বিশেষ সাক্ষাৎকার : এ কে আবদুল মোমেন-জেনোসাইডের মতো অপরাধতুল্য ইকোসাইড নিরসনে বিশ্ব সহযোগিতা প্রয়োজন
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভূমিকা, শান্তিরক্ষা বাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ড. এ কে আবদুল মোমেন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব সংস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান ও অর্জনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এ কে আবদুল মোমেন : একটি দেশের অবস্থান নির্ভর করে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নতি-অবনতির ওপর। নির্ভর করে বিশ্ব সংস্থায় নিয়োজিতদের দক্ষতার ওপরও। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত করার ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করার মতো বলে আমি মনে করি। তার ফলও এসেছে। দেশে যেসব উন্নয়ন হয়েছে তার স্বীকৃতি পাওয়া গেছে জাতিসংঘের মাধ্যমে। বিশ্বসভায় আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা জাতিসংঘের কাছ থেকে বেশ কিছু স্বীকৃতি পেয়েছি। পুরস্কৃত হয়েছি। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই অবহিত আছেন। ফলে বাংলাদেশের পরিবর্তনকে তাঁর পক্ষে সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : পুরস্কারের কথা বলছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন সম্ভব হয়েছে?
এ কে আবদুল মোমেন : প্রথমেই বলতে পারি নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে। বাংলাদেশ একটি মুসলমানপ্রধান দেশ। অথচ এখানে নারীর ক্ষমতায়নে যে সুপরিবর্তন হয়েছে, তা গর্বের সঙ্গে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোও অবাক হয়ে গেছে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি দেখে। আজকে বিশ্বসভায় যখনই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা হয়, বাংলাদেশকে তাদের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। মেডিক্যাল সায়েন্সে প্রযুক্তির ব্যবহারে সাফল্য লাভের কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেছে। এটা হয়েছে ২০১১ সালে। শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসার জন্য ইতিপূর্বে পুরস্কৃত হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা সাউথ নিউজ অ্যাওয়ার্ড, নারী উদ্যোক্তার ওপর পুরস্কার লাভ করেছি। এমন আরো কিছু ক্ষেত্রে আমাদের স্বীকৃতি আছে। ম্যালেরিয়া ও কলেরায় মানুষের মৃত্যু হতে দেখা যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনকে বিশ্বসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। অথচ এখানে মানুষকে চীনের মতো চাপাচাপি করে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করা হয় না। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল নির্ধারণেও জাতিসংঘে বাংলাদেশ সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পেরেছে। দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনও বিশাল। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ যে অবদান রাখছে, তাকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করা যায়।
কালের কণ্ঠ : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে বাংলাদেশের পূর্ব সম্পর্ক কিভাবে হয়েছিল?
এ কে আবদুল মোমেন : মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি এসেছেন বারকয়েক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পশ্চিমারা তখন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল। সেই সময় তিনি ঢাকা এলে নবাবপুর এলাকার সাধারণ হোটেলেও থাকতে হয়েছে। তখনকার বাংলাদেশের চিত্র তাঁর জানা আছে। একই সঙ্গে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা যখন জানতে পারেন, তখন তাঁর পক্ষে বাংলাদেশের উন্নয়নের তুলনা করা অনেকটা সহজ হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তো লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। পশ্চিমা দুনিয়া রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে বাংলাদেশের অর্থনেতিক উন্নয়ন দেখে। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলো যেখানে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের অনেকের প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাত্মক মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রকে তারা মূল্যায়ন করছে। এটা তো জানেন, জাতিসংঘের মহাসচিব ২০১১ সালে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় উচ্চাসন দিতে সক্ষম হয়েছে। আজকে বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদরা তাঁদের বক্তৃতায় বাংলাদেশ মডেলের উদাহরণ দিয়ে থাকেন।
কালের কণ্ঠ : এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি; এখন বলা হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের মূল্যায়নকালে কি এটা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয় না?
