দাহকালের কথা-লীলা by মাহমুদুজ্জামান বাবু
জয়পুরহাটে জন্ম নেওয়া লেখক বন্ধুকে টেলিফোনে প্রশ্ন করেছিলাম, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলা ছুঁয়ে কোন নদী বয়ে যায়? উত্তর এসেছিল, ‘ওখানে কোনো নদী নেই।’ বিস্ময় আমাকে চিৎকৃত করেছিল, এটা কখনো হয়? বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জনপদ আর সেখানে কোনো নদী নেই?
নদী না থাকলে টাকার বিনিময়ে অনাত্মীয় অচেনা মানুষের কাছে অঙ্গ বিক্রি শাস্তিযোগ্য অপরাধ—তথ্যটি না জেনে ২০০-এর বেশি অভাবী মানুষ কিডনি বিক্রি করে যে কাঁদল, সেই কান্নার জল কালাই উপজেলার ১৮ গ্রামেই পড়ে থাকল? নদী থাকলে চোখের জল নদীতে পড়ত, তারপর এ শহর ওই নগর সেই বন্দর বেয়ে বেয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে যেতে যেতে জানিয়ে দিতে পারত চারপাশকে যে সঙ্গে অনেকগুলো টাকা পাওয়ার প্রলোভন আর এনজিওদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের চাপ থেকে মুক্তি পেতেই তাঁরা এই কাজ করেছিলেন। জানা যেত রাষ্ট্রের উদাসীনতা ও সচেতন উপেক্ষা কী সীমাহীন দারিদ্র্য আর অসহায়ত্বের অগ্নিকুণ্ডে এসব মানুষকে ঠেসে ধরে অহর্নিশ, নিরুপায় হয়ে তারা হাত পাতে এনজিওগুলোর কাছে। এক এনজিওর ঋণ শোধ করার জন্য অন্য এনজিও থেকে নতুন ঋণ নেওয়া, এভাবে একটি চক্রের হাতে সঁপে দেওয়া জীবন। শোধ করতে না পারা টাকার সুদ বাড়লে ঘরের টিনের চাল খুলে নাও, এমনকি বউ বন্ধক দিয়ে যাও (দৈনিক ইত্তেফাক, ৮ সেপ্টেম্বর)। এই যখন বাস্তবতা তখন কিডনি ও যকৃৎ শরীরে নিশ্চয়ই বাড়তি ভার; অন্তত ঘরের চাল ও বউয়ের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ!
এত গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে সমাজপতি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী কিংবা সংসদ সদস্য কারোরই মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়, তাই হয়নি। জাতীয় সংসদে কত কত বিষয় আলোচনা হয়, টেবিল চাপড়ানো হয়, ওয়াকআউটও হয়। কিন্তু ভালো কথা, দেশের মঙ্গলের কথা, মানুষের অসহায়ত্ব ও জীবনযুদ্ধের কথা আলোচনা হয় কি? জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘সংসদে সবাই কথা বলেন। ভালো-মন্দ মিলিয়েই বলেন। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় কেউ কেউ বলেন। তবে বেশির ভাগই খারাপ কথা বলেন। সেই জন্য মাঝে মাঝেই আমাকে মাইক বন্ধ করে দিতে হয়’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২২ সেপ্টেম্বর)। সংসদে স্পিকার যখন অকপটে এই স্বীকারোক্তি দেন, তখন বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের নকশায় নির্মিত নয়নাভিরাম জাতীয় সংসদ কেবলি কংক্রিটের পাষাণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না?
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার অধীনে বিএনপি নির্বাচন করবে এবং এর অন্যথা এলে নির্বাচন করবে না—চার দলের জনসভায় খালেদা জিয়া ইতিমধ্যেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেলেছেন। তার মানে কী দাঁড়াল? বর্তমান মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর হতে এখনো দুই বছরের বেশি বাকি। মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিলুপ্তি যেদিন ঘটিয়েছে, সেদিনই তো চারদলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার নয়াপল্টনের সমাবেশের হুঁশিয়ারির খসড়া ঘোষণা লেখা এবং কয়েক দিন আগে পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার নকশা প্রণীত হয়েছিল। এখন আমরা কেবল এসব রাজনৈতিক তামাশা এবং ক্রমান্বয়ে তার হিংস্র রূপ দেখতে থাকব। এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে জনজীবনের প্রাত্যহিক দুর্ভোগের দীর্ঘশ্বাস, সিএনজি, অকটেনের চড়া দাম ও গণপরিবহনের বাড়তি ভাড়ার চাপ, তা থেকে উদ্ভূত ঊর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার-সমর্থকদের নৈরাজ্য, শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন আর প্রতিদিন মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার কান্না।
কান্নাই তো সম্বল এখন। সারা দেশের সড়কব্যবস্থা নিয়ে একটা নাগরিক আন্দোলন সচকিত হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিশেষ করে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের স্কুলছাত্রদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশের বিবেকবান মানুষ সড়কপথের যাবতীয় অব্যবস্থা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে ঈদের দিন ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতার একটি মোর্চা প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেছিল। এই আয়োজন ও আয়োজকদের প্রতি গণমাধ্যমের সামনে প্রধানমন্ত্রী শুধু বিদ্রূপবাণই ছুড়লেন না, মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে বসে গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিলেন আহ্বায়কদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা ও নজরদারির জন্য (দি ডেইলি স্টার, ৯ সেপ্টেম্বর ১১)। আয়োজকেরা কি রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ ছিলেন? তাঁরা দেশবিরোধী কাজে নেমেছিলেন? তাহলে নাগরিকের দায়বোধ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন এখন এখানে অপরাধ?
