সমসাময়িক প্রসঙ্গ-আশার বছর নাকি শঙ্কার? by অনিরুদ্ধ আহমেদ
পশ্চিমের দেশগুলোতে ডিসেম্বর মাস হচ্ছে ছুটির মৌসুম। বড়দিন কিংবা ইংরেজি নববর্ষকে কেন্দ্র করে ছুটির মৌসুমে অনেকেই যেমন সপরিবারে বেড়াতে যান, তেমনি অনেকের বাড়িতে থাকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ। বাঙালির বাড়িতে বিশেষত ভূরিভোজ চলে রীতিমতো আয়েশের সঙ্গে।
হিমশীতল আবহাওয়া কিংবা ঝরাপাতার মতো নেমে আসা শ্বেতশুভ্র তুষার কোনোটাই বিচলিত করে না, অতিথিদের কিংবা আয়োজকদেরও। ডিসেম্বর পেরিয়ে ইংরেজি নববর্ষও যেন পালিত হয় বাংলা নববর্ষের আদলে। সঙ্গীতে, আবৃত্তিতে, কৌতুকে এবং অভিভাষণে বাঙালিয়ানার পরিষ্কার একটা ছাপ থাকে। খাদ্যেও ঠিক গ্রামবাংলার আটপৌরে খাওয়া না থাকলেও বাঙালির আনুষ্ঠানিক মোগলাই খাওয়া তো আমাদের রসনা-তৃপ্তির প্রধান উপাদান হয়েই থাকে। এ রকম অনুষ্ঠানে বাইরের শীতল তাপমাত্রার বিপরীতে থাকে, অন্তরের উষ্ণতা। সদ্য বিগত বছরের প্রায় শেষে তেমনি এক উষ্ণ আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম আমার অনুজপ্রতিম এক বন্ধুর বাড়িতে। গৃহকর্তা এবং কর্ত্রী কাচ্চি বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ছোট মাছ ভাত সব রকমের ব্যবস্থা রেখেছিলেন এবং বলাই বাহুল্য, তাদের অবিমিশ্র আতিথ্য ও আন্তরিকতায় ভেজাল ছিল না সামান্যতমও। বাইরের ঠাণ্ডা আবহাওয়াকে পুষিয়ে দিয়েছিল ভেতরের উষ্ণতা। তবে হঠাৎ করেই সেই উষ্ণ পরিবেশ যেন উত্তপ্ত হয়ে উঠল অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু বাক্য বিনিময়ে।
বাংলাদেশিদের আলাপ-আলোচনা এই প্রবাসেও দেশের রাজনীতি বিবর্জিত হয় না সচরাচর। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত চিত্রকলাবিষয়ক আলোচনা হয় খুব কমই, সিংহভাগ সময়জুড়ে থাকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনাকাঙ্ক্ষিত বৈরী সম্পর্কের কথা, থাকে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যের কথা। সে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে থাকে এবং কখনও কখনও কট্টর সমর্থকদের মধ্যে বিতর্ক তর্কে পর্যবসিত হয়। তবে সেদিনের সেই নিমন্ত্রণের সময়ে যে তর্কের সূচনা করলেন ওই বাড়িতে নিমন্ত্রিত এক ভদ্রমহিলা; সেটি ছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত। ২০১৩ সালটি বাংলাদেশে কতখানি প্রত্যাশার এবং কতখানি সংশয়ের সে নিয়েই কথা হচ্ছিল অনেকটাই একাডেমিক মেজাজে। এ বছরটি নির্বাচনের বছর বলেই এর সম্ভাবনা এবং সংশয়ের প্রশ্নটি স্বভাবতই উঠে এসেছে। তাছাড়া বছরটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও ঘোষিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আশার দিক না বলে আশঙ্কার দিক বলে মনে করায় এই বিতর্কের সূত্রপাত। তিনি কোনো রাজনৈতিক দল করেন কি-না জানি না, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর প্রতি তার যে একটি সহজাত দুর্বলতা রয়েছে সেটি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কারও, যদিও বিস্ময়করভাবে যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারের সঙ্গে যদি তিনি ইসলামের ওপর বর্তমান সরকারের কথিত আক্রমণের প্রসঙ্গটি জুড়ে দেন। তিনি মনে করেন, হাসিনা ইসলামবিরোধী নেত্রী। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার নতুন কিছু নয়। তাকে অতি সরলীকৃত সমীকরণে ভারতপন্থি এবং ইসলামবিরোধী বলে কেউ কেউ প্রচার চালিয়ে এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে। যাদের সমালোচনা ও বিশ্লেষণ অতি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট, তারা সাধারণত কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে রাজি হন না এবং গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন। এ ধরনের বিশ্লেষণ হয় ভ্রান্ত এবং প্রচারসর্বস্ব। এ রকম প্রচারক ধৌত-মস্তিষ্ক এই ভদ্রমহিলাও। সত্য বটে হাসিনা সরকারের নানাবিধ সমস্যা ও ব্যর্থতা আছে; দুর্নীতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার সরকার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা যে তাণ্ডব ঘটাচ্ছে দেশের মধ্যে তার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে যে কড়া মূল্য দিতে হতে পারে সে আশঙ্কাও অমূলক নয়। এর ওপর রয়েছে তার এবং তার মন্ত্রিসভার কিছু শীর্ষ সদস্যের লাগামহীন বক্তব্য-মন্তব্য যা সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চাকে ব্যাহত করছে। অনেকে বলেন তার মাথাভারী উপদেষ্টামণ্ডলীও তাকে এমন কোনো গঠনমূলক উপদেশ দিচ্ছেন না যা হয়তো তার সরকারের অনুকূলে যেত। আর দুর্নীতির অভিযোগ তো রয়েছেই (যদিও সম্ভবত এই প্রথমবার যে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যাদের এসেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের প্রত্যেককেই তলব করার সৎ-সাহস দেখিয়েছে) হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার তালিকাটি আরও দীর্ঘ হবে। কিন্তু এই দীর্ঘ তালিকায় কোথাও শেখ হাসিনাকে ইসলামবিরোধী বা ভারতের অনুগামী বলে সমালোচনার কোনো অবকাশ নেই। প্রথমত ইসলামবিরোধী ও ভারতের অনুগামী হওয়া এক কথা নয়। দ্বিতীয়ত, যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন তারা সবাই মানবেন যে, হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মানুরাগী মুসলমান। কিন্তু তার এই ধর্মানুরাগ কেবলমাত্র তার ব্যক্তিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে; নিজের ধর্মবিশ্বাস তিনি রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি কখনও। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে এই সীমারেখা টেনেছেন বলেই হয়তো যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা তার ওপর ক্ষিপ্ত। মস্তিষ্ক ধোলাই কোন পর্যায় যেতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই ভদ্রমহিলা, যিনি মনে করেন, শেখ হাসিনা আদৌ ভালো মুসলমান নন এবং তিনি মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। কথাটির সত্যতা তিনি অবশ্য প্রমাণ করতে পারেননি। সম্ভবত গেল দুর্গাপূজার সময় প্রধানমন্ত্রীর মন্দির সফরকেই তিনি এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। 'কাকে কান নিয়ে গেছে' সেই প্রবাদের মতোই, তিনি কখনই যাচাই করে দেখেননি যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের একাংশের উৎসবে উপস্থিত হওয়া শেখ হাসিনার জন্য নিন্দনীয় নয়, প্রশংসনীয় বিষয়। কিন্তু অপব্যাখ্যার তো আর শেষ নেই। সেদিন আরও একজন মন্তব্য করলেন_ হাসিনা নাকি বলেছেন, এ বছর মা দুর্গার কৃপায় ফসল ভালো হয়েছে। কথাটি পূর্ণ সত্যের অপলাপ মাত্র। এ নিয়ে কিছু কিছু মৌলবাদী পত্রিকা সুযোগ মতো কুৎসা রটনা করেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা দুর্গোৎসবে যে কথাটি বলেছিলেন সেটি হচ্ছে, 'গজে করে যখন মা দুর্গা আসেন তখন নাকি দেশে অনেক ফসল হয়। এটা কথিত আছে, কাজেই আশা আছে, আগামীতেও আমরা ফুলে-ফলে-ফসলে গড়ে উঠব।' প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি সম্পর্কে দু'একটি পত্রপত্রিকা যে ছিদ্রান্বেষণ করেছে সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তারা প্রধানমন্ত্রীর উক্তি নাকি শব্দটি বেমালুম এড়িয়ে গেছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এটাও লক্ষ্য করেননি যে, প্রধানমন্ত্রী কথিত আছে এই শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে তুলকালাম সৃষ্টি করেছে ইসলামের নামে আবারও একদল লোক। তারা মনে করেন মূর্তি মানেই ধর্মীয় প্রতিমা। সে