এ কে আবদুল মোমেন : জাতিসংঘ অর্থের ব্যবহারকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে যে অর্থ আসে তার ব্যবহার নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তারা দেখছে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয় অনেক বেশি। ধনী দেশগুলোর প্রতি এ কারণে জাতিসংঘ বারবার আহ্বান জানায়, তোমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ কর। এ বিষয়ে ফিনল্যান্ডের একটা উদাহরণ দিতে পারি। একবার সেখানে গিয়েছিলাম একটা প্রোগ্রামে। দেখলাম, একজন মন্ত্রী এসেছেন ট্রেনে চড়ে। দুর্নীতিমুক্ত দেশটির মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি ব্যবহার করছেন না কেন? তিনি বললেন, এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্বে যে কম্পানি আছে সে রীতিমতো গলা কেটে নেয়। দুর্নীতিও আছে সেখানে। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রচার পায় বেশি।
কালের কণ্ঠ : জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেন?
এ কে আবদুল মোমেন : শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান বিশ্বস্বীকৃত। আমাদের দেশপ্রেমিক সৈনিকরা গোলযোগপূর্ণ এলাকায় মেধা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনের সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে শতভাগ। তারা দেশের মান সমুন্নত রাখতে যথেষ্ট আন্তরিক। জাতিসংঘে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে আমিরা হকের নিয়োগ এ খাতে বাংলাদেশের অবদানকে সমৃদ্ধ করেছে। জাতিসংঘের কোনো নীতিনির্ধারণী উচ্চপদে বাংলাদেশের এই অর্জনকে অবশ্যই প্রশংসনীয় বলতে হবে। পিসকিপিং ফোর্সেও আমাদের সৈনিকদের মূল্যায়ন হয়েছে। ওয়েস্টার্ন সাহারায় পিসকিপিং ফোর্স কমান্ডার চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। গত তিন বছরের একটি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৪২ হাজার ২৪৯ জন সৈনিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৪৫৪ জন সশস্ত্র বাহিনী ও সাত হাজার ৪২৯ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য। উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আমাদের মহিলা পুলিশেরও ৫৩১ জন এখন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত আছেন।
কালের কণ্ঠ : পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যেসব দেশের আর্থিক সহযোগিতায় শান্তিরক্ষা মিশন চলে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করছে, এতে কি কোনো প্রভাব পড়েনি?
এ কে আবদুল মোমেন : এ মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কিছুটা বিরূপ প্রভাব এখানেও পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানির মতো দেশ এখন এ খাতে অর্থ ব্যয় করতে চাইছে না। ফলে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে ব্যয় সংকোচনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এতে কি বাংলাদেশের কর্মীদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রে বিরূপ কোনো প্রভাব পড়েছে?
এ কে আবদুল মোমেন : এ বিষয়ে বাংলাদেশ আগে থেকেই সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। জাতিসংঘে দেনদরবার করেছে। সাফল্যও এসেছে। যে কারণে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে ৭.৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণের টাকাও এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে যেখানে একজনের মৃত্যু হলে ৫০ হাজার ইউএস ডলার পেত, এখন সেটা হয়েছে ৭০ হাজার ডলার। এ খাতে বাংলাদেশ যে অর্থ পেয়েছে তাও উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে এই খাতেই ৯১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পেরেছে।
কালের কণ্ঠ : শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের কর্মী-বহির্ভূত সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বলুন।
এ কে আবদুল মোমেন : আগে বাংলাদেশ থেকে শুধু শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মী নিয়োজিত হতো। বেতন-ভাতা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো এ থেকে। কিন্তু হালে, বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে, আমাদের অর্জন যন্ত্রপাতির মাধ্যমেও বেড়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের যে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সেগুলোর অনেকটাই এখন বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ইকুইপমেন্ট ভাড়া বাবদ আমরা ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছি। এসব ইকুইপমেন্ট ভাড়া দেওয়ার কারণে একদিকে আমাদের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে আয় বেড়েছে। যেমন ফ্রিগেটের কথা বলা যায়। একটি ফ্রিগেট সচল রাখার জন্য নিয়মিত জ্বালানি ব্যয় করতে হয়। সেই ফ্রিগেট এখন ব্যয়ের পরিবর্তে আমাদের আয় বাড়িয়েছে। এখন ব্যয় জাতিসংঘ বহন করছে। বাংলাদেশের ৯টি হেলিকপ্টার এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে নিয়োজিত। সেগুলো থেকে নিয়মিত আয় হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
এ কে আবদুল মোমেন : ২০০৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কমিশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ এনএএম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের পিস বিল্ডিং ফান্ড সংক্রান্ত উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালে আমাদের দেশ জাতিসংঘ পিস বিল্ডিং কমিশনের সভাপতির পদ লাভ করতে সক্ষম হয়। মাঠ পর্যায়েও বাংলাদেশ যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। শুধু শান্তি রক্ষায়ই কেন, জাতিসংঘের ৪২টি কমিটিতে বাংলাদেশ সেক্রেটারি, চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারের মর্যাদা পেয়েছে। আগে ছিল মাত্র ৯টিতে।
কালের কণ্ঠ : পাইরেসি কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের আরেকটি দুর্নাম আছে বিশ্বে। যে দুর্নামের কারণে বাংলাদেশ অনেক বাণিজ্য-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু করা সম্ভব হয়েছে কি?
