উন্নয়ন-কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে এশিয়ার অগ্রগতি by গওসল আযম
১৯২১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের আবির্ভাব এবং পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে এর সম্প্রসারণ সারাবিশ্বকে হতচকিত করেছে। ধনবাদী রাষ্ট্রগুলোর নেতারা মার্কসবাদের গোড়াপত্তন এবং সম্প্রসারণকে পুঁজিবাদের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বৈরী আচরণ করেছে।
জন্ম হয়েছে স্নায়ুযুদ্ধের। ফলে ধনবাদী শিবির এবং সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতায় উভয় শিবিরের অন্তর্গত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সমাজের নিচু স্তরের লোকেরা হয়েছে মানবিক অধিকারবঞ্চিত। সমাজবাদী দেশগুলো মানুষের কর্মের অধিকার গ্রহণ করায় খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে শতাব্দী প্রাচীন অচলায়তন ভেঙে মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ১৯৬০-এর দশকে আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক তুখোড় ছাত্র যুগীনগরের বা কাপ্তানবাজারের অন্ধকার গলিতে গভীর রাতে আবদুল হক আর তোয়াহা কী বলেন শোনার জন্য সমবেত হয়েছে। ঢাকার বেশ কিছু দেয়ালে লেখা হয়েছে, মাও সে তুং আমাদের চেয়ারম্যান। পশ্চিমবঙ্গেও এর অন্যথা হয়নি বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। পশ্চিমের ধনবাদী দুনিয়া মার্কসবাদের উত্থান এবং সম্প্রসারণের কারণগুলো খুঁজে বের করে মার্কসবাদকে ঠেকানোর জন্য গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের কথা চিন্তায় ও চেতনায় এনে কিছু প্রক্রিয়া গ্রহণ শুরু করে। ব্রিটেন ১৯৪৮ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা চালু করে। ইউরোপের অন্য রাষ্ট্রগুলোও গণকল্যাণমুখী বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আমেরিকা সৃষ্টি করে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে জল ঢেলে তাকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করেছে। এখন এই কল্যাণ রাষ্ট্রের দর্শন থেকে তাদের ফিরে আসার আর কোনো উপায় আছে বলে মনে হয় না। তাই তাদের বাজেট ঘাটতির পরিমাণ উত্তরোত্তর না বাড়ালেও, কমানোর প্রচেষ্টা হবে অত্যন্ত জটিল। এই জটিলতার সম্মুখীন গ্রিস, ইতালি, স্পেন এবং স্বয়ং আমেরিকা।
বছরের পর বছর ধরে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি উলেল্গখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যের দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এশিয়ার এই সমৃদ্ধি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। এ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের প্রাপ্তির প্রত্যাশারও বৃদ্ধি ঘটেছে। তারা এখন দাবি করছে অবসরভাতা, স্বাস্থ্য বীমা, বেকারভাতা, অবৈতনিক শিক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা। বিগত অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়া ১৯১৪ সালের মধ্যে সবাইকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মাত্র দুই বছরে চীন তার ২৪ কোটি গ্রামীণ লোককে অবসরভাতার সুবিধা দিয়েছে, যা আমেরিকার সমগ্র অবসরভাতার আওতাধীন জনগণের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কয়েক বছর আগেও চীনের শতকরা ৮০ ভাগ লোক স্বাস্থ্য বীমা খাতের বাইরে ছিল। এখন চীনের প্রতিটি লোক স্বাস্থ্য বীমার আওতায়। ভারত ৪ কোটি গৃহকে বছরে নিম্নতম মজুরির ভিত্তিতে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান করে। স্বাস্থ্য বীমার আওতায় এনেছে ১১ কোটি লোক, যা আমেরিকার স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনীত লোকের চেয়ে দ্বিগুণ। ইউরোপে জার্মান কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে ১৮৮০ সালে অবসরভাতা প্রদানের মাধ্যমে। আর ব্রিটেন ১৯৪৮ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ইউরোপে ১৯৪৮ সালকেই কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি বছর মনে করেন। ১৯৪৮ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রের রীতিনীতির উন্নয়ন ঘটিয়ে এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছে যে ইউরোপিয়ানরা মনে করে, ইউরোপের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কল্যাণ রাষ্ট্র। আর কল্যাণ রাষ্ট্র হতে গিয়ে তাদের অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। এশিয়ার কিছু দেশ তা করতে সময় নেবে মাত্র একটি যুগ বা তার কিছু বেশি। তবে তারা সাধ্যের বাইরে গিয়ে কল্যাণমুখিনতার বাস্তবায়ন করতে গেলে তাদের অর্থনীতির অগ্রসরমানতা ব্যাহত হবে। অর্থনীতি পড়বে মুখ থুবড়ে। তবে বর্তমানে যে ধারায় এশিয়ার ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, তাতে তারা গণকল্যাণকামিতার ব্যাপারে অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপকে ডিঙিয়ে যাবে বলে পাশ্চাত্য পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে।
২০১১ সালের অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার আইনসভা-সংসদ এই মর্মে একটা বিল পাস করে যে, সরকার ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে তাদের দেশের প্রত্যেক নাগরিককে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসবে (ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানে ২৪ কোটি)। একই সংসদ আরও একটি আইন পাস করে, যার উদ্দেশ্য দেশের প্রত্যেকের জন্য অবসরভাতা, মরণোত্তর সুবিধা এবং শ্রমিকদের দুর্ঘটনা বীমার আওতায় আনা, যা ২০১৫ সালের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ৯০ লাখ কর্মচারী এ ধরনের সুবিধা ভোগ করেন। এই সুবিধাদি সর্বজনীন করার জন্য যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাংকের গরঃপযবষষ ডরবহবৎ-এর হিসাব অনুযায়ী মজুরির (ডধমবং) শতকরা ১৮ ভাগ আদায় করতে হবে, যা সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কা। অন্য কথায়, আইন করা সহজ, কিন্তু তা কার্যকর করা কঠিন।
বাংলাদেশ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করে চলেছে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারি অর্থানুকূল্যে। গ্রামের প্রতিটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হলে তাদের প্রত্যেককেই প্রতি মাসে উলেল্গখযোগ্য পরিমাণ চাল বা গম দেওয়া হয়। আবার গ্রামের প্রতিটি দরিদ্র ছেলের জন্য রয়েছে স্কুলভাতা। বর্তমানে সরকার প্রবর্তিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতার পরিমাণও উলেল্গখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে দুস্থ মাতা ভাতা। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভাতা। সর্বসাধারণের চিকিৎসার জন্য সরকার যে ব্যয় করে তাও গণকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করে চলেছে। তবে কল্যাণমুখিনতায় সরকারি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপচয় হয় দুর্নীতির কারণে। দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে বা নিম্নতম পর্যায়ে আনা গেলে, গণকল্যাণমুখিনতার গতি নিঃসন্দেহে আরও বেগবান হবে।
জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ছাড়াও, ফিলিপাইন তাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফিলিপাইনের ৮৫ ভাগ মানুষ ফিল হেলথের সদস্য। এই ফিল হেলথ সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য বীমা। ২০১০ সালে ফিল হেলথের সদস্য সংখ্যা ছিল শতকরা ৫২ ভাগ। ২০০৩ সালে সক্ষম জনগণের মাত্র ৩ ভাগ ছিল ফিল হেলথের সদস্য। বর্তমানে ৯৭ ভাগ।
কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করে সুসংহত করার লক্ষ্যে এশিয়া স্বাস্থ্য খাতের বাইরের অনেক খাতে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। থাইল্যান্ড ২০০১ সালে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছে। একই বছরের মে মাসে ইনফরমাল সেক্টরে চালু করেছে অবসরভাতা। গত মাসে চীনের ন্যাশনাল অডিট অফিস ঘোষণা করেছে দেশের প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবলয়ের আওতাধীন। ২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সর্বজনীন বয়স্কভাতা এবং স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। যে সিঙ্গাপুর কল্যাণ রাষ্ট্রকে পৎঁঃপয বপড়হড়সু হিসেবে অবহিত করত, সে সিঙ্গাপুর এখন নিম্ন আয়ের লোকদের কর অব্যাহতির ছদ্মনামে নগদ টাকা প্রদান করছে। নিম্ন ভাড়ায় বা নামমাত্র ভাড়ায় দিচ্ছে বাসস্থান।
এশিয়ায় কল্যাণ রাষ্ট্রের বিনির্মাণের সারসংক্ষেপ করেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক। এ সারসংক্ষেপের পদ্ধতি হচ্ছে গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে ভোক্তা সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা। ফলাফল প্রতি ভোক্তা বা বেনিফিসিয়ারি ব্যক্তি প্রতি জাতীয় আয়ের শতকরা কতভাগ ভোগ করল বা পেল। এই পদ্ধতিতে জাপানের গণকল্যাণমুখী বেনিফিশিয়ারি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের শতকরা ১৩ ভাগ ভোগ করে। দুই যুগ পরেও দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বেনিফিশিয়ারি ভোগ করে শতকরা ৭.১ ভাগ। গণকল্যাণমুখী ব্যয়ের প্রতি বেনিফিশিয়ারি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের যে অংশ বা শেয়ার ভোগ করে, তা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমৃদ্ধ তথ্য প্রবাহের জন্য মোটামুটি নির্ণয় করা গেলেও অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সম্ভব না-ও হতে পারে। সিংহভাগ ক্ষেত্রে কল্যাণমুখী ব্যয় নিম্নতম আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ বা তার বেশি লোকের জন্য হলেও, তাদের অন্যদের থেকে পৃথক করা বেশ কঠিন। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় যারা মুক্ত অর্থাৎ বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য বীমার আওতায় তাদের শতকরা ৫০ ভাগ, নিম্নতম ৩০ ভাগ আয়ের অন্তর্গত নয়। আবার বিনিময়ে কোনো কিছু না দিয়ে রাজস্ব থেকে গাড়ির জ্বালানির জন্য যে ব্যয় তা ধনীরাই ভোগ করে। ১৯১১ সালে সরকারের এই ব্যয় স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৯ গুণ। এশিয়ায় গণকল্যাণমুখী ব্যয়ের পরিমাণ সরবরাহভিত্তিক না হয়ে চাহিদাভিত্তিক। কারণ, গণকল্যাণমুখিনতা নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। দেশের আয়ের ওপর নয়। তবুও আয় দিয়েই ব্যয় নির্বাহের জন্য জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিকল্প নেই।
গওসল আযম : সাবেক মহাসচিব আইবিবি ও কলামিস্ট
বছরের পর বছর ধরে এশিয়ার প্রবৃদ্ধি উলেল্গখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্যের দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এশিয়ার এই সমৃদ্ধি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। এ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের প্রাপ্তির প্রত্যাশারও বৃদ্ধি ঘটেছে। তারা এখন দাবি করছে অবসরভাতা, স্বাস্থ্য বীমা, বেকারভাতা, অবৈতনিক শিক্ষা এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা। বিগত অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়া ১৯১৪ সালের মধ্যে সবাইকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মাত্র দুই বছরে চীন তার ২৪ কোটি গ্রামীণ লোককে অবসরভাতার সুবিধা দিয়েছে, যা আমেরিকার সমগ্র অবসরভাতার আওতাধীন জনগণের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কয়েক বছর আগেও চীনের শতকরা ৮০ ভাগ লোক স্বাস্থ্য বীমা খাতের বাইরে ছিল। এখন চীনের প্রতিটি লোক স্বাস্থ্য বীমার আওতায়। ভারত ৪ কোটি গৃহকে বছরে নিম্নতম মজুরির ভিত্তিতে ১০০ দিনের কর্মসংস্থান করে। স্বাস্থ্য বীমার আওতায় এনেছে ১১ কোটি লোক, যা আমেরিকার স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনীত লোকের চেয়ে দ্বিগুণ। ইউরোপে জার্মান কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে ১৮৮০ সালে অবসরভাতা প্রদানের মাধ্যমে। আর ব্রিটেন ১৯৪৮ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ইউরোপে ১৯৪৮ সালকেই কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তি বছর মনে করেন। ১৯৪৮ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো কল্যাণ রাষ্ট্রের রীতিনীতির উন্নয়ন ঘটিয়ে এমন একটি পর্যায়ে চলে গেছে যে ইউরোপিয়ানরা মনে করে, ইউরোপের প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই কল্যাণ রাষ্ট্র। আর কল্যাণ রাষ্ট্র হতে গিয়ে তাদের অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় অতিক্রম করতে হয়েছে। এশিয়ার কিছু দেশ তা করতে সময় নেবে মাত্র একটি যুগ বা তার কিছু বেশি। তবে তারা সাধ্যের বাইরে গিয়ে কল্যাণমুখিনতার বাস্তবায়ন করতে গেলে তাদের অর্থনীতির অগ্রসরমানতা ব্যাহত হবে। অর্থনীতি পড়বে মুখ থুবড়ে। তবে বর্তমানে যে ধারায় এশিয়ার ভারত, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান এবং বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছে, তাতে তারা গণকল্যাণকামিতার ব্যাপারে অল্প সময়ের মধ্যে ইউরোপকে ডিঙিয়ে যাবে বলে পাশ্চাত্য পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে।
২০১১ সালের অক্টোবরে ইন্দোনেশিয়ার আইনসভা-সংসদ এই মর্মে একটা বিল পাস করে যে, সরকার ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে তাদের দেশের প্রত্যেক নাগরিককে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসবে (ইন্দোনেশিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানে ২৪ কোটি)। একই সংসদ আরও একটি আইন পাস করে, যার উদ্দেশ্য দেশের প্রত্যেকের জন্য অবসরভাতা, মরণোত্তর সুবিধা এবং শ্রমিকদের দুর্ঘটনা বীমার আওতায় আনা, যা ২০১৫ সালের জুলাই থেকে কার্যকর হবে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ৯০ লাখ কর্মচারী এ ধরনের সুবিধা ভোগ করেন। এই সুবিধাদি সর্বজনীন করার জন্য যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে বিশ্বব্যাংকের গরঃপযবষষ ডরবহবৎ-এর হিসাব অনুযায়ী মজুরির (ডধমবং) শতকরা ১৮ ভাগ আদায় করতে হবে, যা সম্ভব না হওয়ার আশঙ্কা। অন্য কথায়, আইন করা সহজ, কিন্তু তা কার্যকর করা কঠিন।
বাংলাদেশ কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করে চলেছে। বর্তমানে দেশের ৯০ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারি অর্থানুকূল্যে। গ্রামের প্রতিটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হলে তাদের প্রত্যেককেই প্রতি মাসে উলেল্গখযোগ্য পরিমাণ চাল বা গম দেওয়া হয়। আবার গ্রামের প্রতিটি দরিদ্র ছেলের জন্য রয়েছে স্কুলভাতা। বর্তমানে সরকার প্রবর্তিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতার পরিমাণও উলেল্গখযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে দুস্থ মাতা ভাতা। অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভাতা। সর্বসাধারণের চিকিৎসার জন্য সরকার যে ব্যয় করে তাও গণকল্যাণকামী রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করে চলেছে। তবে কল্যাণমুখিনতায় সরকারি ব্যয়ের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অপচয় হয় দুর্নীতির কারণে। দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে বা নিম্নতম পর্যায়ে আনা গেলে, গণকল্যাণমুখিনতার গতি নিঃসন্দেহে আরও বেগবান হবে।
