উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ by ড. মিল্টন বিশ্বাস
চলতি বছরের (২০১৩) ৬ জানুয়ারি মহাজোট সরকারের রাষ্ট্রক্ষমতার শেষ বছরের গণনা শুরু হলো। ২০০৯ সালের এই দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা শপথ গ্রহণ করেন। সেই বছরই পিলখানা হত্যাযজ্ঞসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেশ এগিয়ে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হয় তাঁর মন্ত্রিপরিষদকে।
ক্ষমতায় আসার পর দেশের উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ জনগণের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রশংসনীয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষা খাতে ঐতিহাসিক সংস্কার ও যুগান্তকারী পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর সাফল্য আকাশচুম্বী। তবে বেশির ভাগ সংবাদপত্র বা মিডিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সেই সাফল্যের দৃষ্টান্তগুলো উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো তথা ছাত্র সংঘর্ষ, উপাচার্য অপসারণ প্রভৃতি খবরের নিচে এ স্তরে বর্তমান সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো অনুচ্চারিত থেকে যায়। এ জন্য উচ্চশিক্ষায় বর্তমান সরকারের অবদান পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। ক্ষমতা গ্রহণের পর মহাজোট সরকার চার বছর অতিবাহিত করেছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনও এই সময় অতিক্রম করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপিত মুক্তবুদ্ধি পরিচর্যার প্রবেশপথ ও শৃঙ্খলার সঙ্গে বিদ্যাচর্চার নিরাপদ কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়ভারের শতভাগ সরকারকেই বহন করতে হচ্ছে, যদিও সেই বরাদ্দ গবেষণা পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ সরকারি বরাদ্দের বেশির ভাগ ব্যয় হয় সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষক এবং ১৫ হাজার কর্মকর্তা ও ১৬ হাজারের ওপর কর্মচারীর বেতন-ভাতায়।
কালের কণ্ঠে ৩১ ডিসেম্বর (২০১২) প্রকাশিত 'মহাজোট সরকার : ভালো-মন্দের ৪ বছর, পরিবর্তন ও চমকে ঠাসা শিক্ষাঙ্গন' শীর্ষক সংবাদে বর্তমান মহাজোট সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের বিবরণ দেওয়া হলেও উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষণ অনুপস্থিত। ওই পত্রিকায় গত ১ জানুয়ারি প্রকাশিত 'বছরজুড়ে আলোচনায় বুয়েট ও জাবি' শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে, অবৈধ পদোন্নতিসহ অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অপসারিত হন ভিসি ও প্রোভিসি। এই সংবাদও উচ্চ বিদ্যাপীঠের সম্পূর্ণ চিত্র নয়। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের সংঘর্ষ ও হতাহতের খবর এবং একে কেন্দ্র করে শিক্ষাকার্য ব্যাহত হওয়ার বিবরণ যথার্থ। জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্দোলনে ক্লাস না হওয়া এবং বুয়েটের একটানা ৪৪ দিন ক্লাস বন্ধ থাকা কিংবা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা অবশ্যই উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের নেতিবাচক দিক। তবে একই সময়ে কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গায় জ্ঞানচর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা জানা যায়। গত বছর (২৩-৮-২০১২) শ্রীলঙ্কায় বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিতে একটানা শিক্ষক ধর্মঘটের কারণে সরকার দেশটির প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। যুক্তরাজ্যে টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। অবশ্য ভারতে বর্তমান সোনিয়া-মনমোহন সরকার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বিল পাস করেছে, যেগুলো আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় গৃহীত বৈপ্লবিক কিছু সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিল ২০১১, তার আগে 'অ্যাক্রিডিটেশন অব হাইয়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটস বিল ২০১০' এবং ২০১০ সালে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিল পাস হয়েছে। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে সেখানেও বিশ্বব্যাংকের ঋণ বরাদ্দ রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৬০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখের কিছু বেশি। জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণের রীতি নেই। এ দুটি বাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ (৭১ শতাংশ) এবং ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ হাজারের ওপর (২৯ শতাংশ)। পাবলিকের তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। ২০১১ সালে আরো ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে ক্যাথলিক ফাদারদের পরিচালিত নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেতে এখনো সময়ের প্রয়োজন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। উচ্চশিক্ষাকে ১৬ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের সময় একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো অনেক। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সুবিধার জন্য রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিলিটারি ও নেভাল একাডেমীসহ সামরিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। ঢাকার টেঙ্টাইল কলেজকে বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়েছে। কারিগরি তথা বস্ত্র খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশীয় বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্যই এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দেশের মধ্যে একাধিক বেসরকারি ডিজাইন ইনস্টিটিউট থাকলেও কোনো 'ডিজাইন ও ফ্যাশন বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হচ্ছে না- এটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। বস্ত্র খাতের বিশাল বাজার সত্ত্বেও এ ধরনের বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব দুঃখজনক, যদিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে 'ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়', 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়', 'ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' ও 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়' উল্লেখযোগ্য।