেকে অব্যাহতি দিতে তৎপর, তবু এটি সত্য যে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে পরিচালিত খতিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে বেশ আন্দোলিত করেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমি এ লেখাটি লিখছি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে বসে। লাউয়াছড়া শুনলেই গহিন প্রাকৃতিক বন; বন্য প্রাণী আর কিছুসংখ্যক বনবাসীর কথা যাদের চোখে ভেসে ওঠে, তাদের জানিয়ে দিতে চাই, বনটি এখন আর আগের মতো নেই। এর এখনকার অবস্থা যৌবন ও মাঝ বয়স পার হয়ে সদ্য বার্ধক্যে পড়া মানুষের মতোই প্রায় সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেও সদ্য বার্ধক্যে পড়া মানুষের মতোই নিজেকে আকর্ষণীয় দেখানোর প্রচেষ্টারত। এ বন এখন পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম স্থান। একদা রূপবতী এ বনের হূতগৌরব স্মরণ করিয়ে দিতেই যেন বনের ধ্বংসাবশেষকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে বন বিভাগ। বনটি এখন আর বন্য প্রাণীর নয়, বরং পর্যটকদের অভয়ারণ্য, প্রাকৃতিক বনগুলোর সব কটিরই প্রায় এ অবস্থা, সেই ‘গঙ্গা তুমি বইছো কেন?’ গানটির রেশ ধরে আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করে যে সব প্রাকৃতিক বনের এমন করুণ চিত্রের পরও বন বিভাগ কীভাবে নিজের অস্তিত্বের যথার্থতা প্রমাণ করবে?
ঢাকা শহরের ভয়াবহ ব্যস্ততা থেকে কিছুটা প্রশস্তি খুঁজতে এসেছিলাম সিলেটে, প্রায় ১৭ বছর পর জাফলং নদী দেখে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। শীতকালে পাথরের ওপর বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ নদীটি আর নেই। একটি অর্ধমৃত ঘোলা নদীর দুই পাশে প্রচুর বালু ও পাথর বহনকারী ট্রাক আর নদীর বুকজুড়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। সরকার এ নদীকে পাথরমহাল ঘোষণার পর থেকেই এ অবস্থা। সৌন্দর্যপিয়াসী পর্যটকেরা নদীর সৌন্দর্যের বিপরীতে দেখে যাচ্ছেন নদীর মৃত্যুদৃশ্য। সুন্দরকে অসুন্দর করতে আমাদের মতো পারদর্শী আর কোনো জাতি কি পৃথিবীতে আছে?
এসব প্রশ্ন যখন আমাকে বিচলিত করছে, তখন একটি সংবাদ পাঠকদের জানাতে চাই। সিলেট শহরের অদূরে লালাখালে বয়ে চলা সারি নদীটি এখনো স্বচ্ছ পানি নিয়ে বয়ে চললেও এ নদীকেও সরকার বালুমহাল ঘোষণা করেছে। ফলে ৭৫ লাখ টাকা ইজারামূল্য পরিশোধ করে এ নদীর তলদেশ থেকে বালু ও কয়লার গুঁড়া তোলার বিনিময়ে এ নদীকে ধীরে ধীরে জাফলংয়ের পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কি পারি না প্রকৃতির ওপর এমন নগ্ন আগ্রাসন রুখে দিতে?
পরিবেশ ধ্বংসকারী এত সব দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা এবং সুসংহত আন্দোলন গড়ে তোলাই হোক আগামীর সংকল্প!
