কিংবদন্তি কিবরিয়া স্মরণে by সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী
ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে আবার আমরা ২৭ জানুয়ারির দ্বারপ্রান্তে। এইদিনে পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ হারিয়েছিল তার এক অসাধারণ কৃতী সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বহুমুখী প্রতিভা শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়াকে।
একাধারে মেধাবী ছাত্র, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, একজন প্রতিভাদীপ্ত রাজনৈতিক স্ট্রাটেজিস্ট, সফল অর্থমন্ত্রী, জননেতা সর্বোপরি একজন চমৎকার ভদ্রলোক। এক কাপুরুষোচিত গ্রেনেড হামলায় জাতি হারিয়েছিল তার এই কৃতী সন্তানকে। বর্তমান সরকার এই হত্যাকাণ্ডের পুনর্তদন্ত করছে। সবাই আশা করে, প্রকৃত হত্যাকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। বেগম কিবরিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চয়ই তাঁদের শ্রম সার্থক হবে ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে।আমার চার যুগ কিবরিয়া সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরা একগৃহে বসে কাজ করেছি।
১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে আমরা ১৪ জন কূটনীতিক ও কর্মচারী একযোগে বাংলাদেশের প েআমাদের আনুগত্য প্রকাশ করি ও পাকিস্তান দূতাবাস ছেড়ে বাংলাদেশ মিশন গড়ি। কলকাতার বাইরে আর কোথাও এত কূটনীতিক একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের 'বাংলাদেশ মিশনম্ব পশ্চিমা বিশ্বে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও লবিংয়ের কেন্দ্রভূমি হয়েছিল।
মরহুম এনায়েত করীম, মরহুম কিবরিয়া ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের যৌথ নেতৃত্ব দেন। ওয়াশিংটনে আমাদের কাজটা ছিল অত্যন্ত দুরূহ। তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন ও তার সহযোগী ড; কিসিঞ্জার আমাদের স্বাধীনতার তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখেন। কিন্তু আমাদের প্রতি মার্কিন জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ছিল। তাদের এই সমর্থনকে কাজে লাগাতে আমাদের সিনেট, হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সুশীল সমাজে-সর্বোপরি সংবাদ মাধ্যমে লবিং করতে হয়েছে দিনরাত। সারাদিন আমরা কাজ করতাম মিশনে। ছুটতাম ওয়াশিংটনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। সারা আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের সাহায্যে আমরা গড়ে তুল বিভিন্ন লবিং সেন্টার। আমাদের প্রবাসী বাঙালীরা অকান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁরা তাঁদের সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছেন আমাদের স্বাধীনতার প েসমর্থন-সাহায্যের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপ েব্যাপক প্রচার চালানো হয়। বিােভ মিছিল হয় সারা যুক্তরাষ্ট্রে।
এসব কর্মকাণ্ডের মূলকেন্দ্র ছিল আমাদের ১২২৩, কানেকটিকাট এ্যাভিনিউতে অবস্থিত ছোট মিশনটি। আমাদের মিশন খোলার পর এমআর সিদ্দিকী সাহেবকে মিশনপ্রধান করে পাঠায় বাংলাদেশ সরকার। স্ট্রাটেজি সভা বসত মিশনে প্রতি সন্ধ্যায় ও রাতে। এই সভাগুলোতে কিবরিয়া সাহেব আমাদের সঠিক লবিং প্রচেষ্টা চালানোর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিতেন। তাঁর বিশ্লেষণ মতা, জ্ঞানের গভীরতা ও পরিধি দেখে আমরা সত্যিই মুগ্ধ হতাম। দেশপ্রেমী কিবরিয়া সাহেবের মেধা ও কর্মদতা আমাদের অনুপ্রাণিত করত।দেশে ও বাইরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সার্থক হলো। দেশ স্বাধীন হলো। আমাদের ছোট মিশনে মার্কিন বন্ধুরা এলেন। অভিনন্দন জানালেন।
সদ্যস্বাধীন দেশের কিবরিয়া সাহেবের প্রয়োজন। ওয়াশিংটন ছেড়ে বদলি হয়ে গেলেন ঢাকায়। প্রথমে মহাপরিচালক ও পরে সচিব হয়ে কাজ করলেন। মন্ত্রণালয় গঠন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য কাজ করেন নিরলসভাবে। তারপর গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসাবে। সেখান থেকে জেনেভায় স্থায়ী প্রতিনিধি। ফিরে এলেন ঢাকায় ১৯৭৮ সালের শেষার্ধে।
