একটি অছিয়তনামা এবং বঞ্চিত কন্যাদের গল্প by তানজিম আল ইসলাম

বরগুনা জেলার আমতলী থানার একটি পরিবারের গল্প এটি। এ পরিবারের আদি পুরুষ একটি নিয়ম করে গেছেন। নিয়মটি হচ্ছে, তাঁর বংশের কোনো নারী তাঁদের সম্পত্তির ভাগ পাবেন না।
শুধু তাঁদের বংশে আসা পুরুষ সদস্যরাই এ সম্পত্তি ক্রমান্বয়ে ওয়ারিশসূত্রে ভোগ করবেন। এ নিয়ম জারির পর থেকে এ পরিবারটিতে এসেছে চারটি প্রজন্ম। কিন্তু এ নিয়মের কারণে এবং অজুহাতে এ বংশে জন্ম নেওয়া কন্যারা যুগ যুগ ধরে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন। আজকের দিনে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বুলি ফোটানো হচ্ছে কিংবা সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান ভাগের অধিকারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এমন একটি নিয়ম সত্যিই বিস্মিত করে। শুধু বিস্মিতই নয়, এই একটি পরিবারের গল্প থেকেই বোঝা যায়, আমাদের দেশে সম্পত্তিতে নারীরা আজও তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটা পিছিয়ে আছে।
এবার গল্পটির বিষয়বস্তুতে যাওয়া যাক। ১৯২৩ সালে বংশের আদি পুরুষ মদন হাজি তাঁর জীবদ্দশায় একটি অছিয়তনামা সম্পন্ন করে যান। এই অছিয়তনামায় শর্ত ছিল ২৮টি। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে, মদন হাজির মৃত্যুর পর তাঁর সম্পত্তির মালিক এবং ভোগদখলকারী হবে তাঁর পুত্ররা এবং পুত্রদের মৃত্যুর পর পুত্রের পুত্ররা। এভাবে বংশানুক্রমিক ভোগদখল করে যাবেন পুরুষের সন্তানেরা। কোনো কন্যাসদস্য এ সম্পত্তির মালিক এবং ভোগদখলকারী হতে পারবেন না। তবে একটি শর্ত ছিল, কন্যা সন্তানেরা পাঁচ টাকা হারে মাসোহারা পাবেন। মদন হাজির মৃত্যুর পর তৎকালীন ডেলিগেট আদালতের মাধ্যমে প্রবেট মোকদ্দমার মাধ্যমে উইলটি কার্যকর করা হয়। মদন হাজির পুত্র দুজন আমিন উদ্দিন ও ধলু শিকদার অছিয়তনামার শর্ত অনুযায়ী সম্পত্তির মালিক হন। মদন হাজির কন্যারা সেই সময় আর সম্পত্তি দাবি করতে পারেননি। মদন হাজির ছেলে আমিনউদ্দিন শিকদার পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা রেখে মারা যান। মদন হাজির করে যাওয়া উইল অনুযায়ী তাঁর নাতনিরা অর্থাৎ আমিনউদ্দিনের মেয়েরা এ সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু মদন হাজির নাতনিরা বাবার সম্পত্তি চেয়ে নিজেদের নামে নামজারি করান। কিন্তু তখন এ কন্যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাধা দেন তাঁদের ভাইয়েরা। ভাইদের দাবি, সম্পত্তির মালিক হওয়ার দাবিদার একমাত্র ভাইয়েরাই। বোনদের এ সম্পত্তির কোনো অংশ কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না। তাই বোনেরা যে নামজারি করেছিলেন, সে নামজারি বাতিল চেয়ে ভাইয়েরা দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করেন। মোকদ্দমায় ১৯৯৬ সালে বোনেরা হেরে যান। আদালত তখন ইসলামি আইন অনুযায়ী উইলটি অপরিপূর্ণ বললেও প্রবেট মোকদ্দমার কারণে উইলটি স্বীকৃত, এ যুক্তিতে বোনদের নামে নামজারিগুলো বাতিল করে দেন। রায় অনুযায়ী সম্পত্তি নাম খারিজ হয় ছেলেদের নামে অর্থাৎ মদন হাজির নাতিদের নামে। গোলাম রহমান মদন হাজির নাতিদের একজন। গোলাম রহমান তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তিন ছেলে আজিজুল, মজিবর, বশির এবং দুই মেয়ে হোসনে আরা এবং ডেইজী বেগম। গোলাম রহমান মারা গেলে তাঁর সম্পত্তি দাবি করেন দুই মেয়ে এবং ২০০৭-০৮ সালে তাঁদের নামে নামজারিও হয় এবং রেকর্ডও হয়। কিন্তু এখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় পূর্বপুরুষের করে যাওয়া সেই অছিয়তনামাটি।
গোলাম রহমানের তিন ছেলে বোনদের নামজারি বাতিল চেয়ে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে মামলা দায়ের করেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) দুই বোনের নামে করা নামজারি বাতিল করে দেন। বোনেরা থেমে থাকেননি। এর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সওগাতুল আলমের কাছে। কিন্তু তবু বোনদের অধিকার রক্ষা হয়নি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বোনদের আপিল খারিজ করে দেন। তিনি যুক্তি দেখান, মদন হাজির রেখে যাওয়া উইলটিতে উল্লেখ রয়েছে, অছিয়তনামা চিরকালের জন্য স্থির এবং বহাল থাকবে, যা অছিয়তকারীর প্রার্থনা। অর্থাৎ দুই নারীর সম্পত্তির অধিকারে বাধা হয়ে দাঁড়াল সেই অছিয়তনামাটি। এ রায়টি আসে ১৭ অক্টোবর ২০১২তে। এ নিয়ে কথা হয় সেই দুই বোনের একজন ডেইজী বেগমের সঙ্গে।
পূর্বপুরুষের সম্পত্তি পেতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু একটি অছিয়তনামাই তো বাধা। অধিকার আদায়ে লড়াই কি চালিয়ে যাবেন?
