প্রাসঙ্গিক তিন নম্য মুরতি-সমাজ by রণজিৎ বিশ্বাস

নিজেকে নিজে যে সম্মান করে না, সংসারের কেউ তাকে সম্মান করে না। জগতের রীতি। কিন্তু এটি বোঝার লোক বড় বেশি নেই বলেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এমন আকুতি ও আকিঞ্চন। সরল-সহজ কথার মধ্যে এমন অমূল্য ও অমেয় বারতা আমাদের মাতৃভাষায় তার মতো করে আর কেউ শোনায়নি।


যেমন_ নৌকোটা জলে থাকে, নৌকোয় যেন জল না থাকে। যেমন_ যত মত তত পথ। পাপীকে ত্যাজ্য ও বর্জ্য না মেনে পাপকে ঘৃণা করার শিক্ষাও আমরা তার কাছ
থেকেই পাই


ধর্মকে যদি বিশ্বাস বলি, আপন আপন বিশ্বাসের জন্য মানুষ যতবার লড়েছে, যতবার জঙ্গি হয়েছে; ততবার আর কোনো কিছুর জন্য হয়নি।
এটি বিশ্বাসের দোষ নয়, বিশ্বাসের জন্য ও বিশ্বাসের কারণে অন্ধ হওয়ার দোষ। সম্ভবত এটি সেই বোধবুদ্ধি ও বোধির দোষ, যা মানুষের অন্তর্নয়ানে আঁধি টানে। এটি সেই ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যাকারের দোষ, যা মানুষকে তার বিশ্বাসের জন্য দুষ্পাচ্য গরব করতে শেখায়, যা তাকে অন্ধ ও ধৌতমস্তিষ্ক করে ছাড়ে, যা তার কানের কুহরে অনুক্ষণ মন্ত্র ঢেলে বলে, তোর বিশ্বাসটির জায়গা সবার ওপরে দিলেই শুধু হবে না, সংসারে এটিই শুধু থাকবে। তুই তোর বিশ্বাসেরই শুধু লালন ও পরিচর্যা করবি। মানুষের বিশ্বাসের বাগানে আর কোনো ফুলের দল মেলার দরকার নেই।
বিশ্বাসের এ একদেশদর্শিতার ভুবনে গোলকের এ খণ্ডে তিনজন মানুষ এলেন, যারা একেবারেই নতুন কথা শোনালেন। যারা মানুষকে সবার আগে মানুষ মানলেন এবং সব মত ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে জীবন পার করলেন। মহামতি গৌতম বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও স্বামী বিবেকানন্দ। তাদের সারাজীবনই শিক্ষার ও শেখানোর পাঠ ও পঠনের পর্যবেক্ষণ ও অনুসরণের, ভাবন ও বোধনের মনে নেওয়ার ও মেনে নেওয়ার। বুদ্ধ বললেন, সবর্ে্ব সত্তা সুখিতা হন্ত। সংসারেরব প্রাণী সুখী হোক। মনে রাখার ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে, শুধু নিজের প্রচারিত মতের অনুসারীদের কিংবা শুধু মানব-সন্তানের সদগতি তিনি কামনা করছেন না। তিনি জগতের সব প্রাণীর সুখ ও শান্তি কামনা করেছেন।
বিবেকানন্দ যারা 'শিবশিব' করে, তাদের মনে প্রণোদনা জাগিয়ে বললেন, জীবের মধ্যে শিবকে দেখতে হবে। লক্ষ্য করানোর বিষয়, সব মানুষের মধ্যে নয়, সব জীবের মধ্যে। শিবজ্ঞানে জীব সেবার আহ্বান জানিয়ে সর্বধার্য ও সর্ববোধ্য ভাষায় বললেন_ 'বহুরূপে ছাড়ি সম্মুখে, কোথা তুমি খুঁজিছ ঈশ্বর! জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।' বললেন, সব উপাসনার সার হচ্ছে শুদ্ধচিত্ত হওয়া ও অন্যের কল্যাণ সাধন করা। প্রতিমার মধ্যে যিনি ঈশ্বর