বাহরাইনে আগুনে পুড়ে ॥ হত ১০ বাংলাদেশী- ০ এখনও নিখোঁজ ২০- ০ শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত by আজিজুর রহমান
ভাগ্যবদলাতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ বাহরাইনে গিয়ে আগুনে পুড়ে লাশ হতে হলো ১০ বাংলাদেশী শ্রমিককে। রাজধানী মানামার মুখারকা এলাকায় অনুমোদনহীন একটি তিন তলা বাড়িতে শুক্রবার বিকেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে এই ১০ প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে।
বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব মহিদুল ইসলাম (শ্রম) প্রথম জানিয়েছেন, নিহত ১৩ জনের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় এবং তা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। খবর এএফপি, বিবিসি, গালফ নিউজ ও গালফ ডেইলি অন লাইনের। বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স খলিফা বিন সালমান আল খলিফা আহতদের সুচিকিৎসার পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি নিহতদের পরিবারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। গালফ ডেইলি নিউজের খবরে বলা হয়েছে, আগুন লাগার পরপরই দমকলকর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আরও বড় ধরনের বিপত্তি ঘটতে পারত। কেননা অগ্নিদগ্ধ ভবনটির পাশেই বাঙালী পল্লী নামে আরেকটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল। দমকলকর্মীরা দ্রুত সাড়া দেয়ার কারণে আগুন ঐ পল্লীতে ছড়াতে পারেনি। হতাহতদের বেশিরভাগই ফ্রি-ভিসায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত থেকে গিয়েছিল। আগুন লাগার কারণ উদঘাটনের জন্য সে দেশের সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।আগুন লাগার পরপরই উদ্ধারকর্মীরা ঘনকালো ধোঁয়ার মধ্যেই ভবনের ভিতর ঢুকে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। দমকলকর্মী ও উদ্ধারকর্মীরা আহত অবস্থায় অনেককে উদ্ধার করেছেন। অনুমোদনহীন এই ভবনটিতে ২৮টি কক্ষে ফ্রি ভিসায় আসা শ্রমিকরা বসবাস করতেন এবং এর মধ্যে ২৫টিতেই বাংলাদেশী আর বাকি ৩টিতে ভারতীয় ও পাকিস্তানীরা থাকতেন। প্রতিটি কক্ষে ৭ থেকে ১০ জন করে শ্রমিক গাদাগাদি করে বসবাস করতেন।
বাহরাইনের দমকল বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, শুক্রবার বিকেল ৩টা ৪৪ মিনিটে আমরা আগুন লাগার খবর পাই এবং খবর পাওয়ার মাত্র ৬ মিনিটের মাথায় ৩টা ৫০ মিনিটে দমমকলকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। তারা বহু মানুষকে উদ্ধার করেছে। ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই। অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনের ছাদ ধসে পড়লে কয়েকজন দমকলকর্মী আহত হয়। দমকল বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, আমরা লাশগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছি। অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিদগ্ধ ১৩টি লাশ সালমানিয়া মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়।
আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু হয়েছে। বাহরাইনের লোক সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এ দেশের অর্থনীতি মূলত বিদেশী শ্রমিকনির্ভর। ২০১০ সালের শুমারি অনুযায়ী দেশটিতে ৬ লাখ ৬০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক কাজ করছে।
বাহরাইনে শ্রমিকদের ক্যাম্পে এটি এ ধরনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এর আগে ২০০৬ সালের গুদাইবিয়া এলাকায় শ্রমিকদের ক্যাম্পে এক অগ্নিকাণ্ডে ১৬ শ্রমিক নিহত হন। ভবনটির একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, ওই ভবনে ২৮টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি কক্ষে পাকিস্তানী শ্রমিকরা থাকতেন। আর বাকি কক্ষগুলোতে থাকতেন বাংলাদেশী শ্রমিকরা।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, প্রথম দেখার পর খুব একটা গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই দেখি ভবনের ভেতর থেকে ঘনকালো ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং এটি দেখার পরই আগুনের ব্যাপকতা বুঝতে পারি। ঘটনার পরপরই স্থানীয় কয়েকজন ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয় এবং মুহূর্তের মধ্যে দমকলবাহিনীর একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে আসে, সঙ্গে একাধিক এ্যাম্বুলেন্স। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘনকালো ধোঁয়ার মধ্যেই দমকলকর্মীরা ভবনটির ভিতরে ঢুকে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। আগুন এতটাই দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ছিল যে কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন গোটা ভবনকে গ্রাস করে ফেলে। ঘটনার পর পরই পুলিশ ভবনটির চারপাশ ঘিরে ফেলে। শুক্রবার রাতেই বাহরাইনে পাকিস্তান দূতাবাস আগুনে হতাহতদের চিহ্নিত করার জন্য তার দেশের নাগরিকদের সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে বিবিসি’র খবরে বলা হয়েছে, ঐ ভবনটি পাকিস্তানীরাই ভাড়া নিয়েছিল এবং শ্রমিক শ্রেণীর লোকজনই সেখানে বসবাস করত।
নিহত ১০ বাংলাদেশীর পরিচয় ॥ এদিকে কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, বাহরাইনে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে এখনও ২০ ব্যক্তি নিখোঁজ রয়েছে। নিহত ১০ হতভাগ্য বাংলাদেশীর পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন সাগীর আহমেদ, পিতা : নাজির আহমেদ, গ্রাম : চর খিজিরপুর, থানা : বোয়ালখালী, জেলা : চট্টগ্রাম। জসিম মিয়া, পিতা : নাসের মিয়া, গ্রাম : গোয়ালি, থানা : নবীনগর, জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আপন সহোদর স্বপন ও সাইফুল, পিতা : মৃত শহীদ মিয়া, গ্রাম : কাইতলা, থানা : নবীনগর, জেলা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া। মাহবুব আলম, পিতা : হাজি রশীদ আহমেদ, গ্রাম : বতুয়া, থানা : পটিয়া, জেলা : চট্টগ্রাম। জামাল, পিতা : আব্দুল আজিজ, গ্রাম : মারিপারা, থানা : পটিয়া, জেলা : চট্টগ্রাম। সহোদর দুই ভাই শাহাদত ও টিটু মিয়া, পিতা : আলম, গ্রাম : নওপাড়া, থানা : কচুয়া, জেলা : চাঁদপুর। মোহাম্মদ আনোয়ার, পিতা : আবুল বাশার, গ্রাম : গুড়িগ্রাম, থানা : নবীনগর, জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ওসমান গনি, পিতা : আব্দুর রহিম, গ্রাম : কাশিপুর, থানা : সোনাইমুড়ি, জেলা : নোয়াখালী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অগ্নিকা-ের পরপরই বাহরাইনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সময়ে সময়ে ঢাকায় ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। অগ্নিকা-ের পর পর ভবনের ছাদ ধসে পড়ে।
No comments