অর্থনীতির সূচকের আলোকে বাংলাদেশ অধ্যাপক by ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ
বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে অবস্থান করছে। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের তালিকায় চীন, ব্রাজিল, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কের পরেই রয়েছে বাংলাদেশ। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের জন্য একটি ভাল ও আশাপ্রদ সংবাদ।
এতে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক অগ্রগতির কাক্সিক্ষত পথেই ধাবমান, সেটিও স্পষ্ট হলো। বিশ্বব্যাংকের ‘বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে আশার কথাই বলা হয়েছে। উন্নয়ন প্রতিবেদনের ভূমিকায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বলেছেন, ‘কর্মসংস্থান তৈরিতে বেসরকারী খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রায় ৯০ শতাংশ কর্মসংস্থান হয়েছে বেসরকারী খাত থেকে।’ বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রতি ইঙ্গিত করেই উন্নয়ন প্রতিবেদনের ভূমিকায় এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে বলা হয়েছে, কিছু দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভাল করেছে, কিছু দেশ ভাল করেছে মানব উন্নয়ন সূচকে। যে কয়টি দেশ উভয় সূচকেই ভাল করেছে বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। গত ৫০ বছর ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে নগরায়নের ফলে যে উন্নয়ন ঘটেছে তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান মোটামুটি প্রথমদিকে। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহরকে কেন্দ্র করে দেশটিতে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। অর্থনীতিতে বর্তমানে শিল্প খাতের অবদান ৩০ শতাংশ। আজ থেকে ২০ বছর আগে যা ছিল ২০ শতাংশ। ১৯৯০ সালে দেশটির জিডিপিতে রফতানি খাতের অবদান যা ছিল, ২০১০ সালের মধ্যে তা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য; যাতে নারী শ্রমিকদের অবদান বেশি। এই শিল্পে এখন ৩০ লাখ নারী কাজ করছেন। এছাড়া বহু শ্রমিক দেশের বাইরে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন। দেশটির প্রবাসী আয় প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। পাশাপাশি কৃষি খাতের উন্নয়নে দেশটির জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে দ্রুত গতিতে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর লেখা বইয়ে দেশটিকে উন্নয়নের ‘পরীক্ষা ক্ষেত্র’ হিসেবে বলা হয়। অধিক জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, অনুন্নত অবকাঠামো, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে এই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত রাখায় বাংলাদেশ সম্পর্কে এ ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রযুক্তির ব্যবহার দেশটির কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে। বেশিরভাগ কৃষি জমিতে এক ফসলের জায়গায় দুই ফসল ও উচ্চফলনশীল জাত বেছে নেয়া হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিক রয়েছে। মঙ্গা সময়ের মৌসুমী ক্ষুধা এখন আর নেই। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতাও উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, দুর্নীতি দেশটির একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচালন ব্যয় বেশি। বিদ্যুত সঙ্কট এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশটি। রাজধানী এবং দেশের বড় শহরগুলোর রাস্তাঘাটে রয়েছে নিত্য যানজট।
সরকার বাজেটে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলেছে তারপরও বলা যায় চলতি অর্থবছরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও বাংলাদেশের জন্য স্বাস্থ্যকর। কারণ ইউরো জোনের অর্থনৈতিক সঙ্কট সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েনি; তবে রফতানি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়েছে। আইএমএফ যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রকাশ করেছে তাতে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসের দিক দিয়ে বিশ্বের ১৫০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫তম। রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা। কারণ ইউরোজোনের দেশগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম ক্রেতা। এই ক্রেতারা তাদের অর্থনীতি পুননির্মাণ করতে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করায় এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে।
চলমান বিশ্বমন্দার প্রভাবে উন্নয়নশীল তো বটেই, গ্রিস ও ইতালির মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর বিপরীতে সীমিত স¤পদের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ উন্নয়নের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষি, শিক্ষা, মা ও শিশুমৃত্যু, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীসহ বিভিন্ন খাতে যুগান্তকারী উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প ও কৃষিজ উৎপাদন, মাথাপিছু বিদ্যুত ও জ্বালানি ব্যবহারের হার, শিক্ষা বিশেষত নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রবৃদ্ধিসহ অন্যান্য সূচকে দেশটি ব্যাপক উন্নতি করেছে।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩.২ শতাংশ হারে বেড়েছে। আবার ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি গড়ে ৪.৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। আর এখন বাড়ছে ৬ শতাংশেরও বেশি হারে। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার পাকিস্তান, নেপালসহ এ অঞ্চলের অপরাপর দেশ থেকে ভাল অবস্থানে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৪৮৭ ডলার থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৮১৮ ডলারে পৌঁছেছে যা বাংলাদেশকে দ্রুতই একটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করছে। ২০১৫ সালের মধ্যে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে ১৬টি দেশ সাফল্য দেখাতে পেরেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, নারী উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা ও কৃষি উন্নয়ন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা প্রথমবার আঘাত হানে ২০০৭ সালে। এরপর ২০১১ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার বড় ধাক্কা ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। মন্দা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো বিপুল বাজেট ঘাটতি, উচ্চ সরকারী ঋণ, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হার বৃদ্ধিসহ কয়েকটি দেশের সার্বভৌম ঋণ সমস্যা প্রবৃদ্ধির গতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশের চলতি হিসাবে বিশাল আকারের ঘাটতি এবং জ্বালানি তেল রফতানিকারক দেশ ও কয়েকটি বিকাশমান অর্থনীতির চলতি হিসাবে বিশাল আকারে উদ্বৃত্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। এ ভারসাম্যহীনতা কমিয়ে আনার ব্যর্থতা বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে অনেকটা নাজুক করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে নীতিনির্ধারণে সমন্বয়ের অভাবও বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাপনার সংস্কার কার্যক্রমকে বিলম্বিত করছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশে চাপ অনুভূত হয় এবং এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি ও সরকারী ঋণের বৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বিশ্বমন্দার সম্ভাব্য প্রভাব স¤পর্কে যথাযথ আগাম ধারণা অর্জন এবং সে প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক উদ্যোগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মতো নানাবিধ সহায়তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে মন্দার বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। মন্দার প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আবাসন শিল্পে ধস নামা ও দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি রফতানি বৃদ্ধির গতি কিছুটা হ্রাস পায়। তবে এ সময় রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকে।
বেকারত্ব কমানো ও কর্মসংস্থান বাড়ানোতে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪৬তম। ভারত এক্ষেত্রে ১১১তম, আফগানিস্তান ১৮০তম, পাকিস্তান ১৫২তম এবং নেপাল ১৯০তম। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের পঞ্চম জনশক্তি রফতানিকারক দেশ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ও রাজস্ব খাতে গৃহীত ব্যবস্থার পাশাপাশি মুদ্রা খাতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পর পর কয়েকটি মৌসুমে ধানের ভাল উৎপাদন হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দামে অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে খাদ্য সমস্যায় পড়তে হয়নি। এসব বিবেচনায় বলা যায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। কখনও ঋণাতœক প্রবৃদ্ধি এ দেশে দেখা যায়নি। স্বাধীনতার আগে ও পরে এ দেশে মাত্র কয়েক বছর অর্থনীতির অবস্থা খারাপ ছিল এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতি নাজুক থাকাটা তখন অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীনতার পর পর এদেশে মাত্র কয়েক শ’ কোটি টাকার বাজেট ছিল। এখন তা লাখো কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এটা যেকোন মাপকাঠিতে খুব বড় একটি অর্জন। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যতটুকু এগিয়েছে, সরকার দূরদর্শী ও আরো বেশি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে সক্ষম হবে এবং বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
No comments