হুমকির মুখে ভারতের শিল্প খাত
দিন দিন ঝুঁকির মুখে পড়ে যাচ্ছে ভারতের শিল্প খাত। ভারতের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি শিল্প খাত। কিন্তু এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাচ্ছে যা শুধু এই শিল্প খাতকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং ভারতের সামগ্রিক অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করছে।
বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ভারতের শিল্প খাত পুনরুদ্ধারের আশা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। দেশটির শিল্প খাতের ওপর পরিচালিত এক বার্ষিক জরিপে (এএসআই) এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতের অবস্থার ওপর মাঠপর্যায়ে এ জরিপ পরিচালিত হয়। এ জরিপে ২০১১-১২ অর্থবছরের তথ্যাদির সঙ্গে ২০১০-১১ অর্থবছরের তথ্যাদির তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপের মোট স্যাম্পল (নমুনা) সাইজ ছিল ৬১ হাজার ৫৭৩, যা দেশটির মোট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিটের ২৭ শতাংশ। জরিপে দেখানো হয়, ২০১০-১১ সালে নিট স্থায়ী মূলধন গঠন কমেছে দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অথচ এ খাতে এক বছর আগেও প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। জরিপে ব্যবসায়ের ব্যয় বাড়ছে বলে দেখানো হয়। এ কারণে নতুন বিনিয়োগ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১০-১১ সালে সুদ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ২০ শতাংশ। ২০০৯-১০ সালে এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০১০-১১ বছরে ভাড়া বেড়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি এবং সম্পত্তির দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও এই ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করেছে। অদূর ভবিষ্যতে শিল্প প্রবৃদ্ধির পুনরুদ্ধারের তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বিরাজ করায় এই পুনরুদ্ধার আরও হতাশার মধ্যে পড়ে গেছে। ২০০৯ সালে বিনিয়োগ বাড়ে সর্বোচ্চ। কারণ সে সময়ে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ায় চাহিদাও বেড়েছিল সর্বোচ্চ। এরপর থেকেই চাহিদা কমতে শুরু করে। এখন চাহিদা কমে এসেছে । এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগের ওপর। তাছাড়া রুপার দাম কমে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণের ব্যয়ও বেড়েছে। ঋণের ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং কঠোর মুদ্রানীতির কারণে সার্বিকভাবে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসায়িক আস্থার দুর্বল অবস্থান, স্থায়ী মূলধনে বিনিয়োগ হ্রাসের পাশাপাশি চাহিদা কমে যাওয়ায় শিল্প প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।শিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস ও নিম্নধারা দেশটির কর্পোরেট খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মুনাফা ৬১ শতাংশ অর্জিত হলেও তা ২০১০-১১ অর্থবছরে কমে ৫৫ শতাংশে পৌঁছে। গত দুই-তিন বছরে মুনাফা প্রবৃদ্ধির হার কমছে। উৎপাদন প্রবৃদ্ধি কমতে থাকায় মুনাফার অংশও কমছে। এর ফলে করপোরেট খাতেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এই পরিস্থিতি ভারতের অর্থনীতির সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। জরিপে ভারতের উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। মূলত প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। সরবরাহের দিক থেকে মূলধনী ব্যয় কমে আসার সম্ভাবনা থাকলেও বর্তমানে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু চাহিদা খাতে এখনও বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা। আর এই অনিশ্চয়তাই শিল্প খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে শুধু রফতানি চাহিদাই কমেনি, কমেছে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও। ফলে লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে অনেক শিল্প খাতের বিনিয়োগকারী। এই মাসে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) মুদ্রানীতি পর্যালোচনায় পলিসি রেট আরও কমানো হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এর ফলে শিল্প খাতের পুনরুদ্ধার হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করছেন। সুদের হার কমানোর ফলে ভোক্তা চাহিদা বাড়বে ঠিকই, কিন্তু বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হবে না। বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারে সুদের হার হলো এমন একটি উপাদান, যার প্রভাব থাকে খুব সীমিত। যতক্ষণ পর্যন্ত অবকাঠামো অর্থায়ন এবং আর্থিক একীভূতকরণ নীতিমালা শিথিল না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা যদি অর্জন করা না যায় তবে ভারতের শিল্প খাতের পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে যা ভারতের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। শিল্প খাতের দুরবস্থার কারণে ইতোমধ্যে ভারতে বেকারত্ব বাড়ছে। দেশটির ৪২ কোটি শ্রমগোষ্ঠীর মধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ কর্মসংস্থান বাজারের বাইরে রয়েছে। অর্থনীতির অন্যান্য অংশের তুলনায় শিল্প-কারখানাগুলোয় কর্মী নিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। আর এর ফলে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক দুই অর্থনীতিই হুমকির সম্মুখীন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভারতকে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রতি জোর দেয়া, দেশীয় উদ্যোক্তাদের নতুন করে প্রণোদনা দেয়া, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিসহ আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর তা না হলে ভারতের শিল্প খাতের পুনরুদ্ধার করা সত্যিই কষ্টদায়ক হয়ে পড়বে।
এআরএস পাটোয়ারী
No comments