এ কে আবদুল মোমেন : বাংলাদেশের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক ছিল। অথচ বাংলাদেশ সোমালিয়ার মতো নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে পাইরেসি হয় না। তার পরও আমাদের দুর্নাম ছিল। যে কারণে বিদেশি জাহাজগুলো বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে বেশি হারে অর্থ দাবি করত। জাতিসংঘ থেকে আমাদের অনেকবার তাগাদা দিয়েছে, যাতে বাংলাদেশে পাইরেসি আইন করা হয়। আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বাংলাদেশে পাইরেসি হয় না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি দূরত্বে যদি জাহাজ ডাকাতি হয়, তাহলেই তা পাইরেসি হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশে এমনটা না হলেও আমাদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য, মাত্র দুই মাস আগে আমাদের সাফল্য আসে। আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বাংলাদেশের তীরবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকে কিছু পণ্য অবৈধ লেনদেন হয়। সুতরাং এটা পাইরেসি নয়। সর্বশেষ বাংলাদেশকে এখন পাইরেসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিশ্ব সহযোগিতা লাভের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘে কী ভূমিকা পালন করেছে?
এ কে আবদুল মোমেন : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো যে বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ব সমাজে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষতির কারণ নির্ধারণ ও নিরসনের উপায়, প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিশ্চিতকরণ, জলবায়ুর প্রভাবে অভিবাসীদের পুনর্বাসনসহ নানা দিক তুলে ধরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সংশ্লিষ্টকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অনন্য ভূমিকা পালন করছেন।
কালের কণ্ঠ : জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলো ক্ষতিপূরণ কিংবা দূষণ রোধে কী ভূমিকা নিচ্ছে?
এ কে আবদুল মোমেন : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো কিছু দেশে যে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না। আবার যারা বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পক্ষে নয়। বিপর্যয় এলে তা মোকাবিলা করতে হলে যে অর্থ প্রয়োজন, তা দেবে কে? প্রযুক্তি চাই, উদ্বাস্তু হয়ে যাবে অনেক মানুষ, তাদের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, কোথা থেকে আসবে অর্থ? বিশ্বকে এদিকে নজর দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এটা তো অপরাধের তুল্য। আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে?
এ কে আবদুল মোমেন : একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ একে ইকোসাইড বলে আখ্যায়িত করেছেন। জেনোসাইডের মতো ইকোসাইডও অপরাধতুল্য। আমরা দাবি করছি একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। অ্যাম্বাসাডর রেসপনসিবিলিটি টু ক্লাইমেট গঠন করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে আহ্বান জানাব ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এ কে আবদুল মোমেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব সংস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান ও অর্জনকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এ কে আবদুল মোমেন : একটি দেশের অবস্থান নির্ভর করে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নতি-অবনতির ওপর। নির্ভর করে বিশ্ব সংস্থায় নিয়োজিতদের দক্ষতার ওপরও। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত করার ক্ষেত্রে আমাদের কূটনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করার মতো বলে আমি মনে করি। তার ফলও এসেছে। দেশে যেসব উন্নয়ন হয়েছে তার স্বীকৃতি পাওয়া গেছে জাতিসংঘের মাধ্যমে। বিশ্বসভায় আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাতিসংঘ একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আমরা জাতিসংঘের কাছ থেকে বেশ কিছু স্বীকৃতি পেয়েছি। পুরস্কৃত হয়েছি। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই অবহিত আছেন। ফলে বাংলাদেশের পরিবর্তনকে তাঁর পক্ষে সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : পুরস্কারের কথা বলছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন সম্ভব হয়েছে?
