সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-বিপুল সম্ভাবনা :প্রয়োজন একটানা উন্নয়ন by নাসির আহমেদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা-অসন্তোষ নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ধীরগতি, সুশাসনের পথে নানা অন্তরায় নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন তারা। এ হতাশা সংবাদমাধ্যমে যেমন মুদ্রিত, তেমনি টেলিভিশন টকশোগুলোতে উচ্চারিত হয় বারবার।
এসব সমস্যা সত্ত্বেও গত চার দশকে যেখানে এসেছে বাংলাদেশ তা এখন এক বিস্ময়ই বটে। যে বাংলাদেশের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শতকরা ৮০ ভাগের মতো মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে, চরম দারিদ্র্যে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করত অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষ, মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য উৎপন্ন করা সম্ভব হতো সাত কোটি কয়েক লাখ মানুষের এ ভূখণ্ডে, সেই বাংলাদেশে আজ মুক্তিযুদ্ধকালের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি দ্বিগুণের অঙ্ক অতিক্রম করে ১৬ কোটিতে পেঁৗছেছে। কিন্তু খাদ্য উৎপাদনে বাংলা আজ এতটাই সমৃদ্ধ যে, এক কেজি খাদ্যও আমদানি করতে হয় না। এ কম বড় সাফল্য নয়। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় শিক্ষার হার বেড়েছে আশাতীত দ্রুতগতিতে। মানুষের জীবনমান ক্রমেই উন্নত হয়েছে এবং সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। নারী শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রেও নারীর অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ়।
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক। আমরা একটা গ্গ্নাসের কতটুকু খালি আছে, সেটা উল্লেখ করতেই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু গ্গ্নাসে যে অর্ধেকের বেশি পানি আছে, সেটা বলতে রাজি নই। এ মনোভাব কোনো উন্নত জাতির থাকে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশের অন্যতম। গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে চীনের মতো বিশাল রফতানিকারক দেশের ঘাড়ে এখন নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদকবলিত দেশে আজ জঙ্গিরা গর্তের সাপ। এসব দেখি না বলেই আমাদের অনেক সাফল্য এবং সম্ভাবনা আড়ালে। আশাবাদী মানুষকেও হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। বর্তমান সরকারের চার বছর নিয়ে সমকালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি জরিপ করানো হয়েছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সে জরিপে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রাম-শহর মিলিয়ে সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষের অভিমত সত্ত্বেও সেই জরিপের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু হতাশাবাদী ব্যক্তির নেতিবাচক মন্তব্য শুনেছি টেলিভিশন টকশোতে। শুধু সমকালই নয়, ডেইলি স্টার, প্রথম আলোও প্রায় একই ধরনের জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। সেসব ফল নিয়েও বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। আসলে ওই যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললাম, সেই দৃষ্টির উদারতা কিংবা সংকীর্ণতা, আশাবাদিতা কিংবা নৈরাশ্যবাদ_ কোন দিকটি হবে দেখার লক্ষ্য তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু।
আমাদের দেশে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে মনে হবে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যার বোঝাটা ২০০৭ সালের জানুয়ারির মতো নয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে কোন প্রেক্ষাপটে দেশে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে সামরিক বাহিনী এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহল জরুরি অবস্থা জারি করে, তা কারও অজানা নয়। ভুয়া ভোটার তালিকায় দলীয় অন্ধ সমর্থক সিইসি বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর ছিল সেদিন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। যে কারণে দলীয় অনুগত রাষ্ট্রপতিকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল। এমনকি বিএনপির একসময়ের অঙ্গ সংগঠনের নেতা, পরবর্তীকালে বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসর নিলে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের সময় সরকার পরিচালনা করতে পারেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে তৎকালীন আইনমন্ত্রী দুই-আড়াই বছর আগেই বিচারপতিদের চাকরির সময়কালের মেয়াদ বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। মজার ব্যাপার, সেই বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এমন হিসাব কষে কার্যকর করলেন, যাতে কেএম হাসানের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সরকারপ্রধানের পদ নিশ্চিত থাকে। এ নিয়ে ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কীভাবে বঙ্গভবন তথা রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, উপদেষ্টা নিয়োগ, উপদেষ্টাদের কয়েকজনের বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ এবং রাজপথে বিরোধী দলের আন্দোলন_ এর সবই আজ অনেকের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। কোন চরম অবস্থায় রাজপথে লগি-বৈঠার মিছিল হয়েছিল এবং চরম সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা গত চার বছরের ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে সবই চাপা পড়ে গেলে তা হবে জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্য। তখনকার বিরোধী দল যে ছবিসহ একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা চেয়েছিল, তাও হয়তো বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে এতদিনে; কিন্তু সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তা হয়েছে পরে।
মানুষ অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকে না_ এ কথা সত্য; কিন্তু অতীতকে বাদ দিয়েও চলা যায় না বর্তমান আর ভবিষ্যতের পথ। অনেকেই অতীত ভুলে যেতে পরামর্শ দেন। যেমন কিছুদিন আগে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে বললে জবাব দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর জন্য। যেমন গত চার দশক ধরে জামায়াতিরা বলছে অতীত ভুলে যেতে। তবু তারা ক্ষমা চাইতে রাজি নয় মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাসহ এত বড় মানবতাবিরোধী নৃশংসতার জন্য। সুতরাং খুব নিকট অতীতের ঘটনার উল্লেখ এ কারণেই যে, আমরা তো সহজেই বর্তমানের ঝড়ে অতীতের টর্নেডোও ভুলে যাই। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সশস্ত্র তালেবানি কায়দায় শায়খ আবদুর রহমান আর বাংলাভাইদের মতো জঙ্গিদের নেতৃত্বে এ দেশের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার জঙ্গি গড়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত এ জামায়াতপন্থি কিংবা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ও মূল সংগঠনের সাবেকরা সারাদেশকে জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, যার ধকল গত চার বছরেও যায়নি। প্রতিনিয়ত র্যাবের কঠিন মনিটরিংয়ে কিছুটা দমেছে তাদের প্রকাশ্য তৎপরতা; কিন্তু বিভিন্ন নামে তারা এখনও সক্রিয়। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কাজেও এখন তারা নানা সাইনবোর্ড আর প্লাটফর্মে সক্রিয়।
সুতরাং এ রকম সমাজ বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ফসল এ মানবিক মূল্যবোধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাদের পুনরুত্থানের সবচেয়ে উত্তম পথ হচ্ছে গণতন্ত্র হত্যা করা, যুদ্ধাপরাধের বিচার রুদ্ধ করা, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের আশ্রয় নেওয়া। এর সবকিছুই এখন চলমান। ঠিক এ সময়ে বর্তমান সরকার নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে চার বছর পেরিয়ে পঞ্চম বছরে পদার্পণ করল গত ৬ জানুয়ারি। এখন ২০১৩ সালেই নির্বাচন অনিবার্য। সে কথা প্রধানমন্ত্রীর গত ১১ জানুয়ারি এ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও আমরা শুনেছি। কিন্তু নির্বাচনের পথে ২০০৭ সালের মতো অনেক প্রতিবন্ধকতা নেই। একটাই প্রতিবন্ধকতা_ সরকারপ্রধান কে হবেন নির্বাচনকালে? তত্ত্বাবধায়ক বাতিল হয়েছে; কিন্তু নিরপেক্ষ সর্বজনগ্রাহ্য সরকার হলেই নির্বাচন। সে জন্য প্রয়োজন ছিল বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের এবং সরকারি দলের আলোচনা। আশা করতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা মিথ্যা হোক, আবার কোনো ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। একটা