চরাচর-গারো : একটি ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায় by আলম শাইন
আমাদের দেশের আদিবাসীদের মধ্যে গারো সম্প্রদায় বেশ একটি ঐতিহ্যবাহী সম্প্রদায়। প্রায় সোয়া লাখ গারো বাস করেন এ দেশে। অন্যদিকে ভারতে বাস করেন প্রায় ১১ লাখ ৭৫ হাজার। দুই দেশ মিলিয়ে মোট ১৩ লাখ গারোর বাস মূলত পাহাড়ভিত্তিক অথবা জঙ্গলবেষ্টিত স্থানে তাঁরা বাসস্থান গড়েন।
শুধু গারোরাই নন, এ দেশের যেকোনো আদিবাসীরাই লোকালয়ের দূর সীমায় বাস করছেন। অগোচরে বাসের প্রধান কারণ হচ্ছে তাঁরা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে প্রাকৃতিক উপায়ে জীবন ধারণ করার সুযোগ তৈরি করে নেন। আমরা জানি, যেকোনো আদিবাসীরাই সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ। তাঁরা নিজস্ব ধারার সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর থাকেন সদাসর্বদাই। যত দূর জানা যায়, আদিবাসীদের সংস্কৃতির আয়োজন সাধারণত ফসল সংগ্রহভিত্তিক হয়ে থাকে। অন্যান্য আদিবাসীর মতো গারোদের সংস্কৃতির আয়োজন হয় মূলত জুম চাষভিত্তিক। বেশ বর্ণাঢ্য আয়োজন হতো একসময়। এখন জুম চাষ খুব একটা নেই আর গারোদের সেই বর্ণাঢ্য আয়োজনও তেমনটি নেই। তার ওপর সহস্র বছর আগের গারো সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ক্রমান্বয়ে খাটো করে দিচ্ছেন খ্রিস্টান মিশনারিরা। আদিবাসীদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সাহায্য-সহযোগিতার নামে ধোঁকা দিয়ে তাঁদের খ্রিস্টধর্মে আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ ধরনের অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন মূলত তাঁরা ১৮৬৩ সাল থেকেই। এ সময় 'মি. ব্রনসন' নামে এক শ্বেতাঙ্গ ব্যাপটিস্ট মিশনারি আসামের গুয়াহাটির অদূরে সুখেরশ্বরঘাট নামক স্থানে প্রথম দুই গারো যুবককে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। তারপর থেকে ক্রমান্বয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়ে দুর্যোগ নেমে আসে। পাহাড়ি দুর্গম এলাকায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য মিশনারিরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ ও কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাজ করছেন। তন্মধ্যে প্রধান কৌশলটি হচ্ছে গারোদের আদি উৎসবের হেরফের করে দেওয়া। যেমন- গারোদের একটি উৎসবের নাম 'ওয়ানগালা'। উৎসবটার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার সুযোগ পেতেন। এরই মধ্য দিয়ে প্রকৃতির রোষানল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। প্রার্থনা করেন ভালো ফসল উৎপাদন, রোগব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, সন্তানের কল্যাণ, দাম্পত্য জীবনের কলহ থেকে নিষ্কৃতি পেতে। এ সবই করেন তাঁরা গীতনৃত্যের মাধ্যমে। সাধারণত তিনটি ধাপে ওয়ানগালা উৎসব পালন করেন। উৎসবগুলো যথাক্রমে- ১. রুগালা, ২. জল আননা, ৩. বিসিরি ওয়াত্তা। রুগালা অনুষ্ঠান পালন করা হয় কার্তিকের ১৫ তারিখের দিকে ধান কাটার পর। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথম ধান ঘরে তোলা হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে জল আননা, এটির মাধ্যমে দেবতার মনোতুষ্টির জন্য ধূপ জ্বালানো হয়। তৃতীয় পর্ব বিসিরি ওয়াত্তা। এটি ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গারোদের 'মিসি সালজং' দেবতাকে বিদায় জানানো হয় এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অথচ মিশনারিদের কবলে পড়ে এসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তাঁরা দরিদ্র গারো সম্প্রদায়কে নামমাত্র সহায়তা দিয়ে ওয়ানগালা উৎসবটি খ্রিস্টধর্মের আঙ্গিকে পালনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। বলা যায় বিষয়টি ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। বলে রাখা ভালো যেকোনো ধর্মের ওপর এ ধরনের খৰ উঁচিয়ে ধরা অবশ্যই নিন্দনীয় কাজ, অন্যায়ও বটে। এ অন্যায় থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে এবং ১২ জাতির সংমিশ্রণ না থাকলে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য একসময় বিলীন হয়ে যাবে। আশা করি বিষয়টি ভেবে দেখবেন সুধীজনরা।
আলম শাইন
আলম শাইন
No comments