কারণে আজকাল মূর্তি শব্দটির পরিবর্তে ভাস্কর্য শব্দটি লেখা হয়, যদিও সবাই জানেন যে, সব ভাস্কর্যই মূর্তি নয়; কিন্তু যেটা অনেকেই জানেন না, সেটা হলো সব মূর্তিই ধর্মীয় অর্থে আরাধ্য নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যে ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, এর সঙ্গে কোনো ধর্মের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, তার কোনো প্রতীকের সঙ্গে, কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ওই সব সংগঠন যারা হজরত শাহজালালের পুণ্যভূমিতে মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা করছেন তাদের নেতারা প্রায় সবাই জ্ঞানপাপী এবং তারা এই অপবাদে সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
এ অপচেষ্টা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট ও ব্যাহত করারই চেষ্টা সে কথা বলাই বাহুল্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সমর্থকরা এ ধরনের গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্র বা সংগঠনকে এ রকম ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, বর্তমান সরকারের হাতে ইসলাম নিরাপদ নয়। এই কৌশলটি তাদের নেতা গোলাম আযমও করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে প্রচার চালিয়েছিলেন এই বলে যে, বাংলাদেশ ইসলামবিরোধীদের কবলে, সুতরাং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়। তিনি তখনও পাকিস্তানি নাগরিক; অতএব নিজ জন্মভূমির (এই দাবিতেই তিনি নাগরিকত্ব পান) বিরুদ্ধে আত্মঘাতী অভিযোগ আনতে তার বিবেকে বাধেনি। তার অনুসারীরা আজ ঠিক ওই একই কাজ করছে কিন্তু তখন যেমন মানুষকে ইসলামের নামে বোকা বানানো সম্ভব হয়নি এখনও হবে না; যদিও এখনকার বিশ্বে সে সময়ের চেয়ে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ অনেকখানি তীব্র হয়েছে।
আসল কথাটা হচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়কে পৃথকভাবে দেখতে হবে। মহাজোট সরকারের ভুল, স্খলন এবং ব্যর্থতা রয়েছে প্রচুর। সেটার খেসারত সরকারকে দিতে হচ্ছে, দিতে হবে, গণতন্ত্রের এটাই নিয়ম। নির্বাচনে মহাজোট ক্ষমতা হারাতে পারে, তাদের আসন হ্রাস পেতে পারে, এ সব কিছুরই সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধের জন্য মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা এই অপবাদ দিচ্ছে_ তারা ইসলামী নেতাদের নির্যাতন করছে, ইসলামী মূল্যবোধ বিনষ্ট করছে, যা ইসলামকে রাজনীতিকরণের নামান্তর। এর উদ্দেশ্য বাঙালির জাতিসত্তাকে বিনষ্ট করা, যেমন ছিল '৭১-এ, তেমনি আজও।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
বাংলাদেশিদের আলাপ-আলোচনা এই প্রবাসেও দেশের রাজনীতি বিবর্জিত হয় না সচরাচর। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত চিত্রকলাবিষয়ক আলোচনা হয় খুব কমই, সিংহভাগ সময়জুড়ে থাকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনাকাঙ্ক্ষিত বৈরী সম্পর্কের কথা, থাকে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মন্তব্য ও পাল্টা মন্তব্যের কথা। সে নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চলতে থাকে এবং কখনও কখনও কট্টর সমর্থকদের মধ্যে বিতর্ক তর্কে পর্যবসিত হয়। তবে সেদিনের সেই নিমন্ত্রণের সময়ে যে তর্কের সূচনা করলেন ওই বাড়িতে নিমন্ত্রিত এক ভদ্রমহিলা; সেটি ছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সম্পর্কিত। ২০১৩ সালটি বাংলাদেশে কতখানি প্রত্যাশার এবং কতখানি সংশয়ের সে নিয়েই কথা হচ্ছিল অনেকটাই একাডেমিক মেজাজে। এ বছরটি নির্বাচনের বছর বলেই এর সম্ভাবনা এবং সংশয়ের প্রশ্নটি স্বভাবতই উঠে এসেছে। তাছাড়া বছরটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ও ঘোষিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে আশার দিক না বলে আশঙ্কার দিক বলে মনে করায় এই বিতর্কের সূত্রপাত। তিনি কোনো রাজনৈতিক দল করেন কি-না জানি না, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর প্রতি তার যে একটি সহজাত দুর্বলতা রয়েছে সেটি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় কারও, যদিও বিস্ময়করভাবে যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারের সঙ্গে যদি তিনি ইসলামের ওপর বর্তমান সরকারের কথিত আক্রমণের প্রসঙ্গটি জুড়ে দেন। তিনি মনে করেন, হাসিনা ইসলামবিরোধী নেত্রী। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার নতুন কিছু নয়। তাকে অতি সরলীকৃত সমীকরণে ভারতপন্থি এবং ইসলামবিরোধী বলে কেউ কেউ প্রচার চালিয়ে এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে। যাদের সমালোচনা ও বিশ্লেষণ অতি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট, তারা সাধারণত কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে রাজি হন না এবং গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেন। এ ধরনের বিশ্লেষণ হয় ভ্রান্ত এবং প্রচারসর্বস্ব। এ রকম প্রচারক ধৌত-মস্তিষ্ক এই ভদ্রমহিলাও। সত্য বটে হাসিনা সরকারের নানাবিধ সমস্যা ও ব্যর্থতা আছে; দুর্নীতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তার সরকার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। ছাত্রলীগের ক্যাডাররা যে তাণ্ডব ঘটাচ্ছে দেশের মধ্যে তার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারকে যে কড়া মূল্য দিতে হতে পারে সে আশঙ্কাও অমূলক নয়। এর ওপর রয়েছে তার এবং তার মন্ত্রিসভার কিছু শীর্ষ সদস্যের লাগামহীন বক্তব্য-মন্তব্য যা সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চাকে ব্যাহত করছে। অনেকে বলেন তার মাথাভারী উপদেষ্টামণ্ডলীও তাকে এমন কোনো গঠনমূলক উপদেশ দিচ্ছেন না যা হয়তো তার সরকারের অনুকূলে যেত। আর দুর্নীতির অভিযোগ তো রয়েছেই (যদিও সম্ভবত এই প্রথমবার যে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যাদের এসেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের প্রত্যেককেই তলব করার সৎ-সাহস দেখিয়েছে) হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার তালিকাটি আরও দীর্ঘ হবে। কিন্তু এই দীর্ঘ তালিকায় কোথাও শেখ হাসিনাকে ইসলামবিরোধী বা ভারতের অনুগামী বলে সমালোচনার কোনো অবকাশ নেই। প্রথমত ইসলামবিরোধী ও ভারতের অনুগামী হওয়া এক কথা নয়। দ্বিতীয়ত, যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানেন তারা সবাই মানবেন যে, হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মানুরাগী মুসলমান। কিন্তু তার এই ধর্মানুরাগ কেবলমাত্র তার ব্যক্তিক জীবনকে প্রভাবিত করেছে; নিজের ধর্মবিশ্বাস তিনি রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি কখনও। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে এই সীমারেখা টেনেছেন বলেই হয়তো যারা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা তার ওপর ক্ষিপ্ত। মস্তিষ্ক ধোলাই কোন পর্যায় যেতে পারে তার দৃষ্টান্ত এই ভদ্রমহিলা, যিনি মনে করেন, শেখ হাসিনা আদৌ ভালো মুসলমান নন এবং তিনি মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। কথাটির সত্যতা তিনি অবশ্য প্রমাণ করতে পারেননি। সম্ভবত গেল দুর্গাপূজার সময় প্রধানমন্ত্রীর মন্দির সফরকেই তিনি এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। 