লেখক: প্রধান নির্বাহী, বেলা।
সত্যি বলতে কি, ২০১১ সালে বা বিগত কয়েকটি বছর পরিবেশের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমাকে বেশি বিচলিত করেছে, তা হলো নিবেদিত ও সৎ নেতৃত্বের অভাব। এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা না হলেও এযাত্রায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এর অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনের দিকে ইঙ্গিত করছি। জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে থাকা কোটি মানুষ যখন আশায় ছিল যে বিশ্বনেতারা তাদের রক্ষায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ও গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে একটি আইনি কাঠামোতে সম্মত হবেন, নেতারা তখন কালক্ষেপণের কৌশল বেছে নিলেন। ২০১৫ সালের আগে এ-সংক্রান্ত কোনো আইনি কাঠামোতে সম্মতি দিতে নেতারা অস্বীকৃতি জানালেও ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০১৫ সাল নাগাদ সম্মত হওয়ার যে সম্মতি তাঁরা দিলেন, এটি আমাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পরবর্তী সময়ে গৃহীতব্য আইনি কাঠামো যাতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য নিচু ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়, সে বিষয়ে সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় জনমত গড়ে তুলতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সব আলোচনায় তহবিল একটি বড় আলোচিত বিষয়। কত টাকা হলে তা জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশের জন্য যথেষ্ট হবে, এটা নিয়ে আলোচনার কোনো অভাব নেই। টাকাপ্রাপ্তির পাশাপাশি যে বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে, তা হলো প্রাপ্ত টাকার সদ্ব্যবহার। ২০১১ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জলবায়ু তহবিলের অব্যবস্থাপনার যে চিত্র উঠে এসেছিল, তাতে আমি নিশ্চিত যে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সুশাসন নিশ্চিত না করে অর্থপ্রাপ্তি নিয়ে আলোচনা করা অনুচিত। বিশ্বের অনেক সুশীল সমাজ সে দেশের জলবায়ু তহবিল কীভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তা তদারকের জন্য ওয়াচগ্রুপ গঠন করেছে। এসব গ্রুপ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির বিপরীতে জলবায়ু তহবিলে অর্থের জোগান, প্রাপ্ত/বরাদ্দ অর্থের বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আমার মতে, পরিবেশবাদীদের উচিত ভবিষ্যতে এমন একটি ওয়াচগ্রুপ গড়ে তোলা, যা জলবায়ু তহবিলের সর্বোচ্চ ও স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং সরকারের উচিত হবে আতঙ্কিত না হয়ে এমন উদ্যোগকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া, যাতে সুশাসনের বিষয়ে তীব্র সংকট থাকা সরকারের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও উজ্জ্বল হয়।
এবার জাতীয় কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। দেশের অভ্যন্তরীণ যেসব পরিবেশ বিষয়ে আমরা বিগত দশক থেকেই সোচ্চার, তার মধ্যে রয়েছে নদী দখল ও দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, এসব সমস্যা এখনো সমস্যাই রয়ে গেছে এবং কাঙ্ক্ষিত সমাধান না আসায় ২০১২ সালেও পরিবেশবাদীদের এসব বিষয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে।
