সম্ভাবনার দেশ- মিলু শামস
ক্রিস্টিন-ক্রিস্টোফার দম্পতি ইতালি থেকে এসেছে বাংলাদেশ দেখতে। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে সিলেট-শ্রীমঙ্গল, পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সুন্দরবনের পথে পাড়ি জমিয়েছে। আমাদের সঙ্গে দেখা বান্দরবানে।
ওদের বাংলাদেশ দর্শনের সঙ্গে ডেভিড এ্যাটেনবরোর বানানো ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রে গান্ধীর ভারত দর্শনের কোন মিল না থাকলেও বেখাপ্পাভাবে কেন যেন দৃশ্যটি মনে পড়ে যায়। রাজনীতিতে সরাসরি নামার আগে ট্রেনে চেপে গান্ধী ভারত দর্শনে বেরিয়ে পড়েন। অল্প সময়ে পুরো ভারতের বৈচিত্র্যময় নিসর্গ চক্কর দিয়ে তিনি কোমর বেঁধে অহিংসা-অসহযোগ চরকা কাটা ইত্যাদি এজেন্ডা নিয়ে রাজনীতির মাঠে নামেন। এ্যাটেনবরো এমন হাস্যকর উপস্থাপনই করেছেন। ভারতীয় জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন যেন এক শৌখিন বিষয় বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া গণমানুষের সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক নেই। এ্যাটেনবরো অনেক ভেল্কিই দেখিয়েছেন ওই চলচ্চিত্রে। সাধারণভাবে চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিশেষভাবে দেখলে অনেক অসঙ্গতিই চোখে পড়ে। প্রচলিত রাজনীতির কূটচাল মতলববাজকে ‘মহাত্মা’ বানায় আবার সত্যিকারের মহাত্মাদের ধুলো পড়া ইতিহাসের আড়ালে ঢেকে দেয়। অনেক বিপ্লবী রাজনৈতিক উক্তি, বক্তৃতা বিবৃতি ও মননশীল বই জওহরলাল নেহরুর যে প্রখর ব্যক্তিত্বের ইমেজ তৈরি করেছিল রাজনীতির বাস্তব মাঠে তা একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে তিনি মূলত গান্ধীর বগলদাবা কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুকে নিজের ধামাধরা বানাতে পারেননি গান্ধী। স্বাধীনতার পক্ষে আগাগোড়া উচ্চকণ্ঠ সুভাষ বোসকে নিয়ে তাই চিন্তিত হতে হয় তাঁকে। ভারতীয় জাতীয় রাজনীতি থেকে ট্রাকচ্যুত করার কলকাঠি নাড়া তাই জরুরীই হয়ে পড়ে। এ্যাটেনবরোও তার এত বড় চলচ্চিত্রে সুভাষকে একবারের জন্যও জায়গা দেননি।যা হোক, ক্রিস্টিন-ক্রিস্টোফার নিশ্চয়ই উপমহাদেশের রাজনীতির সাতকাহন বিস্তারিত জানে না। জানার আগ্রহও না থাকাই হয়ত স্বাভাবিক। ওরা এখনকার বাংলাদেশে বেড়াতে এসে হরতালের চক্করে পড়ে কিছুটা বিপর্যস্তÑ আপাতত এ নিয়েই ভাবছে। তবে তাতে ওদের বেড়ানোর আনন্দে ভাঁটা পড়েনি। এ দেশের নিসর্গ ওদের মুগ্ধ করেছে। করারই কথা। পাঁচ মাইল একসঙ্গে ট্রেকিং শেষে যখন বোটে করে শহরে ফিরছি তখন মুগ্ধতায় আমাদের চোখও আচ্ছন্ন। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে সবুজ গ্রাম। মাঝখানে এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে নদী। কি অপূর্ব। বোটের ছাদে বসে ঘণ্টা দেড়েকের ওই যাত্রা ভুলিয়ে দিয়েছে শহুরে ক্লান্তি ও কাজের ব্যস্ততা। মনে হচ্ছিল শিল্পীর আঁকা ক্যানভাসে চলমান ল্যা-স্কেপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ক্রিস্টোফার একের পর এক ছবি তুলছে। ট্রেকিং শুরুর আগে এক মুরং পল্লীতে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের খাঁজে বিবর্ণ গ্রাম। ওদের