‘আমরা নারীরা কি আজীবন এভাবে বঞ্চিত হয়ে আসব? আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে কে? আমাদের সম্পত্তির অধিকার পেতে একটি অছিয়তনামা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ভাইয়েরা ইচ্ছা করেই আমাদের ঠকাচ্ছে অছিয়তনামার অজুহাতে। ভাইদের ইচ্ছা থাকলে আমাদের সম্পত্তি দিতেন। তাঁদেরই ইচ্ছা নেই। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাব। এ শুধু আমাদের দুই বোনের লড়াই নয়, বাংলাদেশের সব নারীর লড়াই। এ তো শুধু কিছু অংশের দাবি নয়, আমাদের ভবিষ্যৎ কন্যারাও যেন বঞ্চিত না হয়।’
অছিয়তনামায়ই তো আছে, কন্যারা মাসোহারা পাবেন। সেটুকু কি পাচ্ছেন?
‘আমরা তো দূরের কথা, আমার ফুফু-দাদিরাও এ মাসোহারা পেয়েছেন বলে শুনিনি। আর মাসোহারা মাত্র পাঁচ টাকা। এটা কি টাকা হলো? অছিয়তনামা অনুযায়ী নাতিদের মেয়েরা অর্থাৎ আমরা এ সম্পত্তি পাব না, এটা তো বলা হয়নি।’
ডেইজী বেগমের এ বক্তব্য জানাই তাঁর এক ভাই মজিবরকে। মজিবর প্রতিক্রিয়ায় জানান, পূর্বপুরুষের করে যাওয়া দলিল অমান্য করার সুযোগ নেই। ‘আমরা চাইলেও বোনদের সম্পত্তি দিতে পারব না।’
মজিবরকে বলি, আপনারা তো তাহলে ‘পূর্বপুরুষের করে যাওয়া অযৌক্তিক একটি দলিলকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন।
‘অজুহাত নয়। এটাই নিয়ম আমাদের বংশের। আমার ফুফু-দাদিরাও পাননি সম্পত্তি। আমার বোনেরাও পাবে না। আর আদালতও আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন।’
আপনার কি মেয়ে আছে? তাহলে তারাও তো এ নিয়ম অনুযায়ী আপনার সম্পত্তি পাবে না।
‘আমার দুই মেয়ে। হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। আমার মেয়েরাও সম্পত্তি পাবে না। তবে আমার নিজের করা সম্পত্তি আমার মেয়েরা পাবে। আমার মেয়েরা উচ্চশিক্ষিতা। তারা এসব বিষয়ে দাবি করতে আসবে না।’
তাহলে আপনাদের বংশের কোনো মেয়েই এ নিয়ম অনুযায়ী কোনোকালেই সম্পত্তি পাবে না?
‘হ্যাঁ, পাবে না। এটাই পুর্বপুরুষের ইচ্ছা ছিল।’
আপনি মনে করছেন না, বোনদের সম্পত্তি না দেওয়াটা অন্যায়?
‘আমরা তো পূর্বপুরুষের অছিয়তনামার বরখেলাপ করতে পারি না।’
আপনার বোনেরা তো মাসোহারাও পাচ্ছেন না।
‘আমার বোনেরা মাসোহারা পাওয়ার জন্য আসেনি কোনো দিন। আমি আমার বোনদের লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছি। এখন বোনেরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমাদের হয়রানি করছে।’
আমার বোনদের আগে অন্য কোনো নারী তো কোনো মামলা-মোকদ্দমা করে নাই।’
বোনদের বিরুদ্ধে এ ভাইয়ের অভিযোগের শেষ নেই। এ ভাই বলেছেন, তাঁর বোনেরা বেয়াদব। বংশের নিয়ম না মেনে এই ‘বেয়াদব’ বোনেরা সম্পত্তি চাইতে এসেছে। আর এদিকে বোনেরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন অধিকারের জন্য। ১৯২৩ সালে করা একটি উইলের শর্ত ২০১২তে এসেও একটি পরিবারের নারীদের বঞ্চিত করছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই উইলের আরোপিত দেয়াল কি এ পরিবারের মেয়েরা কোনো দিনও ভাঙতে পারবে না?

পাদটীকা:
মুসলিম আইনের বিধান মোতাবেক একজন উইলদাতা যেকোনো আগন্তুক ব্যক্তিকে তাঁর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইলমূলে দান করতে পারে না। উইলকারী এক-তৃতীয়াংশের বেশি উইল করলেও
এক-তৃতীয়াংশ কার্যকর হবে এবং বাকি অংশ আইনে অগ্রাহ্য হবে। যে অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ থাকবে, তা স্বাভাবিক ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা যাবে।
মুসলিম আইনের বিধানমতে, উইলদাতার মৃত্যু পর যাঁরা ওয়ারিশ বলে গণ্য হবেন, তাঁদের বরাবর কোনো সম্পত্তি উইল করতে পারবেন না। কোনো সম্পত্তি ওয়ারিশের বরাবর উইল করলে তা বৈধ হবে না বটে, তবে উইলদাতার মৃত্যুর পর তাঁর অন্যান্য ওয়ারিশ অনুমোদন বা সম্মতি দেন, তাহলে উইলটি কার্যকর বা বৈধ হবে।
tanzimlaw@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.