ইতি-নেতি-এই সামাজিক অস্থিরতার দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে by মাসুদা ভাট্টি
চারদিকে তাকালে মনে হয়, এক ভয়ানক অস্থির সময়ের ভেতর আমরা বাস করছি। যে ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশে রাজনীতি চলছে, চলছে নানা রকম অমানবিক কর্মকাণ্ড, সে ধর্মও যেন থামিয়ে রাখতে পারছে না এই অস্থিরতাকে। নইলে রোজার মাসেও কেমন করে মানুষ নামছে লোভের পসরা নিয়ে, কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রকল্প নিয়ে? এর অর্থ হচ্ছে, ধর্মটর্ম আসলে কিছু নয়, মানুষের ব্যক্তিস্বার্থ আর লোভের কাছে পরাজিত আজ মানবিকতা, প্রেম এবং বিবেকবোধ।
রাজধানী ঢাকার কাছেই ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলল গ্রামবাসী। সন্দেহের বশে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা এ দেশে এই প্রথম নয়। এর আগেও হয়েছে। কিন্তু তার বিচার হয়নি বলেই এ ঘটনাও নানা খাতে প্রবাহিত হলো এবং তারপর শেষ হয়ে গেল। যেহেতু সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নিল নোয়াখালীতে আবার একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা, সেহেতু আমিনবাজারের ঘটনা চাপা পড়ে গেল। সর্বশেষ নোয়াখালীতেই এক তরুণকে পুলিশের ভাড়াটে মারকুটেরা দিনদুপুরে পিটিয়ে মেরে ফেলল এবং গণমাধ্যম দেখাল তার ভিডিওচিত্র। সমাজ কতটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলে কাউকে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয় এবং তা আবার প্রচার হয় জাতীয়ভাবে। টেলিভিশনের পর্দায় যখন এই দৃশ্য দেখানো হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল, আফ্রিকার সেরেঙ্গেটি জাতীয় উদ্যানে একদল হায়েনা একটি হরিণশাবককে আক্রমণ করছে আর ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একদল নামকরা ডকুমেন্টারি মেকার তার ভিডিও ধারণ করছেন, ধারা বিবরণী দিচ্ছেন। নিরীহ হরিণশাবককে তারা বাঁচাবেন না, কারণ তাতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। বুনো জগতে এটাই নিয়ম, যে শক্তিশালী সেই-ই বেঁচে থাকবে, যার বাঁচার ক্ষমতা নেই, তার অধিকারও নেই। হরিণশাবককে খাবে হায়েনা, হায়েনাকে খাবে চিতা, তারপর চিতা আর সিংহের মধ্যে লড়াইতে যে টিকে থাকতে পারবে, তারই রাজত্ব। একেই তবে বলে মাৎস্যন্যায়।
প্রশ্ন হলো, পুলিশের কাজ কী? পুলিশ যাদের দিয়ে এ কাজ করিয়েছে তাদের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও রয়েছেন, জনপ্রতিনিধির কাজ কী? এবং সর্বশেষ যাঁরা এর ভিডিও ধারণ করেছেন, তাঁরা এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও চুপ করে থেকেছেন, তার মানে সামাজিক অস্থিরতার স্তরটা আসলে কোন পর্যায়ে নেমে গেছে? স্বাভাবিক নিয়মে বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের ঘটনার খবর যখন রাজধানীতে এসেছে তখন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, পুলিশপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা নড়েচড়ে বসেছেন। আরো স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা টিভি ক্যামেরার সামনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তদন্তের। বিচার হবে কি, হবে না সে পরে দেখা যাবে। যদিও নোয়াখালীর এই ঘটনায় কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এতে কি দায় এড়ানো যাবে? বা কেবল এটুকুতেই কি সমাজ বাস্তবতা বদলাবে? মনে হয় না।
আমরা যদি আমিনবাজারের ঘটনার কথা স্মরণ করি, তাহলে সেখানকার ঘটনায় প্রশাসনকে দেখা গেল সরাসরি গ্রামবাসীর পক্ষ নিতে। গণমাধ্যমকে দেখা গেল সংশ্লিষ্ট গ্রামকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের উত্তেজনাপূর্ণ খবর প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি কিংবা আইনের আওতায় এনে এর সুষ্ঠু কোনো তদন্ত এখনো হয়েছে বলে জানা যায় না। রাজধানীর জনজীবনে অতিষ্ঠ একদল তরুণ যদি খানিকটা উন্মুক্ত বাতাসের খোঁজে আমিনবাজারের বালু দিয়ে ভরাট করা বিস্তীর্ণ এলাকায় গিয়ে দাঁড়ায় (তারা মাদকাসক্ত কিংবা ডাকাত কি না সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায়িত্ব প্রশাসনের) তাহলে ডাকাতের ভয়ে ভীত গ্রামবাসী তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলবে এবং প্রশাসন তাদের পাশে দাঁড়াবে_এ রকম নৃশংস ঘটনার দায়ভার আসলে যুগপৎ সমাজ ও রাষ্ট্রেরই। কারণ যে গ্রামে পর পর ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে, রাষ্ট্র সে গ্রামের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে সামাজিক অসহিষ্ণুতা এতটাই তীব্র আকার নিয়েছে যে একদল মানুষ একাট্টা হয়ে দা-বল্লম নিয়ে ছয় তরুণকে নির্মমভাবে মেরে ফেলছে, আইনের প্রতি এই হত্যাকারীদের অশ্রদ্ধা এতটাই তীব্র যে তারা আর পুলিশের জন্য কিংবা তাদের ধরে-বেঁধে আইনের হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারছে না। সমাজ এখানে অস্থির হয়ে উঠেছে তীব্রভাবে এবং রাষ্ট্র এই অস্থিরতা দমনে বারবারই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এখানে ব্যাঙাচির জীবনচক্রের মতো রাষ্ট্র ও সমাজও একটি চক্রবূ্যহের মধ্যে ঘুরছে, কারণ যারা রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রশাসন পরিচালনা করছে তারাও এই সমাজেরই ফসল। সুতরাং অস্থির সমাজের অস্থিরতার ফসল যখন রাষ্ট্রযন্ত্র চালানোর দায়িত্ব পাচ্ছে, তখন তারা গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও করে তুলছে অস্থির। যেন এই অস্থিরতা থেকে আমাদের কারোরই কোনো মুক্তি নেই।
আমি জানি না, আমাদের কোনো সমাজবিজ্ঞানী গবেষক বন্ধু বাংলাদেশের এই সামাজিক অস্থিরতা বিষয়ে কাজ করছেন কি না। যদি করেন, তাহলে তিনি একটি বিষয় নিশ্চিতভাবেই স্বীকার করবেন যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস, বিশেষ করে রাজনৈতিক ইতিহাসের যে রক্তাক্ত ধারা, তা আসলে আমাদের সমাজজীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। পঁচাত্তর, আশি এবং তারপর বহু ঘটনার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফেরা গেলেও ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা কিন্তু আবারও আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে রক্তাক্ত রাজনীতির ধারায়। জেনারেল জিয়াউর রহমান যে '৭৫-এর রক্তকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা আজ প্রমাণিত ইতিহাস। আবার ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায়ও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, ক্ষমতাসীন তাঁর স্ত্রী এবং তাঁর সন্তানদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ মিলছে। এর অর্থ হচ্ছে রাজনৈতিক রক্তপাতের ধারাবাহিকতা থেকে আমাদের রাজনীতি বেরিয়ে আসতে পারছে না। রাষ্ট্রের উঁচুস্তরে যখন এ রকম রক্তপাতের ঘটনা ঘটছে তখন তার স্রোতধারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিবেশ থেকে সমাজের নিম্নস্তর-বৃত্তে প্রবেশের পথকে রুখব আমরা কোন শক্তি দিয়ে? অনেকে হয়তো ধর্মের কথা বলতে পারেন যে ধর্মের অনুশাসন দিয়ে একে রোখা সম্ভব, আমি এ নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি যে ধর্ম এখানে প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, কিন্তু খালি চোখে দেশের সমাজব্যবস্থার ভেতরকার এই অগি্নগর্ভ অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, লোভ, হিংসা আর হানাহানি দেখে খুবই ভীত বোধ করি। রাস্তায় বেরোলে আমার মতো অনেকেই প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করেন একে অন্যের গায়ে খুব সহজেই হাত তুলছেন। রিকশা ভাড়া নিয়ে, রাস্তা পারাপারের সময় কিংবা অন্য যেকোনো ছুতোয় একজন বা একদল মানুষ আরেক দলের সঙ্গে বিবাদকে হাতাহাতি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আসলেই ভয়ের এবং মানুষের সৃজনশীলতা, পেলবতা আর ভালোবাসার ক্ষমতাকে ক্রমেই অসাড় করে দিচ্ছে। আমার ধারণা, সমাজ ও রাষ্ট্রের বা রাজনীতির এই ব্যর্থতা অতিদ্রুত আক্রমণ করছে ব্যক্তি ও সামষ্টিকভাবে মানুষকে। এই ধ্বংসাশী প্রবণতা বন্ধ হওয়া দরকার এবং উচিত। কিন্তু মানুষ নিজে আগে ঠিক হবে, নাকি সমাজ নিজেকে আগে বদলাবে? কিংবা রাষ্ট্রই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজকে বদলাবে? এ রকম তাত্তি্বক প্রশ্ন তোলার সময় ও সুযোগও বুঝি আর নেই।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
No comments