আমার মতে, ২০১১ সালে আলোচিত পরিবেশগত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল ঢাকার নদীগুলোর সীমানা চিহ্নিতকরণে জেলা প্রশাসকদের চাতুর্যপূর্ণ গাফিলতি, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের জন্য বারবার আদালতের কাছে সময়সীমা বাড়ানোর আবেদন, জাহাজভাঙা শিল্প নিয়ন্ত্রণে বিধিমালা প্রণয়নে ও এ শিল্প তদারকিতে সরকারের তীব্র অনীহা, সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ জাতীয় সংসদের পাশ ঘেঁষে মেট্রোরেল স্থাপনের প্রস্তাব ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে আশার চেয়ে হতাশার পরিমাণ বেশি হলেও যে দুটি বিষয়ে জনগণ সামান্য আশার সঞ্চার করেছে তার মধ্যে রয়েছে, অননুমোদিত আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন ও মাটি ভরাট রোধে রাজউকের স্বল্পস্থায়ী অভিযান এবং দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ নিঃসরণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের (প্রয়োগ) নিরলস প্রয়াস। ধারাবাহিকতার অভাবে প্রথম ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ বিষয়ে জনমনে আস্থার সঞ্চার না হলেও শেষোক্ত ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালনাকারী পরিচালকের সততা ও প্রতিশ্রুতির কারণে জনমনে আস্থার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সরকার যদিও আপিল কর্তৃপক্ষ গঠন করে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দূষণকারী বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা থেকে অব্যাহতি দিতে তৎপর, তবু এটি সত্য যে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে পরিচালিত খতিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে বেশ আন্দোলিত করেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি, আমি এ লেখাটি লিখছি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশে বসে। লাউয়াছড়া শুনলেই গহিন প্রাকৃতিক বন; বন্য প্রাণী আর কিছুসংখ্যক বনবাসীর কথা যাদের চোখে ভেসে ওঠে, তাদের জানিয়ে দিতে চাই, বনটি এখন আর আগের মতো নেই। এর এখনকার অবস্থা যৌবন ও মাঝ বয়স পার হয়ে সদ্য বার্ধক্যে পড়া মানুষের মতোই প্রায় সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেললেও সদ্য বার্ধক্যে পড়া মানুষের মতোই নিজেকে আকর্ষণীয় দেখানোর প্রচেষ্টারত। এ বন এখন পর্যটন আকর্ষণের অন্যতম স্থান। একদা রূপবতী এ বনের হূতগৌরব স্মরণ করিয়ে দিতেই যেন বনের ধ্বংসাবশেষকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে বন বিভাগ। বনটি এখন আর বন্য প্রাণীর নয়, বরং পর্যটকদের অভয়ারণ্য, প্রাকৃতিক বনগুলোর সব কটিরই প্রায় এ অবস্থা, সেই ‘গঙ্গা তুমি বইছো কেন?’ গানটির রেশ ধরে আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করে যে সব প্রাকৃতিক বনের এমন করুণ চিত্রের পরও বন বিভাগ কীভাবে নিজের অস্তিত্বের যথার্থতা প্রমাণ করবে?
ঢাকা শহরের ভয়াবহ ব্যস্ততা থেকে কিছুটা প্রশস্তি খুঁজতে এসেছিলাম সিলেটে, প্রায় ১৭ বছর পর জাফলং নদী দেখে মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। শীতকালে পাথরের ওপর বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ নদীটি আর নেই। একটি অর্ধমৃত ঘোলা নদীর দুই পাশে প্রচুর বালু ও পাথর বহনকারী ট্রাক আর নদীর বুকজুড়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব। সরকার এ নদীকে পাথরমহাল ঘোষণার পর থেকেই এ অবস্থা। সৌন্দর্যপিয়াসী পর্যটকেরা নদীর সৌন্দর্যের বিপরীতে দেখে যাচ্ছেন নদীর মৃত্যুদৃশ্য। সুন্দরকে অসুন্দর করতে আমাদের মতো পারদর্শী আর কোনো জাতি কি পৃথিবীতে আছে?
এসব প্রশ্ন যখন আমাকে বিচলিত করছে, তখন একটি সংবাদ পাঠকদের জানাতে চাই। সিলেট শহরের অদূরে লালাখালে বয়ে চলা সারি নদীটি এখনো স্বচ্ছ পানি নিয়ে বয়ে চললেও এ নদীকেও সরকার বালুমহাল ঘোষণা করেছে। ফলে ৭৫ লাখ টাকা ইজারামূল্য পরিশোধ করে এ নদীর তলদেশ থেকে বালু ও কয়লার গুঁড়া তোলার বিনিময়ে এ নদীকে ধীরে ধীরে জাফলংয়ের পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে কি পারি না প্রকৃতির ওপর এমন নগ্ন আগ্রাসন রুখে দিতে?
পরিবেশ ধ্বংসকারী এত সব দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা এবং সুসংহত আন্দোলন গড়ে তোলাই হোক আগামীর সংকল্প!
লেখক: প্রধান নির্বাহী, বেলা।
No comments