জীবন কথন- রণজি বিশ্বাস
বিজয় দিবসে কী কী করলেন? : ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠেছি। আগেরদিন গভীর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার পরও। সাভারে গেছি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য, নিজের ক্ষুদ্রতা, খর্বতা ও অক্ষমতা আবিষ্কার করার জন্য যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পালকপোষক-সমর্থকদের জন্য ক্রোধের ভাটায় আরও কয়লা ঢালার জন্য, চিন্তাচেতনা থেকে ময়লা তাড়িয়ে শপথকে আরও শাণিত করার জন্য।
: তারপর? আর কী করলেন? নগরে তো অনেক আয়োজন ছিল সারাদিন। : সারাদিন আর কোথাও যাইনি। লেখার উপকরণ কুড়িয়েছি আর লিখেছি। মধ্যরাত পর্যন্ত। : অত রাত পর্যন্ত লিখলেন কেন? : পরের দিনের জন্য তো কিছু কাজ রেখে দিতে পারতেন!: পারতাম না। দুটো কারণে পারতাম না। পরের দিন, তিন দিন পর শ্রমের জায়গায় আমার কাজ করার দিন; দ্বিতীয়, সঙ্গে সঙ্গে কাগজে বেঁধে ফেলতে না পারলে অনেক কথাই আমি হারিয়ে ফেলি। মগজের ওপর অনেক জোর ঢেলেও স্মৃতিছুট কথাগুলোকে আমি আর কাগজে আনতে পারি না। অনেক মিনতির পরও ওরা কথা শোনে না।
: তো, কী করলেন, অতক্ষণ রাত জেগে?
: লেখার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ কবিতা আওড়ালাম। গোটাগোটা-কাটাকাটা। আমার এক অগ্রবর্তী সহকর্মী জানালেন, ‘মৃত্যুর জানাজা আজ করিব না পাঠ/কবরেরও ঘুম ভাঙ্গে জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট’Ñ যে কবিতায় এই দুটো অসামান্য চরণ আছে, সেই কবিতাটি কার?
: কার?
: সাংবাদিক সন্তোষগুপ্তের। আমি জানতাম না। জেনে খুব চমক লাগলো। আবার এটিও ভাবলাম এমন মানুষগুলো এমন কবিতা লিখবেন নাতো লিখবে কি অশিক্ষিত কুশিক্ষিত মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী আর সমর্থক বা চ্যালাসাঙ্গাতরা!
এ রকম আরও একটা কবিতাংশ আমি উদ্ধৃতিপাগল থাকি কিন্তু জানিনা তা কার সৃষ্টি। ‘‘লক্ষ লক্ষ জানের দাম/অনেক দিয়েছি উজাড় গ্রাম/সুদে-আসলে আজকে তাই/যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই।’’ আমি মনে মনে চিৎকার করলাম- ‘অপমানে উঠলো ফুঁসে যেদিন বর্ণমালা/ সেদিন থেকে হলো শুরু দিনবদলের পালা।’
: মনে মনে চিৎকার করুন আর চিৎকারের চোটে গলা ফাটিয়ে ফেলুন সে আপনার ব্যাপার। কিন্তু আপনার সব চিৎকারতো বিজয়দিবসের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়!
: সবই প্রাসঙ্গিক। সবাই যে প্রাসঙ্গিক আমি প্রমাণ করতে পারবো।
: আমাদের উল্লাস আমাদের ক্রোধ, আমাদের বর্জন- সবাই আমাদের বিজয়দিবস, আমাদের স্বাধীনতা ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও তার সঙ্গে যুক্তসম্পৃক্ত। এদিন না এলে লিখতে পারতাম না, শ্রমজীবনে যে পরিচয় পেয়েছি তা পেতে পারতাম না; যে মানের জীবন যাপন করছি তা স্বপ্নসম্ভব ভেবে কুঁড়ের কোণে পড়ে থাকতাম। যারা মুক্তিযুদ্ধের বড়বড় ও তাগড়াতাগড়া বেনিফিশিয়ারি হওয়ার পরও দেশের এগুবার পথে বাগড়া দিচ্ছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যুদ্ধাপরাধী হওয়ার পরও যারা কল্যাণ, মানবতা ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আস্ফালন করছে, তারাও তা করার সুযোগ পেতো না।
; ঠিক আছে, কিন্তু যুদ্ধশেষের প্রাপ্য বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন? এখনও কি যুদ্ধশেষের প্রাপ্য পেতে কিছু আমাদের বাকি আছে?
: আছে। প্রথম প্রাপ্য হচ্ছে, কালপ্রিট ওয়ার ক্রিমিনাল এবং মানবেতর, কীটাণুকীটসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার। এই প্রাপ্যটি পেলেই আমাদের অনেক পাওয়া হয়ে যাবে। এটি আমরা যত দ্রুত পাবো, যত তাড়াতাড়ি যার যা প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে পারবো, দেশ ও জাতির ততই কল্যাণ হবে।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক
No comments