এ কে আবদুল মোমেন : প্রথমেই বলতে পারি নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে। বাংলাদেশ একটি মুসলমানপ্রধান দেশ। অথচ এখানে নারীর ক্ষমতায়নে যে সুপরিবর্তন হয়েছে, তা গর্বের সঙ্গে বিশ্বসভায় উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোও অবাক হয়ে গেছে বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতি দেখে। আজকে বিশ্বসভায় যখনই নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা হয়, বাংলাদেশকে তাদের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে হয়। মেডিক্যাল সায়েন্সে প্রযুক্তির ব্যবহারে সাফল্য লাভের কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করেছে। এটা হয়েছে ২০১১ সালে। শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসার জন্য ইতিপূর্বে পুরস্কৃত হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা সাউথ নিউজ অ্যাওয়ার্ড, নারী উদ্যোক্তার ওপর পুরস্কার লাভ করেছি। এমন আরো কিছু ক্ষেত্রে আমাদের স্বীকৃতি আছে। ম্যালেরিয়া ও কলেরায় মানুষের মৃত্যু হতে দেখা যায় না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনকে বিশ্বসমাজ অত্যন্ত গুরুত্বসহ বিবেচনা করে। অথচ এখানে মানুষকে চীনের মতো চাপাচাপি করে জন্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করা হয় না। মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল নির্ধারণেও জাতিসংঘে বাংলাদেশ সম্মানজনক অবস্থানে যেতে পেরেছে। দুর্যোগ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনও বিশাল। জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ যে অবদান রাখছে, তাকে ঐতিহাসিক বলে আখ্যায়িত করা যায়।
কালের কণ্ঠ : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে বাংলাদেশের পূর্ব সম্পর্ক কিভাবে হয়েছিল?
এ কে আবদুল মোমেন : মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে তিনি এসেছেন বারকয়েক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পশ্চিমারা তখন তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল। সেই সময় তিনি ঢাকা এলে নবাবপুর এলাকার সাধারণ হোটেলেও থাকতে হয়েছে। তখনকার বাংলাদেশের চিত্র তাঁর জানা আছে। একই সঙ্গে তিনি বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা যখন জানতে পারেন, তখন তাঁর পক্ষে বাংলাদেশের উন্নয়নের তুলনা করা অনেকটা সহজ হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তো লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। পশ্চিমা দুনিয়া রীতিমতো অবাক হয়ে গেছে বাংলাদেশের অর্থনেতিক উন্নয়ন দেখে। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলো যেখানে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, তাদের অনেকের প্রবৃদ্ধি যেখানে ঋণাত্মক মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে, সেখানে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নই নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রকে তারা মূল্যায়ন করছে। এটা তো জানেন, জাতিসংঘের মহাসচিব ২০১১ সালে বাংলাদেশকে মডেল হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় উচ্চাসন দিতে সক্ষম হয়েছে। আজকে বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদরা তাঁদের বক্তৃতায় বাংলাদেশ মডেলের উদাহরণ দিয়ে থাকেন।
কালের কণ্ঠ : এক সময় বাংলাদেশকে বলা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি; এখন বলা হচ্ছে দুর্নীতিগ্রস্ত। বাংলাদেশের মূল্যায়নকালে কি এটা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয় না?
এ কে আবদুল মোমেন : জাতিসংঘ অর্থের ব্যবহারকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে যে অর্থ আসে তার ব্যবহার নিয়ে অনেক পর্যালোচনা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। তারা দেখছে বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয় অনেক বেশি। ধনী দেশগুলোর প্রতি এ কারণে জাতিসংঘ বারবার আহ্বান জানায়, তোমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ কর। এ বিষয়ে ফিনল্যান্ডের একটা উদাহরণ দিতে পারি। একবার সেখানে গিয়েছিলাম একটা প্রোগ্রামে। দেখলাম, একজন মন্ত্রী এসেছেন ট্রেনে চড়ে। দুর্নীতিমুক্ত দেশটির মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি ব্যবহার করছেন না কেন? তিনি বললেন, এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের দায়িত্বে যে কম্পানি আছে সে রীতিমতো গলা কেটে নেয়। দুর্নীতিও আছে সেখানে। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের দুর্নীতি প্রচার পায় বেশি।
কালের কণ্ঠ : জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেন?