কান্না যে নদীর জলের সঙ্গে মিশবে, তারও তো উপায় নেই! নৌপথ হারিয়ে যেতে বসেছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। সেটা কমতে কমতে এখন ছয় হাজার কিলোমিটার হয়েছে। গ্রীষ্মে আরও কমে হয় তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটার (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে নৌ চলাচল, নাব্যতা রক্ষা আর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলাফল এটা। আশ্চর্য হচ্ছেন?
গৌতম ঘোষের লালন সাঁইকে নিয়ে চলচ্চিত্র মনের মানুষ-এর একটি সংলাপ মনে পড়ছে। মরতে চাওয়া এক নারীকে লালন শিষ্যা বলছেন, ‘মলা? কত কষ্টে মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায়। বেঁচে থাক, দেখবি কত লীলা!’
লীলাময়দের রাজ্যে আমরা কেবলি লীলা দেখার দর্শক। তাই না?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
এত গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে সমাজপতি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী কিংবা সংসদ সদস্য কারোরই মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়, তাই হয়নি। জাতীয় সংসদে কত কত বিষয় আলোচনা হয়, টেবিল চাপড়ানো হয়, ওয়াকআউটও হয়। কিন্তু ভালো কথা, দেশের মঙ্গলের কথা, মানুষের অসহায়ত্ব ও জীবনযুদ্ধের কথা আলোচনা হয় কি? জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘সংসদে সবাই কথা বলেন। ভালো-মন্দ মিলিয়েই বলেন। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় কেউ কেউ বলেন। তবে বেশির ভাগই খারাপ কথা বলেন। সেই জন্য মাঝে মাঝেই আমাকে মাইক বন্ধ করে দিতে হয়’ (দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২২ সেপ্টেম্বর)। সংসদে স্পিকার যখন অকপটে এই স্বীকারোক্তি দেন, তখন বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই কানের নকশায় নির্মিত নয়নাভিরাম জাতীয় সংসদ কেবলি কংক্রিটের পাষাণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না?
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থার অধীনে বিএনপি নির্বাচন করবে এবং এর অন্যথা এলে নির্বাচন করবে না—চার দলের জনসভায় খালেদা জিয়া ইতিমধ্যেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেলেছেন। তার মানে কী দাঁড়াল? বর্তমান মহাজোট সরকারের পাঁচ বছর হতে এখনো দুই বছরের বেশি বাকি। মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিলুপ্তি যেদিন ঘটিয়েছে, সেদিনই তো চারদলীয় জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার নয়াপল্টনের সমাবেশের হুঁশিয়ারির খসড়া ঘোষণা লেখা এবং কয়েক দিন আগে পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের হামলার নকশা প্রণীত হয়েছিল। এখন আমরা কেবল এসব রাজনৈতিক তামাশা এবং ক্রমান্বয়ে তার হিংস্র রূপ দেখতে থাকব। এসবের আড়ালে চাপা পড়ে যাবে জনজীবনের প্রাত্যহিক দুর্ভোগের দীর্ঘশ্বাস, সিএনজি, অকটেনের চড়া দাম ও গণপরিবহনের বাড়তি ভাড়ার চাপ, তা থেকে উদ্ভূত ঊর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্য, শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার-সমর্থকদের নৈরাজ্য, শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়ন আর প্রতিদিন মানুষের দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে দেয়ালের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার কান্না।
কান্নাই তো সম্বল এখন। সারা দেশের সড়কব্যবস্থা নিয়ে একটা নাগরিক আন্দোলন সচকিত হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিশেষ করে, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের স্কুলছাত্রদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশের বিবেকবান মানুষ সড়কপথের যাবতীয় অব্যবস্থা নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে ঈদের দিন ছাত্র-শিক্ষক-পেশাজীবী জনতার একটি মোর্চা প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেছিল। এই আয়োজন ও আয়োজকদের প্রতি গণমাধ্যমের সামনে প্রধানমন্ত্রী শুধু বিদ্রূপবাণই ছুড়লেন না, মন্ত্রিপরিষদের মিটিংয়ে বসে গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিলেন আহ্বায়কদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা ও নজরদারির জন্য (দি ডেইলি স্টার, ৯ সেপ্টেম্বর ১১)। আয়োজকেরা কি রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ ছিলেন? তাঁরা দেশবিরোধী কাজে নেমেছিলেন? তাহলে নাগরিকের দায়বোধ নিয়ে সামাজিক আন্দোলন এখন এখানে অপরাধ?
কান্না যে নদীর জলের সঙ্গে মিশবে, তারও তো উপায় নেই! নৌপথ হারিয়ে যেতে বসেছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আমাদের ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। সেটা কমতে কমতে এখন ছয় হাজার কিলোমিটার হয়েছে। গ্রীষ্মে আরও কমে হয় তিন হাজার ৮০০ কিলোমিটার (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর)। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে নৌ চলাচল, নাব্যতা রক্ষা আর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলাফল এটা। আশ্চর্য হচ্ছেন?
গৌতম ঘোষের লালন সাঁইকে নিয়ে চলচ্চিত্র মনের মানুষ-এর একটি সংলাপ মনে পড়ছে। মরতে চাওয়া এক নারীকে লালন শিষ্যা বলছেন, ‘মলা? কত কষ্টে মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায়। বেঁচে থাক, দেখবি কত লীলা!’
লীলাময়দের রাজ্যে আমরা কেবলি লীলা দেখার দর্শক। তাই না?
মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
No comments