মীমাংসায় আসতে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতারা মতবিনিময় করে সিদ্ধান্তে আসুন। তা না হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। দেশবাসী তা চায় না। দেশের প্রযুক্তিপ্রিয় তরুণরাও তা চায় না। আমরা গত শুক্রবার দেখেছি দেশজুড়ে সমকালের বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে উদ্দীপিত তারুণ্যের সে কী উৎসব! প্রচণ্ড শীতও তাদের উৎসব থেকে ফেরাতে পারেনি। প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে ওঠার জন্য তারুণ্যের এ উৎসব অনন্য। আজ বিদেশে আমাদের জনশক্তি যাচ্ছে জোয়ারের বেগে। সে পথ খুলে গেছে। উন্নতির জন্য আজ বিশাল সম্ভাবনাময় এ দেশটির প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের পথে যাওয়া। সেই পথ গণতন্ত্রের, ধারাবাহিক উন্নয়নের।
নাসির আহমেদ :কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি অধিকাংশ ক্ষেত্রে নেতিবাচক। আমরা একটা গ্গ্নাসের কতটুকু খালি আছে, সেটা উল্লেখ করতেই বেশি পছন্দ করি। কিন্তু গ্গ্নাসে যে অর্ধেকের বেশি পানি আছে, সেটা বলতে রাজি নই। এ মনোভাব কোনো উন্নত জাতির থাকে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশ বিশ্বের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দেশের অন্যতম। গার্মেন্ট পণ্য রফতানিতে চীনের মতো বিশাল রফতানিকারক দেশের ঘাড়ে এখন নিঃশ্বাস ফেলছে বাংলাদেশ। জঙ্গিবাদকবলিত দেশে আজ জঙ্গিরা গর্তের সাপ। এসব দেখি না বলেই আমাদের অনেক সাফল্য এবং সম্ভাবনা আড়ালে। আশাবাদী মানুষকেও হতাশার দিকে ঠেলে দেয়। বর্তমান সরকারের চার বছর নিয়ে সমকালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি জরিপ করানো হয়েছিল। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সে জরিপে অংশ নিয়েছিলেন। গ্রাম-শহর মিলিয়ে সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষের অভিমত সত্ত্বেও সেই জরিপের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কিছু হতাশাবাদী ব্যক্তির নেতিবাচক মন্তব্য শুনেছি টেলিভিশন টকশোতে। শুধু সমকালই নয়, ডেইলি স্টার, প্রথম আলোও প্রায় একই ধরনের জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। সেসব ফল নিয়েও বিরূপ মন্তব্য শুনেছি। আসলে ওই যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বললাম, সেই দৃষ্টির উদারতা কিংবা সংকীর্ণতা, আশাবাদিতা কিংবা নৈরাশ্যবাদ_ কোন দিকটি হবে দেখার লক্ষ্য তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু।
আমাদের দেশে চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতা যেখানে এসে ঠেকেছে তাতে মনে হবে পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যার বোঝাটা ২০০৭ সালের জানুয়ারির মতো নয়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে কোন প্রেক্ষাপটে দেশে ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে সামরিক বাহিনী এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহল জরুরি অবস্থা জারি করে, তা কারও অজানা নয়। ভুয়া ভোটার তালিকায় দলীয় অন্ধ সমর্থক সিইসি বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর ছিল সেদিন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। যে কারণে দলীয় অনুগত রাষ্ট্রপতিকে একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছিল। এমনকি বিএনপির একসময়ের অঙ্গ সংগঠনের নেতা, পরবর্তীকালে বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান অবসর নিলে যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের সময় সরকার পরিচালনা করতে পারেন, সে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে তৎকালীন আইনমন্ত্রী দুই-আড়াই বছর আগেই বিচারপতিদের চাকরির সময়কালের মেয়াদ বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। মজার ব্যাপার, সেই বয়স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এমন হিসাব কষে কার্যকর করলেন, যাতে কেএম হাসানের জন্যই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় সরকারপ্রধানের পদ নিশ্চিত থাকে। এ নিয়ে ২০০৬ সালের অক্টোবরে ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হলে সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী কীভাবে বঙ্গভবন তথা রাষ্ট্রপতিকে নিয়ন্ত্রণ করতেন, উপদেষ্টা নিয়োগ, উপদেষ্টাদের কয়েকজনের বিরক্ত হয়ে পদত্যাগ এবং রাজপথে বিরোধী দলের আন্দোলন_ এর সবই আজ অনেকের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। কোন চরম অবস্থায় রাজপথে লগি-বৈঠার মিছিল হয়েছিল এবং চরম সহিংসতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, তা গত চার বছরের ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে সবই চাপা পড়ে গেলে তা হবে জাতির জন্য চরম দুর্ভাগ্য। তখনকার বিরোধী দল যে ছবিসহ একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা চেয়েছিল, তাও হয়তো বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে এতদিনে; কিন্তু সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় তা হয়েছে পরে।