এ কে আবদুল মোমেন : শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদান বিশ্বস্বীকৃত। আমাদের দেশপ্রেমিক সৈনিকরা গোলযোগপূর্ণ এলাকায় মেধা ও আন্তরিকতা প্রদর্শনের সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে শতভাগ। তারা দেশের মান সমুন্নত রাখতে যথেষ্ট আন্তরিক। জাতিসংঘে আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে আমিরা হকের নিয়োগ এ খাতে বাংলাদেশের অবদানকে সমৃদ্ধ করেছে। জাতিসংঘের কোনো নীতিনির্ধারণী উচ্চপদে বাংলাদেশের এই অর্জনকে অবশ্যই প্রশংসনীয় বলতে হবে। পিসকিপিং ফোর্সেও আমাদের সৈনিকদের মূল্যায়ন হয়েছে। ওয়েস্টার্ন সাহারায় পিসকিপিং ফোর্স কমান্ডার চার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা। গত তিন বছরের একটি পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ৪২ হাজার ২৪৯ জন সৈনিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৪৫৪ জন সশস্ত্র বাহিনী ও সাত হাজার ৪২৯ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য। উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, আমাদের মহিলা পুলিশেরও ৫৩১ জন এখন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত আছেন।
কালের কণ্ঠ : পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যেসব দেশের আর্থিক সহযোগিতায় শান্তিরক্ষা মিশন চলে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা করছে, এতে কি কোনো প্রভাব পড়েনি?
এ কে আবদুল মোমেন : এ মুহূর্তে সমস্যা হচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কিছুটা বিরূপ প্রভাব এখানেও পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানির মতো দেশ এখন এ খাতে অর্থ ব্যয় করতে চাইছে না। ফলে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে ব্যয় সংকোচনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কালের কণ্ঠ : এতে কি বাংলাদেশের কর্মীদের পারিশ্রমিক ও অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রে বিরূপ কোনো প্রভাব পড়েছে?
এ কে আবদুল মোমেন : এ বিষয়ে বাংলাদেশ আগে থেকেই সজাগ দৃষ্টি রেখেছে। জাতিসংঘে দেনদরবার করেছে। সাফল্যও এসেছে। যে কারণে বেতন-ভাতার ক্ষেত্রে ৭.৫ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুজনিত কারণে ক্ষতিপূরণের টাকাও এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। আগে যেখানে একজনের মৃত্যু হলে ৫০ হাজার ইউএস ডলার পেত, এখন সেটা হয়েছে ৭০ হাজার ডলার। এ খাতে বাংলাদেশ যে অর্থ পেয়েছে তাও উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ থেকে এই খাতেই ৯১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে পেরেছে।
কালের কণ্ঠ : শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের কর্মী-বহির্ভূত সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বলুন।
এ কে আবদুল মোমেন : আগে বাংলাদেশ থেকে শুধু শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কর্মী নিয়োজিত হতো। বেতন-ভাতা বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো এ থেকে। কিন্তু হালে, বিশেষ করে ২০১০ সাল থেকে, আমাদের অর্জন যন্ত্রপাতির মাধ্যমেও বেড়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের যে অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়, সেগুলোর অনেকটাই এখন বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। গত তিন বছরে ইকুইপমেন্ট ভাড়া বাবদ আমরা ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছি। এসব ইকুইপমেন্ট ভাড়া দেওয়ার কারণে একদিকে আমাদের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে আয় বেড়েছে। যেমন ফ্রিগেটের কথা বলা যায়। একটি ফ্রিগেট সচল রাখার জন্য নিয়মিত জ্বালানি ব্যয় করতে হয়। সেই ফ্রিগেট এখন ব্যয়ের পরিবর্তে আমাদের আয় বাড়িয়েছে। এখন ব্যয় জাতিসংঘ বহন করছে। বাংলাদেশের ৯টি হেলিকপ্টার এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে নিয়োজিত। সেগুলো থেকে নিয়মিত আয় হচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
এ কে আবদুল মোমেন : ২০০৫ সাল থেকেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কমিশনের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছে। শুরু থেকেই বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ এনএএম সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের পিস বিল্ডিং ফান্ড সংক্রান্ত উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালে আমাদের দেশ জাতিসংঘ পিস বিল্ডিং কমিশনের সভাপতির পদ লাভ করতে সক্ষম হয়। মাঠ পর্যায়েও বাংলাদেশ যথেষ্ট সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। শুধু শান্তি রক্ষায়ই কেন, জাতিসংঘের ৪২টি কমিটিতে বাংলাদেশ সেক্রেটারি, চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারের মর্যাদা পেয়েছে। আগে ছিল মাত্র ৯টিতে।
কালের কণ্ঠ : পাইরেসি কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশের আরেকটি দুর্নাম আছে বিশ্বে। যে দুর্নামের কারণে বাংলাদেশ অনেক বাণিজ্য-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিছু করা সম্ভব হয়েছে কি?
