শেকড়ের ডাক-সুশাসন তো নেই-ই, তার ওপর এসব কী হচ্ছে? by ফরহাদ মাহমুদ
কথায় বলে, 'চোরায় না শোনে ধর্মের কাহিনী।' চোরা তথা অপরাধীরা ধর্মের কথা তো শোনেই না, সমাজের কোনো হিতোপদেশও শোনে না। এদের একমাত্র কাজ অন্যের অনিষ্ট করে নিজের সম্পদ বাড়ানো। এসব চোর, বদমাশ, খুনি, ডাকাত, দুষ্কৃতকারী তথা অসামাজিক চরিত্রগুলোর কবল থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। রাষ্ট্র সে জন্য
আইন প্রণয়ন করে। আইন বাস্তবায়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী গঠন ও পালন করে। দেশের বিচারব্যবস্থা অপরাধকারীদের শাস্তি প্রদান করে। এভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, জনগণ শান্তিতে থাকে। এর অন্যথা হলে জনগণের অশান্তি যেমন বাড়ে, সমাজ তথা রাষ্ট্রও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের অবস্থাটাও তেমনি। জনগণের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থাগুলো অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় এবং সঠিক পথে পরিচালিত না হওয়ায় দিন দিনই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। বিবেক-বুদ্ধিকে ক্ষতবিক্ষত করে অনেক ঘটনাই নীরবে আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।
কোনো সমাজে অপরাধীরা তাদের অপরাধের শাস্তি না পেলে সে সমাজে প্রকারান্তরে অপরাধকে উৎসাহী করা হয় এবং একটা সময় অপরাধ লাগামহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অবস্থা আজ অনেকটা সে পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। এখানে দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, দীর্ঘদিন থেকে তাঁরা অপরাধ দমনের পরিবর্তে অপরাধকে উৎসাহী করে যাচ্ছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, অপরাধীরা তাদের অনুসারী হলে শাস্তির বাইরে থেকে যায়। আর ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার অজুহাতে নিজ দলের অনুসারীদের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খুনের মামলাও 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা হয়ে যায়, আর কারাগার থেকে খুনিরা সদর্পে বেরিয়ে যায়। তার সঙ্গে বিগত জোট সরকারের আমল থেকে শুরু হয়েছে, আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিদেরও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়া। এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের সংবিধানই রাষ্ট্রপতিকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার এমন ব্যবহার কি করা উচিত, যা দেশবাসীকে আহত করে? বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রপতি কিন্তু নিজে নিজে সেই সিদ্ধান্ত নেন না, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়, তাতে স্বাক্ষর করা রাষ্ট্রপতির প্রায় বাধ্যতামূলক একটি কাজ। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়টি যে দেশবাসীকে আহত করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত পাঠকের মতামত থেকে। অনেকে এমন অনেক প্রশ্ন করেছেন, যার জবাব দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব। এ ছাড়া আছে থানাগুলোর ওপর এমপি বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীদের অপরিমিত প্রভাব। ফলে দলীয় ক্যাডারদের অন্যায়ের ব্যাপারে থানা নীরব থাকে, সাধারণ মানুষ অপরিসীম দুর্ভোগের শিকার হয়।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইন বলবৎ করার জন্য পুলিশ বা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, অপরাধীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষা এবং তারা যাতে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। দেশের বিচারব্যবস্থা এই বাহিনীগুলোর সহায়তায় অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করবে_এটাই সভ্যতার নিয়ম। এর মাধ্যমেই একটি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? ঠিক যেন তার উল্টো পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ! সুশাসন, আইনের শাসন কেবলই সুদূরপরাহত হচ্ছে। যে পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করছে। আইন শুধু ভঙ্গই করছে না, আইনকে রীতিমতো গুলিয়ে গিলে খাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০১১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত 'ডাকাত সন্দেহে' ৯৫ নিরপরাধ ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। কারণ আদালতে কারো অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আইনের দৃষ্টিতে নিরপরাধ। আর কোনো ব্যক্তি যদি ডাকাতির সঙ্গে জড়িতও থাকে, তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। অভিযোগ আছে, গণপিটুনির এসব ঘটনার অধিকাংশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুলিশ জড়িত। বিভাগীয় তদন্তে, এমনকি আদালতেও পুলিশের এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ওসিসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো আছেই। এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে অর্থের বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া, মাসোহারার বিনিময়ে অপরাধীদের নির্বিঘ্নে অপরাধ করতে দেওয়া, নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করে অর্থ আদায়সহ বহু অবৈধ কাজ।