মন্ত্র্রণালয়ে এসেই আমাকে তলব করলেন। ডিরেক্টর (পার্সোন্যাল) হিসাবে দায়িত্ব দিলেন। আরিক অর্থেই সরাসরি বিমানবন্দর থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ করতে বলা হয়েছিল। তিনি বললেন, ঢাকায় আমাকে তিন বছর থাকতে হবে। প্রথম বছর থাকব প্রশাসনের দায়িত্বে, দ্বিতীয় বছর দেখতে হবে বহুপীয় কূটনীতি ও তৃতীয় বছর ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দেখতে হবে। কিবরিয়ার সাহেবের এই নির্দেশের ফলে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। তবে তার সুফল আমি পেয়েছি। আমাদের কূটনৈতিক সার্ভিসের সর্বস্তরে তা আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিবরিয়ার সাহেবের অবদান সর্বেেত্র। আজ আমাদের ক্যাডার সার্ভিস আছে। এই সার্ভিস গঠন করার ব্যাপারে উনি সরাসরি আমাকে নির্দেশ দেন। ছয় পৃষ্ঠার এক প্রতিবেদন নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন। বহু দেনদরবার করে সরকার থেকে আলাদা ক্যাডার সার্ভিস আদায় করেন। তখন সামরিক ও বেসামরিক মন্ত্রণালয়ের সবাই চাচ্ছিলেন যেন আলাদা ফরেন সার্ভিস ক্যাডার না হয় ও তাঁরা আমাদের বিভিন্ন মিশনে নিয়োগ পেতে পারেন। কিবরিয়া সাহেব ক্যাডারদের সদস্য সংখ্যা, পদসমূহ ও অর্গানেগ্রোম আদায় করেন। তারই ভিত্তিতে আজও চলছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মিশনগুলো। মন্ত্রণালয়ের এনেক্স ভবনের প্রস্তাব ও অনুমোদনের জন্য তিনি প্রথম প্রচেষ্টা নেন। সেখান থেকেই চলছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সার্ক গঠনের প্রথম খসড়া প্রস্তাবটি কিবরিয়া সাহেবই তৈরি করেছিলেন। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ঋণ মওকুফ ও বিশেষ সুযোগ সুবিধা কিবরিয়া সাহেব আদায় করছিলেন ৃঋউঊ দেশগুলো থেকে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কিবরিয়া সাহেব নিয়োগ পান ঋওউই ে-এর নির্বাহী পরিচালক হিসাবে ১৯৮১ সালে। ওয়াল্ডহেইম তখন জাতিসংঘের মহাসচিব। আমাদের সরকারী মনোনয়নকে না মেনে আমাদের কিবরিয়া সাহেবকে নিয়োগ দেন খভঢণর ওণডরর্ণটরহ ঐণভণরটফ পদে। কিবরিয়া সাহেবই প্রথম বাংলাদেশী ১১ বছর কাজ করলেন ঋওউই ে -এ অত্যন্ত সফলভাবে। মহাসচিব তাঁকে কাম্পুচিয়ায় তাঁর বিশেষ দূতের দায়িত্ব দেন। ঋওউই ে-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থরার্থে কাজ করলেন, সফল হলেন। আজ উন্নয়নশীল দেশগুলো ঋওউই ে-এ আগের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কিবরিয়া সাহেব ঋওউই েথেকে অবসর নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। ইচ্ছা করলে অনায়াসে খূ ণেভ্রধমভ নিয়ে বিদেশে শেষ জীবন কাটাতে পারতেন।ু কিন্তু দেশপ্রেমী কিবরিয়া সাহেব দেশে ফিরে এলেন। সরাসরি রাজনীতিতে এলেন। আওয়ামী লীগের প্রধান কৌশলী হিসাবে কাজ করলেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ -এর নির্বাচনে বিজয়ী হলো। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিলেন। অর্থনীতি ও বাজেট বানালেন সাধারণ মানুষের জন্য। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ও মুদ্রাস্ফীতি বলিষ্ঠ হাতে আটকালেন। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বহুগুণ বাড়ালেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি একজন অত্যন্ত সফল অর্থমন্ত্রী। তাঁর নীতির ফলে বাজার ছিল স্থিতিশীল। সাধারণ মানুষ তা থেকে উপকৃত হয়েছিল। তারা স্মরণ করবে তাঁর এই বিশেষ অবদান।
২০০১ সালের নির্বাচনে কিবরিয়া সাহেব হবিগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। বিরোধী দলের একজন প্রবীণ নেতা হিসাবে কিবরিয়া সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন। সভানেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসাবে এক নতুন পরিচয়ে এগিয়ে গেল। কিবরিয়া সাহেব চলে গেছেন পাঁচ বছর আগে এইদিনে। কিন্তু তিনি আমাদের দেশের সকল পর্যায়ের মানুষের স্মৃতিতে থাকবেন চিরদিন। এইদিনে ন্যায়বিচার জন্য ও তাঁর আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবে সারা জাতি।
