বিশ্ব অর্থনীতি ২০১৩
প্রত্যাশা আর আশঙ্কার মধ্য দিয়ে হাজির ২০১৩। অনেকেই এই বছরকে দুর্ভাগ্যের বছর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আনলাকি থার্টিনের ধারণা থেকে। ২০১৩ সাল সমগ্র মানবজাতির জন্য কেমন যাবে তা জ্যোতিষবিদদের সাথে সাথে পেশাগত সকল বিশ্লেষকেরই ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতি বিশ্লেষকরা তো বিগত কয়েক বছরের যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকা-ের তথ্য-উপাত্ত জড়ো করে আগামী বছরের বিশ্ব অর্থনীতি কেমন যাবে তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে চলছেন। কোন কোন অর্থনীতিবিদ দেখছেন ইতিবাচকতা, আবার কেউ কেউ দেখছেন অর্থনৈতিক মন্দার ধারাবাহিকতা। অর্থনীতিবিদদের সাথে সাথে রাজনীতিবিদরাও বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করেই বর্তমান বিশ্বরাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বিধায় আগামী বছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে তা জানা রাজনীতিবিদদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে ছিল মন্দার হাওয়া। আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই কেটে গেল ২০১২ সাল। ইউরো সংকট, ঋণ সমস্যা, ব্যয় সংকোচন, বেকারত্ব, উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দগুলোই ২০১২ সালে বেশি করে পত্রিকার পাতায় এসেছে। সারা বিশ্বের মানুষের দুর্ভোগের মধ্য দিয়েই বিদায় হয়েছে ২০১২। শুরু হলো নতুন বছর। এই বছরটিকে ঘিরে বিশ্ববাসী স্বপ্ন দেখছে অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তি পাওয়ার। বিগত বছরে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশগুলোতে ঘটেছে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। আবার এই বছরের দু’এক মাসের মধ্যেই কিছু শক্তিশালী দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই পটপরিবর্তন বিশ্ব অর্থনীতিতে কি রূপ প্রভাব বিস্তার করবে তাই এখন ভাবনার বিষয়। কেউ কেউ মনে করছেন অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে এই বছরে। আবার কেউ কেউ অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মার্কেল মনে করেন সমগ্র ইউরোপকে ২০১৩ সালে আরও বেশি কঠিন সময় পার করতে হবে। ২০১২ সালে গ্রীস, স্পেন, ইতালিসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশগুলোকে আর্থিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। ব্যয় সঙ্কোচনসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও এই অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। শঙ্কা শুধু ইউরোপের অর্থনীতি নিয়েই নয়, শঙ্কা দেখা দিয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আমেরিকাকে নিয়েও। বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের মাঝে বিরাজ করছে মন্দার আশঙ্কা। বিগত বছরে শেয়ারবাজার ধস, শিল্প উৎপাদন হ্রাস, কর্মী ছাঁটাই ও বেকারত্বের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ছিল সমালোচিত ঘটনা। দ্বিতীয়বারের মতো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েই বারাক ওবামা ফিসক্যাল ক্লিফ নিয়ে পড়েছেন চরম সঙ্কটে। এই ফিসক্যাল ক্লিফ বা অর্থনৈতিক খাত এড়ানোর জন্য ওবামা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বাদসাধছে রিপাবলিকানদের মতবিরোধিতা। ধনীদের ওপর করের পরিমাণ বাড়িয়ে ফিসক্যাল ক্লিপ এড়ানোর যে পরিকল্পনা ওবামা নিয়েছেন তার বিরোধিতা করছেন রিপাবলিকান রাজনীতিবিদরা। তারা ধনীদের ওপর কর না বাড়িয়ে ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। কিন্তু ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নেয়া হলে দেশজুড়ে একদিকে বেকারত্ব যেমন বেড়ে যাবে তেমনি মধ্যবিত্তের ওপর অর্থনৈতিক করের বোঝা বেড়ে যাবে। তাই ওবামা ওই পথে যেতে চাচ্ছেন না। এভাবে কর বৃদ্ধি ও ব্যয় সঙ্কোচন নিয়ে আলোচনা করতে করতেই অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। আর এর ফলে দেশটির অর্থনীতি খাদে পড়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছিল। জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন কর্তৃক গৃহীত কার্যকর কর অবকাশের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রিপাবলিকানরা ওবামার নীতিকেই সমর্থন করে। আর এর ফলে আমেরিকার অর্থনীতি আশু করুণ পরিণতির হাত থেকে রক্ষা পায়। ওবামার নীতি কংগ্রেসে অনুমোদন পাওয়ার কারণে ধনীদের ওপর করের বোঝা বেড়ে যায় আর মধ্যবিত্তরা অধিক অর্থনৈতিক কর দেয়া থেকে রক্ষা পায়। ব্যয় সঙ্কোচন নীতি পরিহার করার কারণে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন আপাতত বিরূপ পরিস্থিতির হাত থেকে মুক্তি পায়। ফিসক্যাল ক্লিপ সমস্যার সমাধানের কারণে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন ২০১৩ সালের আমেরিকার অর্থনীতি ভাল অবস্থানে থাকবে।