জাপান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ ছাড়াও, ফিলিপাইন তাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নের জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফিলিপাইনের ৮৫ ভাগ মানুষ ফিল হেলথের সদস্য। এই ফিল হেলথ সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য বীমা। ২০১০ সালে ফিল হেলথের সদস্য সংখ্যা ছিল শতকরা ৫২ ভাগ। ২০০৩ সালে সক্ষম জনগণের মাত্র ৩ ভাগ ছিল ফিল হেলথের সদস্য। বর্তমানে ৯৭ ভাগ।
কল্যাণ রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সম্প্রসারিত করে সুসংহত করার লক্ষ্যে এশিয়া স্বাস্থ্য খাতের বাইরের অনেক খাতে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। থাইল্যান্ড ২০০১ সালে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছে। একই বছরের মে মাসে ইনফরমাল সেক্টরে চালু করেছে অবসরভাতা। গত মাসে চীনের ন্যাশনাল অডিট অফিস ঘোষণা করেছে দেশের প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবলয়ের আওতাধীন। ২০০৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া সর্বজনীন বয়স্কভাতা এবং স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছে। যে সিঙ্গাপুর কল্যাণ রাষ্ট্রকে পৎঁঃপয বপড়হড়সু হিসেবে অবহিত করত, সে সিঙ্গাপুর এখন নিম্ন আয়ের লোকদের কর অব্যাহতির ছদ্মনামে নগদ টাকা প্রদান করছে। নিম্ন ভাড়ায় বা নামমাত্র ভাড়ায় দিচ্ছে বাসস্থান।
এশিয়ায় কল্যাণ রাষ্ট্রের বিনির্মাণের সারসংক্ষেপ করেছে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক। এ সারসংক্ষেপের পদ্ধতি হচ্ছে গণকল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে ভোক্তা সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা। ফলাফল প্রতি ভোক্তা বা বেনিফিসিয়ারি ব্যক্তি প্রতি জাতীয় আয়ের শতকরা কতভাগ ভোগ করল বা পেল। এই পদ্ধতিতে জাপানের গণকল্যাণমুখী বেনিফিশিয়ারি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের শতকরা ১৩ ভাগ ভোগ করে। দুই যুগ পরেও দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বেনিফিশিয়ারি ভোগ করে শতকরা ৭.১ ভাগ। গণকল্যাণমুখী ব্যয়ের প্রতি বেনিফিশিয়ারি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের যে অংশ বা শেয়ার ভোগ করে, তা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমৃদ্ধ তথ্য প্রবাহের জন্য মোটামুটি নির্ণয় করা গেলেও অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে সম্ভব না-ও হতে পারে। সিংহভাগ ক্ষেত্রে কল্যাণমুখী ব্যয় নিম্নতম আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ বা তার বেশি লোকের জন্য হলেও, তাদের অন্যদের থেকে পৃথক করা বেশ কঠিন। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় যারা মুক্ত অর্থাৎ বিনা পয়সায় স্বাস্থ্য বীমার আওতায় তাদের শতকরা ৫০ ভাগ, নিম্নতম ৩০ ভাগ আয়ের অন্তর্গত নয়। আবার বিনিময়ে কোনো কিছু না দিয়ে রাজস্ব থেকে গাড়ির জ্বালানির জন্য যে ব্যয় তা ধনীরাই ভোগ করে। ১৯১১ সালে সরকারের এই ব্যয় স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের ৯ গুণ। এশিয়ায় গণকল্যাণমুখী ব্যয়ের পরিমাণ সরবরাহভিত্তিক না হয়ে চাহিদাভিত্তিক। কারণ, গণকল্যাণমুখিনতা নির্ভর করে রাজনীতির ওপর। দেশের আয়ের ওপর নয়। তবুও আয় দিয়েই ব্যয় নির্বাহের জন্য জাতীয় প্রবৃদ্ধির বিকল্প নেই।
গওসল আযম : সাবেক মহাসচিব আইবিবি ও কলামিস্ট
No comments