লেখক : সাবেক পররাষ্ট্র সচিব
সব মানুষেরই একটা দিন এবং ণে জন্ম হয়ে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে বলা হয়ে থাকে ণজন্মা। কারণ তাঁরা এমন সব গুণে গুণান্বিত হন এবং তাঁদের দেহ ও মন থেকে যে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে তা অন্য কারও প েকেন যেন শত চেষ্টা সত্ত্বেও অর্জন করা সম্ভব হয় না। এ রকম মানুষকে আবার বলা হয় 'গড গিফ্টেডম্ব বা 'প্রকৃতির দানম্ব। বাংলাদেশের সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শহীদ শাহ্ এএমএস কিবরিয়া ছিলেন বাংলাদেশের জন্য এ রকম একজন 'গড গিফটেডম্ব বিরল ব্যক্তিত্ব। একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, বাংলা ভাষায় যত বিশেষণ আছে তার সব প্রয়োগ করেও কিবরিয়াকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। শিাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এবং পেশাগত জীবনের প্রতিটি ধাপ অতিক্রমণের পরীায় তিনি কখনও দ্বিতীয় হননি। তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে সিএসপি পরীায়ও প্রথম হয়েছিলেন। অর্থনীতিতে সম্মান ও এমএ পরীায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু থেকেই ছিল বর্ণাঢ্য। নিজস্ব পেশার সর্বোচ্চ পদ পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন দুম্ববার। জনাব কিবরিয়াই একমাত্র বাঙালী যিনি ইউএনওর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে উন্নীত হয়েছিলেন তাঁর তী্ন মেধা ও অসাধারণ মানবিক গুণাবলীর জন্য। আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করে যে সুযোগ সুবিধা পেয়েছিলেন তা দিয়ে তিনি ইউরোপ-আমেরিকার যে কোন দেশে অনায়াসে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি না করে নিজ জন্মভূমিতেই রয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন একেবারে সাধারণ, মিশে গেলেন বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বখ্যাত ঝানু আমলা থেকে নিজেকে রূপান্তরিত করলেন একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ হিসেবে। যে আদর্শের বড় অভাব আজ বাংলাদেশে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের নির্বাচনে তাঁর দল আওয়ামী লীগের ভূমিধস পরাজয় সত্ত্বেও জনাব কিবরিয়া নিজ এলাকা হবিগঞ্জ থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। কারণ তিনি যে আলো এলাকার মানুষের ভেতর ছড়াতে পেরেছিলেন, সে আলোর দ্বারাই এলাকার মানুষ দেখতে পেয়েছিল প্রকৃত একজন জনদরদী কিবরিয়াকে। তাই সালশা নির্বাচনের কুশীলবরা শত চেষ্টা করেও সে নিখাদ আলোর ওপর কোন রকম ছায়া ফেলতে সম হয়নি। হতে পারে এটাই তাঁর মৃতু্যর প্রধান কারণ। কিবরিয়া ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে একজন অজাতশত্রু লোক। কেউ তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে শুনেছেন বলে জানা যায় না। দলমত, পজিশন-অপজিশন, প্রতিপ-প্রতিদ্বন্দ্বী কারও প্রতি তিনি কখনও রুচিহীন তো দূরের কথা, অসংসদীয় ভাষায় কথা বলেছেন এমনটিও শোনা যায় না। এমন একজন মানুষকে কেন বিগত জামায়াত-বিএনপি সরকারের আমলে ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি তাঁরই নির্বাচনী এলাকায় গ্রেনেড মেরে হত্যা করা হলো? এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনও হয়নি। তবে এ জঘন্য হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। যদি সঠিক তদন্ত হয়ে সঠিক বিচারটি হতে পারে, তাহলে হয়ত একদিন এ দেশের মানুষ জানতে পারবে কারা এবং কি কারণে এমন একজন আলোকিত ও পণ্ডিত মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এ রকম জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার-তো আরও পরের কথা তদন্ত কাজটি আজ ৫ বছরেও সম্পূর্ণ হলো না। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রধান প্রতিবেদনে দেখা গেল কিবরিয়া হত্যার পরপর তখন উচ্চ পর্যায়ের একটা তদন্ত হয়েছিল। ওই রিপোর্টের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখন জমাও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সে রিপোর্টের কপি নাকি এখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেই, সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি (তখনকার) যিনি তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন তার অফিসেও কোন কপি নেই। এমনকি, সিআইডির কার্যালয়ে মামলার মূল যে নথি (ডকেট) আছে, তাতেও তদন্ত প্রতিবেদন নেই। কি আশ্চর্য বিষয়! এ জন্যই বাংলাদেশকে বলা হয সব সম্ভবের দেশ। আর এ সব সম্ভবের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে। তখন একজন মতায় বসে বলেছিলেন ১৫ আগস্টের খুনীদের কোন বিচার করা যাবে না। তাদেরকে পুরস্কার দেয়া হবে। চাকরিতে তাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হবে। করা হলোও ঠিক তা-ই। শুধু সে পর্যন্ত যেয়েই ান্ত হলেন না, একজন সামরিক শাসক তামাশার হঁ্যা/না-এর ভোট করলেন, ইচ্ছামতো সিল মেরে একটা রাজনৈতিক দলের জন্মের ছয় মাসের মাথায় ৩০০ আসনের মধ্যে ২০৯টি আসন দখল করলেন, সে সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী নামে চিরস্থায়ী আইন করলেন যে, ওই ১৫ আগস্টের খুনীদের সারাজীবনেও কেউ বিচার করতে পারবে না। খুনীদের জন্য এত যখন আদর-আপ্যায়ন, তখন সে শাসকের সময় বাংলাদেশের সকল মানুষ খুনী হয়ে গেল না কেন? সভ্য দেশের একজন নাগরিকের মনে এমন প্রশ্ন উদয় হলে তাকে একেবারে অমূলক বলা যাবে না। কিন্তু কথায় বলে, ুটভ যরমযম্রণ্র, ঐমঢ ঢধ্রযম্রণ্র। সে স্বৈরশাসকও খুন হয়েছেন অন্য খুনীদের হাতে, কিন্তু আজও তার কোন বিচার হয়নি, বলা যায় বিচার কেউ চায়নি, তার পুত্রপরিজনও না। একেই বলে নিয়তির নির্মম পরিহাস। তবে ১৫ আগস্টের খুনীদের বিচার হয়েছে। বাংলার ১৫ কোটি মানুষ এখন তাকিয়ে আছে কখন ওই খুনীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবে। শোনা যায় জনাব কিবরিয়াকে গ্রেনেড মারা হয়েছিল ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি ঠিক সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়। তাঁর সঙ্গী চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যান। কিবরিয়াকে গুরুতর আহত অবস্থায় একটা এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় আনা হয়েছিল। কিন্তু সুদূর হবিগঞ্জ থেকে এ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে যখন পেঁৗছল, তখন সব শেষ। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মন্তব্য ছিল, আরও কিছু সময় আগে যদি তারা কিবরিয়াকে পেতেন তাহলে হয়ত তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সারা পৃথিবীতে যাঁর চিকিৎসা ছিল অবাধ ও বিনামূল্যে, তারই বাংলাদেশে মৃতু্য হলো বিনা চিকিৎসায়। হবিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতে ৩/৪ ঘণ্টা যে সময় লেগেছে তাতেই অতিরিক্ত রক্তরণে মারা গেছেন তিনি। তিনি তখন সিটিং এমপি। তাঁরমতো একজন মানুষকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করার জন্য রাষ্ট্র থেকে কোন হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হলো না। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাহলে বাংলাদেশে হেলিকপ্টার দিয়ে হবেটা কি? এ-নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর পুনরায় রাষ্ট্র মতায় ফিরে আসায় তাদের হিসাব কিতাব সব উল্টে যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লবীরা যদি মতা পুনর্দখল করতে পারে তাহলে প্রগতিশীলদের পুনরায় রাষ্ট্রীয় মতায় ফিরে আসার উদাহরণ বিরল। কিন্তু আওয়ামী লীগ শুধু মতাই ফিরে আসেনি, তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে ভাল পারফরমেন্সের সরকার ছিল। এ সফলতায় অন্যদের সঙ্গে ওই সময়ের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়ার অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। পঁচাত্তরের পর সর্বোচ্চ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭%, মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বনিম্ন পর্যায়ে। পাঁচটি বছর যাবত দ্রব্যমূল্য ছিল সম্পূর্ণ স্থিতিশীল। দেশ খাদ্যে প্রথমবারের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছিল। দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকের সংখ্যা নেমে এসেছিল ৫৫% থেকে ৪৪% এ। এমন করিৎকর্মা ও মেধাবী মানুষটি যদি পুনরায় আওয়ামী লীগ মতায় আসলে অর্থমন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে ওই জঙ্গি ও ধর্মান্ধ হত্যাকারীদের জায়গা আর বাংলাদেশের কোন স্থানেই হবে না। কারণ জঙ্গি ধর্মান্ধদের যে অপআদর্শ, তার প্রধান উপজীব্য হলো দারিদ্র ও অশিা-কুশিা। কিবরিয়ার মতো মানুষ বেঁচে থাকলে বাংলার মানুষ অদূর ভবিষ্যতেই ওসব অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। জঙ্গী-ধর্মান্ধরা এ সত্যটি বুঝতে পেরেছিল। তাই ব্রিলিয়ান্ট কিবরিয়াকে তারা আর বাঁচিয়ে রাখেনি। এ হত্যাকারীরা ১৯৯৯ সালে ৬ মার্চ যশোরে উদীচী অনুষ্ঠানে বোমা-গ্রেনেড হামলার ভেতর দিয়ে শুরু করে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি কিবরিয়া হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত মোট ১১টি ভয়াবহ বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। তাতে মোট নিহত হয়েছেন ১১৩ জনের উর্ধে, আহত ও পঙ্গু হয়েছেন শত শত নিরীহ ও সজ্জন মানুষ। দেরিতে হলেও এসব হত্যাকারীরা আজ চিহ্নিত। অনেকেই স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তার মধ্যে প্রধান স্বীকারোক্তি দিয়েছেন হুজি নেতা মুফতি হান্নান। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আব্দুস ছালাম পিন্টু, তার ভাই তাজউদ্দিন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অভিযুক্ত হয়ে জেলে আছেন। এদের ওপরে গডফাদার হিসেবে নাম আসছে হাওয়া ভবন ও তার কর্ণধার তারেক জিয়ার। এ মুর্খ, ধর্মান্ধরা মানুষ হত্যা করে সব কিছু স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ অন্ধকারের কীটরা জানে না যে, মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অত্যাচার, নির্যাতন আর মানুষ হত্যা করে কোন আদর্শকে দাবিয়ে রাখা যায়নি, আর যাবেও না। আর সে আদর্শের মূলমন্ত্র যদি হয় মানবতা, গণতন্ত্র এবং প্রগতি। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত দিয়ে পরাজিত করেছিল ৯৩ হাজার পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে। এ মন্ত্র বাঙালীর নতুন প্রজন্মের ভেতরও যে প্রবেশ করেছে তার প্রমাণ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফল। তারা সব মিথ্যাচার ও হত্যাকারীদের ভূপাতিত করেছে। এখন শুধু অপো চূড়ান্ত বিজয়ের। মানবতা, গণতন্ত্র ও প্রগতির ঝাণ্ডাবাহী দল আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্র মতায়। দেশের মানুষের দাবি, আশা ও আকাঙ্া সবই এখন আওয়ামী লীগের ওপর। আওয়ামী লীগকে অবশ্যই সময়ের দাবির যে চ্যালেঞ্জ তা সফলভাবে মোকাবেলা করতে হবে। হত্যা মানুষকে অন্ধকার গলির ভেতর নিয়ে যায়। আর সেই হত্যার বিচার মানুষকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনে। আশা করা যায় অচিরেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবে। কিবরিয়া হত্যাসহ অন্যান্য সকল হত্যার বিচার করে বর্তমান সরকার দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাবে। তবে কাজটি যে সহজ নয়, তার আলামত আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পারছি। ২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামিদের বিএনপি তাদের দলে উঁচু পদে স্থান দিয়েছে। যথারীতি গোয়েবলসীয় ধুয়া তোলা শুরু হয়েছে যে, তাদের নেতাদের অযথা রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করা হচ্ছে। তবে ২০০১ থেকে ২০১০-এর পার্থক্য অনেক বেশি। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও বর্তমান সময়ে প্রবলভাবে বিস্তৃত কানেকটিভিটি সকল মিথ্যাচারকে উন্মোচন করে দেবে। গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতি ধারার সকল শক্তি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এক হয়ে ওসব অপশক্তির বিরুদ্ধে গণজাগরণ গড়ে তুলতে হবে। এটাই এখন সময়ের দাবি।
No comments