সন্ধান করেন, তার স্থান প্রার্থনার একেবারে প্রারম্ভস্তরে। জীব প্রেমের মধ্যে আনন্দ ও সত্য সন্ধানের মধুপর্ক সন্ধান করে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করে সবাইকে সাহসী করে তোলেন ও তাদের অস্থিমজ্জা থেকে সংশয়ের দ্বন্দ্ব নামিয়ে আনেন 'সত্যের জন্য আমি সকল কিছুই ছাড়তে পারি, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ছাড়তে পারি না।'
এ দু'জন মহামানবের মাঝখানে যার ঠাঁই, তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। জগৎসংসারে যত স্বশিক্ষিত মানুষ শিক্ষার সুবাস চারদিকে ছড়িয়েছেন, তিনি তাদের প্রারম্ভপঙ্ক্তির মানুষ। তার জীবন সুশিক্ষিত মানুষের জীবনের প্রমাণক ও অসামান্য এক প্রতিরূপ।
এই মানুষটি আমাদের শুভবোধের সরণিতে পথ পার করার প্রতিটি দিনে শুধু প্রাসঙ্গিকই হবেন না, তার বৈশিষ্ট্যেই তিনি হতে পারেন প্রতিদিনের জন্য 'সাবজেক্ট অব দ্য ডে', এমনকি 'সাবজেক্ট অব দ্য আওয়ার'। ভেবে দেখতে মন অনুক্ষণই চেয়ে বসে_ এ মানুষটি কেন মানুষের মনের জমিনে এমন গভীরভাবে শিকড় গাড়েন।
কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ, তিনি কথা বলেন একেবারেই সাধারণ মানুষের জবানে। তার ভাষা মাটির মানুষের ভাষা একেবারেই কাছাকাছি। তিনি বলেন, মানুষ সবাই নয়, যার মান ও হুঁশ আছে, সে-ই মানুষ। মানুষ হতে হলে আত্মসম্মানবোধ থাকতে হবে ও তার দিগ্গি্বদিক জ্ঞান এবং চেতনা থাকতে হবে। দিগ্গি্বদিক জ্ঞান হচ্ছে, ভালো-মন্দের জ্ঞান; কোথায় থামব_ এ মাত্রাবোধের জ্ঞান। আত্মসম্মান হচ্ছে_ নিজের অবস্থান ও কাজের প্রতি সম্মানবোধ। নিজেকে নিজে যে সম্মান করে না, সংসারের কেউ তাকে সম্মান করে না। জগতের রীতি। কিন্তু এটি বোঝার লোক বড় বেশি নেই বলেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এমন আকুতি ও আকিঞ্চন।
সরল-সহজ কথার মধ্যে এমন অমূল্য ও অমেয় বারতা আমাদের মাতৃভাষায় তার মতো করে আর কেউ শোনায়নি। যেমন_ নৌকোটা জলে থাকে, নৌকোয় যেন জল না থাকে। যেমন_ যত মত তত পথ। পাপীকে ত্যাজ্য ও বর্জ্য না মেনে পাপকে ঘৃণা করার শিক্ষাও আমরা তার কাছ থেকেই পাই।
যার ভাবনা তার, এই ক্ষুদ্র ও খর্বজনার ভাবনা হচ্ছে, পরমহংসদেবের জীবনে বড় সাফল্য নরেণকে (বিবেকানন্দ) আবিষ্কার। বয়ঃক্রমে প্রায় ২৮ বছরের অনুবর্তী এ অসামান্য ও কৃতবিদ্য ক্ষণজন্মারও জীবনের সর্বসেরা ঘটনা এ অলোকসামান্য মানুষের নিবিড়তম সানি্নধ্য। এই সানি্নধ্য ও জোড়যুগল আমাদের এক আনন্দদ্বন্দ্বে ভাসায়-ডোবায়, এই ভাবনায় যে কেমন মোহন এমন সুবর্ণ মণিবন্ধে সুবর্ণ কঙ্কণ। মুগ্ধজনের হৃদিমধ্যে ছবি যখন এমন বসে, বোঝা যায় না কে কার আভরণ।

রণজিৎ বিশ্বাস : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.