'কাকে কান নিয়ে গেছে' সেই প্রবাদের মতোই, তিনি কখনই যাচাই করে দেখেননি যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনগণের একাংশের উৎসবে উপস্থিত হওয়া শেখ হাসিনার জন্য নিন্দনীয় নয়, প্রশংসনীয় বিষয়। কিন্তু অপব্যাখ্যার তো আর শেষ নেই। সেদিন আরও একজন মন্তব্য করলেন_ হাসিনা নাকি বলেছেন, এ বছর মা দুর্গার কৃপায় ফসল ভালো হয়েছে। কথাটি পূর্ণ সত্যের অপলাপ মাত্র। এ নিয়ে কিছু কিছু মৌলবাদী পত্রিকা সুযোগ মতো কুৎসা রটনা করেছে। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা দুর্গোৎসবে যে কথাটি বলেছিলেন সেটি হচ্ছে, 'গজে করে যখন মা দুর্গা আসেন তখন নাকি দেশে অনেক ফসল হয়। এটা কথিত আছে, কাজেই আশা আছে, আগামীতেও আমরা ফুলে-ফলে-ফসলে গড়ে উঠব।' প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি সম্পর্কে দু'একটি পত্রপত্রিকা যে ছিদ্রান্বেষণ করেছে সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তারা প্রধানমন্ত্রীর উক্তি নাকি শব্দটি বেমালুম এড়িয়ে গেছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এটাও লক্ষ্য করেননি যে, প্রধানমন্ত্রী কথিত আছে এই শব্দটিও ব্যবহার করেছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে তুলকালাম সৃষ্টি করেছে ইসলামের নামে আবারও একদল লোক। তারা মনে করেন মূর্তি মানেই ধর্মীয় প্রতিমা। সে কারণে আজকাল মূর্তি শব্দটির পরিবর্তে ভাস্কর্য শব্দটি লেখা হয়, যদিও সবাই জানেন যে, সব ভাস্কর্যই মূর্তি নয়; কিন্তু যেটা অনেকেই জানেন না, সেটা হলো সব মূর্তিই ধর্মীয় অর্থে আরাধ্য নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যে ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, এর সঙ্গে কোনো ধর্মের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, তার কোনো প্রতীকের সঙ্গে, কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। ওই সব সংগঠন যারা হজরত শাহজালালের পুণ্যভূমিতে মূর্তি স্থাপনের বিরোধিতা করছেন তাদের নেতারা প্রায় সবাই জ্ঞানপাপী এবং তারা এই অপবাদে সরকারকে বিব্রত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
এ অপচেষ্টা যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট ও ব্যাহত করারই চেষ্টা সে কথা বলাই বাহুল্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সমর্থকরা এ ধরনের গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্র বা সংগঠনকে এ রকম ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, বর্তমান সরকারের হাতে ইসলাম নিরাপদ নয়। এই কৌশলটি তাদের নেতা গোলাম আযমও করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে প্রচার চালিয়েছিলেন এই বলে যে, বাংলাদেশ ইসলামবিরোধীদের কবলে, সুতরাং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয়। তিনি তখনও পাকিস্তানি নাগরিক; অতএব নিজ জন্মভূমির (এই দাবিতেই তিনি নাগরিকত্ব পান) বিরুদ্ধে আত্মঘাতী অভিযোগ আনতে তার বিবেকে বাধেনি। তার অনুসারীরা আজ ঠিক ওই একই কাজ করছে কিন্তু তখন যেমন মানুষকে ইসলামের নামে বোকা বানানো সম্ভব হয়নি এখনও হবে না; যদিও এখনকার বিশ্বে সে সময়ের চেয়ে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ অনেকখানি তীব্র হয়েছে।
আসল কথাটা হচ্ছে, বিভিন্ন বিষয়কে পৃথকভাবে দেখতে হবে। মহাজোট সরকারের ভুল, স্খলন এবং ব্যর্থতা রয়েছে প্রচুর। সেটার খেসারত সরকারকে দিতে হচ্ছে, দিতে হবে, গণতন্ত্রের এটাই নিয়ম। নির্বাচনে মহাজোট ক্ষমতা হারাতে পারে, তাদের আসন হ্রাস পেতে পারে, এ সব কিছুরই সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধের জন্য মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা এই অপবাদ দিচ্ছে_ তারা ইসলামী নেতাদের নির্যাতন করছে, ইসলামী মূল্যবোধ বিনষ্ট করছে, যা ইসলামকে রাজনীতিকরণের নামান্তর। এর উদ্দেশ্য বাঙালির জাতিসত্তাকে বিনষ্ট করা, যেমন ছিল '৭১-এ, তেমনি আজও।
অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার
No comments