মানুষ অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকে না_ এ কথা সত্য; কিন্তু অতীতকে বাদ দিয়েও চলা যায় না বর্তমান আর ভবিষ্যতের পথ। অনেকেই অতীত ভুলে যেতে পরামর্শ দেন। যেমন কিছুদিন আগে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একাত্তরের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে বললে জবাব দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর জন্য। যেমন গত চার দশক ধরে জামায়াতিরা বলছে অতীত ভুলে যেতে। তবু তারা ক্ষমা চাইতে রাজি নয় মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাসহ এত বড় মানবতাবিরোধী নৃশংসতার জন্য। সুতরাং খুব নিকট অতীতের ঘটনার উল্লেখ এ কারণেই যে, আমরা তো সহজেই বর্তমানের ঝড়ে অতীতের টর্নেডোও ভুলে যাই। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সশস্ত্র তালেবানি কায়দায় শায়খ আবদুর রহমান আর বাংলাভাইদের মতো জঙ্গিদের নেতৃত্বে এ দেশের আনাচে-কানাচে হাজার হাজার জঙ্গি গড়ে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত এ জামায়াতপন্থি কিংবা জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ও মূল সংগঠনের সাবেকরা সারাদেশকে জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল, যার ধকল গত চার বছরেও যায়নি। প্রতিনিয়ত র্যাবের কঠিন মনিটরিংয়ে কিছুটা দমেছে তাদের প্রকাশ্য তৎপরতা; কিন্তু বিভিন্ন নামে তারা এখনও সক্রিয়। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার কাজেও এখন তারা নানা সাইনবোর্ড আর প্লাটফর্মে সক্রিয়।
সুতরাং এ রকম সমাজ বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ফসল এ মানবিক মূল্যবোধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে তাদের পুনরুত্থানের সবচেয়ে উত্তম পথ হচ্ছে গণতন্ত্র হত্যা করা, যুদ্ধাপরাধের বিচার রুদ্ধ করা, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের আশ্রয় নেওয়া। এর সবকিছুই এখন চলমান। ঠিক এ সময়ে বর্তমান সরকার নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে চার বছর পেরিয়ে পঞ্চম বছরে পদার্পণ করল গত ৬ জানুয়ারি। এখন ২০১৩ সালেই নির্বাচন অনিবার্য। সে কথা প্রধানমন্ত্রীর গত ১১ জানুয়ারি এ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও আমরা শুনেছি। কিন্তু নির্বাচনের পথে ২০০৭ সালের মতো অনেক প্রতিবন্ধকতা নেই। একটাই প্রতিবন্ধকতা_ সরকারপ্রধান কে হবেন নির্বাচনকালে? তত্ত্বাবধায়ক বাতিল হয়েছে; কিন্তু নিরপেক্ষ সর্বজনগ্রাহ্য সরকার হলেই নির্বাচন। সে জন্য প্রয়োজন ছিল বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের এবং সরকারি দলের আলোচনা। আশা করতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কা মিথ্যা হোক, আবার কোনো ওয়ান-ইলেভেনের পুনরাবৃত্তি না ঘটুক। একটা মীমাংসায় আসতে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের শীর্ষ নেতারা মতবিনিময় করে সিদ্ধান্তে আসুন। তা না হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। দেশবাসী তা চায় না। দেশের প্রযুক্তিপ্রিয় তরুণরাও তা চায় না। আমরা গত শুক্রবার দেখেছি দেশজুড়ে সমকালের বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে উদ্দীপিত তারুণ্যের সে কী উৎসব! প্রচণ্ড শীতও তাদের উৎসব থেকে ফেরাতে পারেনি। প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে ওঠার জন্য তারুণ্যের এ উৎসব অনন্য। আজ বিদেশে আমাদের জনশক্তি যাচ্ছে জোয়ারের বেগে। সে পথ খুলে গেছে। উন্নতির জন্য আজ বিশাল সম্ভাবনাময় এ দেশটির প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়নের পথে যাওয়া। সেই পথ গণতন্ত্রের, ধারাবাহিক উন্নয়নের।
নাসির আহমেদ :কবি ও সাংবাদিক
nasirahmed1971@gmail.com
No comments