এ কে আবদুল মোমেন : বাংলাদেশের জন্য এটা দুর্ভাগ্যজনক ছিল। অথচ বাংলাদেশ সোমালিয়ার মতো নয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে পাইরেসি হয় না। তার পরও আমাদের দুর্নাম ছিল। যে কারণে বিদেশি জাহাজগুলো বাংলাদেশে পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে বেশি হারে অর্থ দাবি করত। জাতিসংঘ থেকে আমাদের অনেকবার তাগাদা দিয়েছে, যাতে বাংলাদেশে পাইরেসি আইন করা হয়। আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বাংলাদেশে পাইরেসি হয় না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি দূরত্বে যদি জাহাজ ডাকাতি হয়, তাহলেই তা পাইরেসি হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশে এমনটা না হলেও আমাদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য, মাত্র দুই মাস আগে আমাদের সাফল্য আসে। আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, বাংলাদেশের তীরবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকে কিছু পণ্য অবৈধ লেনদেন হয়। সুতরাং এটা পাইরেসি নয়। সর্বশেষ বাংলাদেশকে এখন পাইরেসি তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিশ্ব সহযোগিতা লাভের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘে কী ভূমিকা পালন করেছে?
এ কে আবদুল মোমেন : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো যে বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তা বিশ্ব সমাজে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। ক্ষতির কারণ নির্ধারণ ও নিরসনের উপায়, প্রযুক্তি ব্যবহার ও নিশ্চিতকরণ, জলবায়ুর প্রভাবে অভিবাসীদের পুনর্বাসনসহ নানা দিক তুলে ধরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সংশ্লিষ্টকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অনন্য ভূমিকা পালন করছেন।
কালের কণ্ঠ : জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলো ক্ষতিপূরণ কিংবা দূষণ রোধে কী ভূমিকা নিচ্ছে?
এ কে আবদুল মোমেন : জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো কিছু দেশে যে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তা অনেকে বিশ্বাসই করতে চায় না। আবার যারা বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তাপমাত্রা কমিয়ে আনার পক্ষে নয়। বিপর্যয় এলে তা মোকাবিলা করতে হলে যে অর্থ প্রয়োজন, তা দেবে কে? প্রযুক্তি চাই, উদ্বাস্তু হয়ে যাবে অনেক মানুষ, তাদের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে, কোথা থেকে আসবে অর্থ? বিশ্বকে এদিকে নজর দিতে হবে।
কালের কণ্ঠ : এটা তো অপরাধের তুল্য। আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে?
এ কে আবদুল মোমেন : একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ একে ইকোসাইড বলে আখ্যায়িত করেছেন। জেনোসাইডের মতো ইকোসাইডও অপরাধতুল্য। আমরা দাবি করছি একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। অ্যাম্বাসাডর রেসপনসিবিলিটি টু ক্লাইমেট গঠন করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে আহ্বান জানাব ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
এ কে আবদুল মোমেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments