অর্থনীতি ও জীবনমান উন্নয়ন
বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান ক্রমাগত উন্নতির দিকে যাচ্ছে। মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে মানুষের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ থেকে এগিয়ে।
সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগ এবং মানুষের সচেতনতাই এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নানা রকম অসঙ্গতির মাঝে এই দেশের মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। সারা বিশ্ব যখন মন্দার কবলে প্রকম্পিত তখনও আমাদের দেশের অর্থনীতির সূচকে দেখা যায় অগ্রগতি। মানুষের আয় এবং ক্রয়ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। যদিও দ্রব্যমূল্যর উর্ধগতি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করেছে তবুও শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রগতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পূণ অবদান রেখেছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের ‘ইনসাইটস সাউথ এশিয়া : বাংলাদেশ সার্ভে ২০১২ রেজাল্টস’ শীর্ষক জরিপে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানের যে উন্নয়ন ঘটেছে তা তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করে, গত পাঁচ বছরে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। ৩৮ শতাংশ এ ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করে। এর মধ্যে অনেকের জীবনমান অপরিবর্তিত থাকলেও কারও কারও ক্ষেত্রে তা খারাপ হয়েছে। বেশির ভাগ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের চিত্রই বাংলাদেশের মাানুষের সমৃদ্ধিকেই ইঙ্গিত করে। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটা দিক।বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর জরিপটি পরিচালনা করে গ্যালাপ। প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫৯টি প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করা হয়। জরিপের জন্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগের ৩৩ শতাংশ, চট্টগ্রামের ১৯, খুলনার ১১, রাজশাহীর ২৩, সিলেটের ৭ ও বরিশাল বিভাগের ৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী নির্বাচন করা হয়। জরিপে অংশ নেয়া ৬২ শতাংশই গত পাঁচ বছরে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে বলে উল্লেখ করে। ২০ শতাংশ মনে করে, এ সময়ের মধ্যে তাদের জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে আর ১৮ শতাংশের অবস্থা অপরিবর্তিত। ৬৭ শতাংশ মনে করে, তাদের জীবনযাত্রার মান ক্রমেই উন্নত হচ্ছে। আর ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে বলে মনে করে ২১ শতাংশ। জরিপে জীবনমান ছাড়াও অর্থনৈতিক অবস্থা, অভিবাসন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বা সংযোগ, সার্কভুক্ত দেশগুলো সম্পর্কে মনোভাব ও সম্পর্ক উন্নয়নে সুবিধা ইত্যাদি বিষয়ের ওপরও প্রশ্ন করা হয়। জরিপানুযায়ী দেখা যায়, ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে, বর্তমানে দেশের অর্থনীতির অবস্থা মোটামুটি ভাল। ৩৭ শতাংশ মনে করে, অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল আর ২০ শতাংশের মতে অবস্থা খারাপ। মাত্র ৩ শতাংশ জনগণ মনে করে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভাল। এ ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ জনগণ মনে করে, অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান বাধা। ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ জনগণ দুর্নীতিকে এ দেশের উন্নয়নের বাধা বলে মনে করে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫২ শতাংশ মনে করে, আগামীতে এ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরও ভাল হবে। আর ৪০ শতাংশ মনে করে, অবস্থা আরও খারাপ হবে।
গ্যালাপের জরিপে যে নমুনায়ন করা হয়েছে তা সমগ্র বাংলাদেশের মানুষকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। এই জরিপেই ফুটে ওঠে যে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই মনে করে তাদের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। একটা সময় ছিল বেশির ভাগ মানুষই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারত না । কিন্তু এখন দিন দিন মানুষের কর্মসংস্থান বাড়ছে। ফলে বাড়ছে মানুষের আয়। দেশের প্রায় আশি লাখ শ্রমিক বিদেশে কাজ করে দেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাঠাচ্ছে । ফলে শহুরে র্অথনীতির সাথে সাথে গ্রামীণ র্অথনীতিতে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। দেশের পোশাক শিল্পের সাথে সাথে আরও নানামুখী শিল্প গড়ে ওঠেছে যেগুলো বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে। আবার কৃষিতে বাম্পার ফলন আমাদের র্অথনীতিকে শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক। এজন্য নানা রকম ঋণ সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। ফলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে অনেক যুব সমাজ। মানুষের ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটেছে। আবার সরকার কর্তৃক গৃহীত নানা কর্মসূচীও মানুষের জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কার ও উদ্যোগ ঝরে পড়ার হার হ্রাস করেছে। শিক্ষার গুণগত মানের উন্নয়ন ঘটেছে। আবার উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেরও উন্নয়ন ঘটেছে। দেশে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যর উন্নয়ন যেমন ঘটেছে তেমনি মা ও শিশু মৃত্যু হারও অনেক হ্রাস পেয়েছে।
আবার রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি, খাদ্য স্বয়ংসর্ম্পূণতাসহ বিভিন্ন শিল্পবিকাশের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। এটি দেশের অর্থনীতি যে শক্তিশালী হচ্ছে তারই প্রমাণস্বরূপ। আর এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রা যে উন্নতির দিকে তারই প্রতিচ্ছবি। মানুষের জীবনযাপন প্রণালীতে ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন সাধিত হলেও এখনও যানজট, জীবনের নিরাপত্তায় ঘাটতি, রাজনৈতিক উত্তপ্ততা, দ্রব্যমূল্যর লাগামহীন বেড়ে চলাসহ নানামুখী সমস্যার কবলে সাধারণ মানুষের জীবন জর্জরিত। তবে উন্নয়নের যে গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতি একদিকে শক্তিশালী ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে আবার মানুষের জীবনমানও আরও উন্নত ও সুন্দর হবে।
আনোয়ার হোসেন
No comments