জীবনের মূল লক্ষ্য এখনও বেঁচে থাকার জন্য খাবার সংগ্রহ করা। তবে এনজিও ও সরকারী সহায়তায় গত কয়েক বছরে কিছু গ্রামে সামাজিক সচেতনতামূলক কাজ শুরু হয়েছে। স্কুল মাতৃসেবা ক্লিনিক ইত্যাদি হয়েছে। নিয়মিত এনজিও কার্যক্রম আছে বেশকিছু গ্রামে। বেশ প্রশস্ত এক ভ্যালিতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর আওতায় তামাক চাষ হচ্ছে। সারি সারি সর্ষে ক্ষেতে হলুদ ফুল আর ফুলের থোকায় থোকায় মৌমাছি। কান পাতলে গুঞ্জন শোনা যায়। এও এক অপূর্ব দৃশ্য। আমাদের ট্রেকিং শেষ হয়েছিল ফসল ভরা মাঠের এক গ্রামের প্রান্তে। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ হেঁটে এ গ্রামে ঢুকতেই মনে হচ্ছিল, পৌঁছে গেছি এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের চেয়েও মনোরম কোনো দেশে। এ গ্রামে ফসলের ক্ষেত আছে, আছে মাঠের পর মাঠ তামাক গাছ। উত্তর দিক ঘেঁষে সবুজ পাহাড়। আর এসবের সঙ্গে আছে ইট ভাঁটা। হ্যাঁ, ইট ভাঁটাওয়ালারা বেশ জাঁকিয়েই বসেছে মনে হয়। বুঝলাম পাহাড়ের এ সৌন্দর্যের আয়ু আর বেশিদিন নেই।
আমরা যে হোটেলে উঠেছি ক্রিস্টিনরাও সেখানে উঠেছে। দ্য গাইড লিমিটেডের এ হোটেলটি চালান হাসান মাহমুদ। অসম্ভব প্রাণবন্ত একজন মানুষ। এঁরা তিন ভাই বাংলাদেশের পর্যটন জগতে আধুনিক কনসেপ্ট দাঁড় করিয়েছেন। বড় ভাই হাসান মনসুরও তার পরিবার সুন্দরবন ট্যুর অপারেট দিয়ে শুরু করেছিলেন। এখন ছোট ভাই দেখাশোনা করছেন। মেজভাই ও তাঁর পরিবার অপারেট করছেন বান্দরবান অঞ্চল। খুবই পেশাদারী এবং আন্তরিক আবহে যে কোন পর্যটক এদের সঙ্গে নিরাপদ বোধ করেন। প্রচুর বিদেশী পর্যটক এদের। শিক্ষিত এবং আধুনিক ধ্যান ধারণার এরকম ট্যুর অপারেটর যদি আরও এগিয়ে আসে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প নিঃসন্দেহে আমুল বদলে যাবে। মুরং বম মারমা অনেক ছেলে কাজ করছে হাসান মাহমুদের হিলসাইড রেস্টুরেন্টে। সবাই আনন্দ নিয়ে কাজ করছে। কাজের ভারে নুইয়ে পড়ে না কেউ। এ বিষয়টিই ভীষণ ভাল লাগার। পেশাকে ভালবেসে কাজ করার মানুষ আমাদের দেশে খুব কম। যে জন্য কাজটা শুধু কর্তব্য পালন হয়ে পড়ে, উৎকর্ষ বা সৃজনশীলতার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না।
নীলাচল নীল গিরিতে গিয়ে হঠাৎই কারও মনে হতে পারে, ভারতের কোন পাহাড়ি অঞ্চলে আছি। একই ধরনের নিসর্গ। পর্যটকদের জন্য সাজিয়ে গুছিয়ে উপস্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা আছে। তবু মনে হয় কি যেন অভাব রয়েছে। কোথায় যেন সুরে সুর মিলছে না। খানিক ভাবার পর মনে হয় অভাব ওই পেশাদারিত্বের। কিছুটা রুচিরও। ও পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাদের আরও সময় লাগবে। আমাদের বুর্জোয়া শ্রেণী সবে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের চৌকাঠ মাড়াতে শুরু করেছে। মধ্যবিত্ত আড়মোগা ভেঙে ঘর থেকে বেরনোর অভ্যাস রপ্ত করছে। রাষ্ট্র যন্ত্রের কারিগররাও আসেন মূলত মধ্যবিত্ত। নিম্নমধ্যবিত্ত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। তারাও তাই এখনও পর্যন্ত পর্যটন শিল্পের আধুনিকতা পুরোপুরি ছুঁতে পারেননি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও অতিক্রম করতে পারেননি নিম্ন মধ্যবিত্তও সুলভ সঙ্কীর্ণতা। হয়ত সেজন্যই এক সরকারের সময় বানানো চমৎকার কিছু রেস্টহাউস অন্য সরকারের সময় পোড়োবাড়ির নিদর্শন হয়ে পর্যটকদের কেবল পরিহাসই করে। অথচ সঙ্কীর্ণতা ডিঙিয়ে এগুলোকে এগিয়ে নিলে চূড়ান্ত বিচারে সরকারের লাভ, দেশের লাভ। চিম্বুক পাহাডের চূড়ায় আধুনিক স্থাপত্যের এক রেস্টহাউস অথর্বের মতো পড়ে আছে। অনেকেরই ইচ্ছে হয় পাহাড়ের ওই নির্জনতায় একটি উদাস দুপুর কাটিয়ে সূর্যাস্ত শেষে রাত যাপন করার কিন্তু অবকাঠামো থাকার পরও তা অসম্ভবই থেকে যায়। এটা পশ্চিমবঙ্গে হলে এখান থেকেই কোটি টাকা আয় করত ওরা। নীলাচলেও একই অবস্থা। সরকার এ ধরনের পর্যটন এলাকাগুলো লিজ দিতে পারে। তাতে অবস্থার দ্রুত উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। বেসরকারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় কক্সবাজারের পর্যটন নগরীর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। শুধু মাত্র কক্সবাজারকেন্দ্রিক ট্যুরিজমকে ভাংতে হলে দেশের অন্যান্য পর্যটন এলাকায়ও বেসরকারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে।
সব কিছুর পরও দেশে ঘুড়ে বেড়ানোর মতো অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি বিকশিত। যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে। শহর থেকে বেরিয়ে দু’চারদিন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেভাবেই হোক বিদেশীরা বাংলাদেশের নিসর্গ উপভোগ করতে পারছে ঘুরে ঘুরে। যদিও বৃহত্তম সৈকত কক্সবাজারে পর্যটকদের উপস্থিতি তেমন নেই। এত আলোচিত সৈকত অথচ সেখানে সাদা চামড়ার সানবাথ নেই। সংক্ষিপ্ত পোশাকে ঘোরাঘুরির কথা যে বিদেশী পর্য্টকরা আমাদের এখানে ভাবতে পারেন না। তারও মূল কারণ সম্ভবত ওই রাজনীতি, সঙ্কীর্ণিতা ইত্যাদি।
গত শতকের আশির দশকে জার্মান কথাসাহিত্যিক-কবি কলকাতা ও ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। কলকাতার জনাকীর্ণ, অবক্ষয়ী রূপ দেখে তিনি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ঐ শহরকে বলেছিলেন ‘নরকের বিষ্ঠা’। দেশে ফিরে লিখেছিলেন উপন্যাস ‘জুঙ্গে জাইগান’। যেখানে তার কলকাতা বিরূপতা উঠে এসেছে কয়েক পাতা জুড়ে। কলকাতার পর এসেছিলেন বাংলাদেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন পনেরো বছর। ঢাকা ঘুরে দেশে গিয়ে তিনি কি মন্তব্য করেছিলেন বা লিখেছিলেন জানি না। তবে প্রখর রাজনীতি সচেতন গ্রাস বাংলাদেশের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ক্রিস্টিন ক্রিস্টোফারের সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের তুলনা চলতে পারে কেবল বিদেশী হিসেবেই। গ্রাসের মতো আন্তর্জাতিকমাপের ব্যক্তিত্ব ওরা নয়। তবু ওদের চোখেও বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনা নিয়ে ধরা দিয়েছে। আসলেই তাই। রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ দলাদলির মধ্যে সম্ভাবনা নিয়ে আসছে নবীনতম প্রজন্ম। এরা সত্যিই অন্য রকম প্রজন্ম। এদের ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের সঠিক বিকাশ হয়ত এরাই ঘটাতে পারবে।
No comments