অন্যদিকে ঋণসঙ্কটে জর্জরিত ইউরোপের সমস্যা আরও প্রকট হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বেশির ভাগ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিগত বছরের পুরোটা সময় সমগ্র ইউরো অঞ্চল ঋণ সমস্যা, বেকার সমস্যা, উৎপাদন হ্রাস, রফতানি হ্রাস, জীবনযাত্রার মানের অবনতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগতিসহ নানা নেতিবাচক দিকের সমাহারে বেষ্টিত ছিল। এই সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দেশ দেউলিয়া হতে বসেছিল। কোন কোন দেশ ইউরো অঞ্চল ত্যাগ করার পরিকল্পনাও করেছিল। সবচেয়ে সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল গ্রীসকে। এই সময় গ্রীসকে বেল আউট দিয়ে কোন মতো স্যালাইন দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গ্রীসকে সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে তার সদ্ব্যবহার করার ওপরই গ্রীসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি বা অবনতি নির্ভর করছে। বাজেটকে যথাযথ কাজে লাগাতে পারলে গ্রীস এই যাত্রায় হয়তো দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে র্অথনীতি। তবে ব্যাপক ব্যয় সঙ্কোচনের যে পরিকল্পনা গ্রীস প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন, তা অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলে অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন। গ্রীসের মতো আরেকটি সমস্যাগ্রস্ত দেশ হচ্ছে স্পেন। দেশটিতে বেকারত্বের পরিমাণ তুলনামূলক অনেক বেড়েছে। এই অবস্থায় দেশটি বাজেট ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজস্ব কমে যাওয়া এবং আর্থিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাজেট ঘাটতি কমানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। এর ফলে এই চলতি বছরটিতেও স্পেনকে কঠিন সমস্যা ও সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
পর্তুগাল, ইতালি, আয়ারল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের অবস্থাও খারাপ। এই বছরে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপের জন্য এই বছরটি অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখার এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বছর।
এতসব নেতিবাচক দিকের মধ্যে প্রত্যাশার কথা হচ্ছে চীনের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকার ভবিষ্যত বাণী। বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীনে এই বছর রাজনীতিতে নতুন মুখ আসবে। তবে তা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক প্রবাহ ধারাকে আরও বৃদ্ধি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। একটি সংস্থা তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, চীনের এই অর্থনৈতিক গতিধারা যদি অব্যাহত থাকে তবে চীন আগামী চার বছরের মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশে পরিণত হবে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়ার অর্থনীতির গতিও স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির প্রবাহ ইতিবাচক থাকবে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিশ্ব অর্থনীতি এই বছর কেমন যাবে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদরা যে শঙ্কা বা প্রত্যাশা প্রকাশ করছে, এর প্রতিফলন নির্ভর করছে মূলত অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, ভোগ বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে উৎপাদন সচল রাখা ও সঠিক আর্থিক নীতি অনুসরণের ওপর। নেতিবাচক পরিণতি কারোই কাম্য নয়। এই বছরটি মাত্র শুরু হলো। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যদি বৈশ্বিক মন্দা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়, তবে এই বছরটিকে ঘিরে অর্থনৈতিক যে শঙ্কা বিদ্যমান তা অনেকটাই দূর করা সম্ভব হবে আর র্অথনৈতিক যে প্রত্যাশা তা পূরণ করাও সম্ভব হবে।
মোঃ আরিফুর রহমান
No comments