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সংকট তৈরি করা হয়েছিল অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অধিভুক্ত কলেজগুলোকে দুর্নীতির আখড়া বানানো হয়েছিল, এমনকি সে সময়ের একজন সাবেক উপাচার্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে বর্তমান সরকারের আমলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে এর কার্যকারিতা ও মান বৃদ্ধির কাজ চলছে। সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করা হচ্ছে অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। তাদের নিয়ে এর আগে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। বর্তমানে বিধিবিধান তৈরি করে গতি আনা হয়েছে পরীক্ষাসংক্রান্ত ও অন্যান্য কার্যক্রমে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বেসরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি দূরশিক্ষণনির্ভর ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এর প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ও ঝরে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি ও বিশেষভাবে কর্মজীবীদের দক্ষতা এবং তাদের উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করাই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বর্তমান সরকারের চার বছরে ব্যাপক গতি সঞ্চার হয়েছে। দেশে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট বর্তমান সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ১৯৯২ এবং ১৯৯৮ সালের সংশোধিত আইন ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হওয়ায় ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন নতুনভাবে প্রণীত হয়েছে। নতুন আইনের আলোকে উচ্চশিক্ষার মান উন্নীতকরণসহ উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্যও বলা হয়েছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় জমি কিনে একাডেমিকসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করে নিজস্ব ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান নিশ্চিতকরণ ও তা বিশ্ব পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর আলোকে 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ২০১২' প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ। শিগগিরই তা বাস্তবায়িত হবে বলে জানা গেছে। দু-একটি বাদে এত দিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয় প্রচলিত ছিল না। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অনুরোধ রক্ষা করেছে অনেকেই; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিভাগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদেশি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান ও পরিচালনা সংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উৎসাহী করেছে। হেকেপসহ (HEQAEP) দুটি প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য ২০১২ সালে দেশের ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৬টি গবেষণা উপ-প্রকল্পে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযুক্তি একটি অনিবার্য দিক। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগে উচ্চ গতিসম্পন্ন ডাটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। ঢাকা, বুয়েট, শেরেবাংলা নগর কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল, জাহাঙ্গীরনগর ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে Bangladesh Research and Education Network (BdREN) Connectivity স্থাপিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের রক্ষক হিসেবে পরিগণিত। কেবল রক্ষক বললে ভুল হবে; বরং সেই জ্ঞানকে সাধনার মাধ্যমে, বোধশক্তি ও প্রজ্ঞার দ্বারা বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। এসব লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণীর বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সহায়ক হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সৃজনশীলতার সূতিকাগার। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজকে এগিয়ে নেয়- এ ভাবনা আমাদের অস্থিমজ্জায় লালন করা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email : writermiltonbiswas@gmail.com
কালের কণ্ঠে ৩১ ডিসেম্বর (২০১২) প্রকাশিত 'মহাজোট সরকার : ভালো-মন্দের ৪ বছর, পরিবর্তন ও চমকে ঠাসা শিক্ষাঙ্গন' শীর্ষক সংবাদে বর্তমান মহাজোট সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের বিবরণ দেওয়া হলেও উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষণ অনুপস্থিত। ওই পত্রিকায় গত ১ জানুয়ারি প্রকাশিত 'বছরজুড়ে আলোচনায় বুয়েট ও জাবি' শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে, অবৈধ পদোন্নতিসহ অনিয়ম ও দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে অপসারিত হন ভিসি ও প্রোভিসি। এই সংবাদও উচ্চ বিদ্যাপীঠের সম্পূর্ণ চিত্র নয়। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগঠনের সংঘর্ষ ও হতাহতের খবর এবং একে কেন্দ্র করে শিক্ষাকার্য ব্যাহত হওয়ার বিবরণ যথার্থ। জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আন্দোলনে ক্লাস না হওয়া এবং বুয়েটের একটানা ৪৪ দিন ক্লাস বন্ধ থাকা কিংবা কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা অবশ্যই উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের নেতিবাচক দিক। তবে একই সময়ে কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর অনেক জায়গায় জ্ঞানচর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টির ঘটনা জানা যায়। গত বছর (২৩-৮-২০১২) শ্রীলঙ্কায় বরাদ্দ বৃদ্ধি ও সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবিতে একটানা শিক্ষক ধর্মঘটের কারণে সরকার দেশটির প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। যুক্তরাজ্যে টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল। অবশ্য ভারতে বর্তমান সোনিয়া-মনমোহন সরকার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বিল পাস করেছে, যেগুলো আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় গৃহীত বৈপ্লবিক কিছু সিদ্ধান্তের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা বিল ২০১১, তার আগে 'অ্যাক্রিডিটেশন অব হাইয়ার এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটস বিল ২০১০' এবং ২০১০ সালে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিল পাস হয়েছে। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে সেখানেও বিশ্বব্যাংকের ঋণ বরাদ্দ রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৬০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে চার লাখের কিছু বেশি। জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠ গ্রহণের রীতি নেই। এ দুটি বাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংখ্যা প্রায় দেড় লাখ (৭১ শতাংশ) এবং ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ হাজারের ওপর (২৯ শতাংশ)। পাবলিকের তুলনায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি। ২০১১ সালে আরো ৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে ক্যাথলিক ফাদারদের পরিচালিত নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেতে এখনো সময়ের প্রয়োজন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। উচ্চশিক্ষাকে ১৬ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এবং দক্ষ জনগোষ্ঠী সৃষ্টির লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের সময় একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো অনেক। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সুবিধার জন্য রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মিলিটারি ও নেভাল একাডেমীসহ সামরিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। ঢাকার টেঙ্টাইল কলেজকে বাংলাদেশ টেঙ্টাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়েছে। কারিগরি তথা বস্ত্র খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশীয় বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্যই এ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দেশের মধ্যে একাধিক বেসরকারি ডিজাইন ইনস্টিটিউট থাকলেও কোনো 'ডিজাইন ও ফ্যাশন বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হচ্ছে না- এটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি। বস্ত্র খাতের বিশাল বাজার সত্ত্বেও এ ধরনের বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব দুঃখজনক, যদিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে 'ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়', 'রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়', 'ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' ও 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়' উল্লেখযোগ্য।
বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। সংকট তৈরি করা হয়েছিল অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অধিভুক্ত কলেজগুলোকে দুর্নীতির আখড়া বানানো হয়েছিল, এমনকি সে সময়ের একজন সাবেক উপাচার্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে বর্তমান সরকারের আমলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করে এর কার্যকারিতা ও মান বৃদ্ধির কাজ চলছে। সময়মতো পরীক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করা হচ্ছে অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। তাদের নিয়ে এর আগে কোনো পরিকল্পনা করা হয়নি। বর্তমানে বিধিবিধান তৈরি করে গতি আনা হয়েছে পরীক্ষাসংক্রান্ত ও অন্যান্য কার্যক্রমে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বেসরকারি কলেজে শিক্ষক নিয়োগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পাঠানো হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি দূরশিক্ষণনির্ভর ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এর প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত ও ঝরে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি ও বিশেষভাবে কর্মজীবীদের দক্ষতা এবং তাদের উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করাই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম লক্ষ্য।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বর্তমান সরকারের চার বছরে ব্যাপক গতি সঞ্চার হয়েছে। দেশে যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট বর্তমান সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ১৯৯২ এবং ১৯৯৮ সালের সংশোধিত আইন ত্রুটিপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ হওয়ায় ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন নতুনভাবে প্রণীত হয়েছে। নতুন আইনের আলোকে উচ্চশিক্ষার মান উন্নীতকরণসহ উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্যও বলা হয়েছে। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় জমি কিনে একাডেমিকসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করে নিজস্ব ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ ধরনের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুণগতমান নিশ্চিতকরণ ও তা বিশ্ব পর্যায়ে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর আলোকে 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ ২০১২' প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ প্রায় শেষ। শিগগিরই তা বাস্তবায়িত হবে বলে জানা গেছে। দু-একটি বাদে এত দিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয় প্রচলিত ছিল না। বর্তমান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অনুরোধ রক্ষা করেছে অনেকেই; স্নাতক ও স্নাতকোত্তর বিভাগে বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়ানো হচ্ছে।
বাংলাদেশে বিদেশি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থান ও পরিচালনা সংক্রান্ত প্রবিধানমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়নে মনোযোগী হওয়ায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে উৎসাহী করেছে। হেকেপসহ (HEQAEP) দুটি প্রকল্পের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার জন্য ২০১২ সালে দেশের ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৬টি গবেষণা উপ-প্রকল্পে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সংযুক্তি একটি অনিবার্য দিক। আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক যোগাযোগে উচ্চ গতিসম্পন্ন ডাটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। ঢাকা, বুয়েট, শেরেবাংলা নগর কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল, জাহাঙ্গীরনগর ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে Bangladesh Research and Education Network (BdREN) Connectivity স্থাপিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারের রক্ষক হিসেবে পরিগণিত। কেবল রক্ষক বললে ভুল হবে; বরং সেই জ্ঞানকে সাধনার মাধ্যমে, বোধশক্তি ও প্রজ্ঞার দ্বারা বৃদ্ধি করা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করার দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়ের। সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যে সুস্থ মানসিকতা ও উচ্চ মানসম্পন্ন মনন সৃষ্টি করাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য। মুক্তচিন্তার চর্চা, নিরাসক্তভাবে সত্যের অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ। এসব লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম শ্রেণীর বিদ্যাপীঠে পরিণত করতে সহায়ক হবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সৃজনশীলতার সূতিকাগার। নতুন জ্ঞান সৃষ্টির প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা ও আবিষ্কার সমাজকে এগিয়ে নেয়- এ ভাবনা আমাদের অস্থিমজ্জায় লালন করা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
email : writermiltonbiswas@gmail.com
No comments