বিগত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার নামে ৭০ হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের আমলে এ দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভায় গ্রেনেড ও বোমা হামলার কারণে বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রীসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েক শ ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন। অথচ তখন জজ মিয়া প্রহসনের মাধ্যমে কিভাবে তদন্তকে বিপথে পরিচালিত করা হয়েছিল, তা কারো অজানা নয়। যে দুর্ধর্ষ জঙ্গি বাংলাভাইয়ের পরে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তিনি আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তিনি মুক্তি পেয়ে গেছেন। বরং যেসব পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, তাঁরাই তিরস্কৃত হয়েছিলেন। দশ ট্রাক অস্ত্র ধরার অপরাধে পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছিলেন। এভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন সন্ত্রাসকে উৎসাহী করা হয়েছিল। এ সরকার জঙ্গিবাদ দমনে কিছুটা সফল হলেও সাধারণ অপরাধীদের ব্যাপারে একই পন্থা অনুসরণ করে চলেছে। ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর পরও 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার অজুহাতে মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এগুলো কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এসবের ফলাফল কী হচ্ছে? আজ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই বলা হচ্ছে, এটি 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা। বিরোধীদলীয় নেত্রীর সন্তানের বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলা বিদেশের আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী বা তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে সরকার নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক মামলা করতে গেলেও বিরোধী দল থেকে একে 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা' আখ্যায়িত করে হরতাল, বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগি্নসংযোগের মতো কর্মসূচি দিচ্ছেন। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে দলভুক্ত আইনজীবীরা চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। বিচারককে গালাগাল করা, প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা, গাড়ি ভাঙচুর, মারামারি_আজ পর্যন্ত কী হয়নি সর্বোচ্চ আদালতে। সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী, যাঁদের আইন ভালো করেই জানা আছে, তাঁরা এমন বেআইনি কাজ করেন কিভাবে? এঁদের কি আইনজীবীর পরিচয় ধরে রাখার কোনো নৈতিক অধিকার আছে?
সুশাসনের স্বার্থে, আইনের শাসনের স্বার্থে এভাবে উল্টো পথে হাঁটা অবিলম্বে আমাদের বন্ধ করা উচিত। আদালতে যেসব মামলা হয়, তার কোনটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক আর কোনটি প্রকৃত অপরাধমূলক_আদালতই তা নির্ধারণ করবে। হয়রানিমূলক মামলাগুলো আদালত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানিমূলক মামলা করার জন্য মামলার বাদীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গণহারে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা মনে করি, মহাজোট সরকার যে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকৃত অর্থেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার প্রমাণ তারা এখনো রাখতে পারে। আর সে জন্য এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে যত মামলা তারা প্রত্যাহার করেছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত করে আদালতের হাতে নিষ্পত্তি করার ভার অর্পণ করতে পারে। একইভাবে বিগত জোট সরকারের আমলে যেসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল সেগুলোও পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।
আমরা সমাজে শান্তি চাই এবং বিশ্বাস করি, অপরাধে উৎসাহ জুগিয়ে কোনো অবস্থাতেই সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায় না। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক : সাংবাদিক
কোনো সমাজে অপরাধীরা তাদের অপরাধের শাস্তি না পেলে সে সমাজে প্রকারান্তরে অপরাধকে উৎসাহী করা হয় এবং একটা সময় অপরাধ লাগামহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অবস্থা আজ অনেকটা সে পর্যায়ে পেঁৗছে গেছে। এখানে দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাঁরা থাকেন, দীর্ঘদিন থেকে তাঁরা অপরাধ দমনের পরিবর্তে অপরাধকে উৎসাহী করে যাচ্ছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, অপরাধীরা তাদের অনুসারী হলে শাস্তির বাইরে থেকে যায়। আর ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার অজুহাতে নিজ দলের অনুসারীদের হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খুনের মামলাও 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা হয়ে যায়, আর কারাগার থেকে খুনিরা সদর্পে বেরিয়ে যায়। তার সঙ্গে বিগত জোট সরকারের আমল থেকে শুরু হয়েছে, আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিদেরও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়া। এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের সংবিধানই রাষ্ট্রপতিকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতার এমন ব্যবহার কি করা উচিত, যা দেশবাসীকে আহত করে? বলাবাহুল্য, রাষ্ট্রপতি কিন্তু নিজে নিজে সেই সিদ্ধান্ত নেন না, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে যায়, তাতে স্বাক্ষর করা রাষ্ট্রপতির প্রায় বাধ্যতামূলক একটি কাজ। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরে অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়টি যে দেশবাসীকে আহত করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত পাঠকের মতামত থেকে। অনেকে এমন অনেক প্রশ্ন করেছেন, যার জবাব দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব। এ ছাড়া আছে থানাগুলোর ওপর এমপি বা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রীদের অপরিমিত প্রভাব। ফলে দলীয় ক্যাডারদের অন্যায়ের ব্যাপারে থানা নীরব থাকে, সাধারণ মানুষ অপরিসীম দুর্ভোগের শিকার হয়।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইন বলবৎ করার জন্য পুলিশ বা বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে, অপরাধীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষা এবং তারা যাতে শান্তিতে জীবন যাপন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। দেশের বিচারব্যবস্থা এই বাহিনীগুলোর সহায়তায় অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করবে_এটাই সভ্যতার নিয়ম। এর মাধ্যমেই একটি দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কী হচ্ছে? ঠিক যেন তার উল্টো পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ! সুশাসন, আইনের শাসন কেবলই সুদূরপরাহত হচ্ছে। যে পুলিশ বাহিনীর প্রধান কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি আইন ভঙ্গ করছে। আইন শুধু ভঙ্গই করছে না, আইনকে রীতিমতো গুলিয়ে গিলে খাচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০১১ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত 'ডাকাত সন্দেহে' ৯৫ নিরপরাধ ব্যক্তি গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। কারণ আদালতে কারো অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি আইনের দৃষ্টিতে নিরপরাধ। আর কোনো ব্যক্তি যদি ডাকাতির সঙ্গে জড়িতও থাকে, তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। অভিযোগ আছে, গণপিটুনির এসব ঘটনার অধিকাংশের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুলিশ জড়িত। বিভাগীয় তদন্তে, এমনকি আদালতেও পুলিশের এ ধরনের বেশ কিছু ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ওসিসহ চার পুলিশকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো আছেই। এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে অর্থের বিনিময়ে অপরাধীদের বাঁচিয়ে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া, মাসোহারার বিনিময়ে অপরাধীদের নির্বিঘ্নে অপরাধ করতে দেওয়া, নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করে অর্থ আদায়সহ বহু অবৈধ কাজ।
বিগত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার নামে ৭০ হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দিয়েছিল। তাদের আমলে এ দেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভায় গ্রেনেড ও বোমা হামলার কারণে বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রীসহ ২৪ জন নিহত এবং কয়েক শ ব্যক্তি আহত হয়েছিলেন। অথচ তখন জজ মিয়া প্রহসনের মাধ্যমে কিভাবে তদন্তকে বিপথে পরিচালিত করা হয়েছিল, তা কারো অজানা নয়। যে দুর্ধর্ষ জঙ্গি বাংলাভাইয়ের পরে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তিনি আগেও কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তিনি মুক্তি পেয়ে গেছেন। বরং যেসব পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, তাঁরাই তিরস্কৃত হয়েছিলেন। দশ ট্রাক অস্ত্র ধরার অপরাধে পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছিলেন। এভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে তখন সন্ত্রাসকে উৎসাহী করা হয়েছিল। এ সরকার জঙ্গিবাদ দমনে কিছুটা সফল হলেও সাধারণ অপরাধীদের ব্যাপারে একই পন্থা অনুসরণ করে চলেছে। ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর পরও 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলার অজুহাতে মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এগুলো কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এসবের ফলাফল কী হচ্ছে? আজ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেই বলা হচ্ছে, এটি 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক' মামলা। বিরোধীদলীয় নেত্রীর সন্তানের বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলা বিদেশের আদালতেও প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রী বা তাঁর সন্তানদের বিরুদ্ধে সরকার নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক মামলা করতে গেলেও বিরোধী দল থেকে একে 'রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা' আখ্যায়িত করে হরতাল, বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগি্নসংযোগের মতো কর্মসূচি দিচ্ছেন। এমনকি সর্বোচ্চ আদালতে দলভুক্ত আইনজীবীরা চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। বিচারককে গালাগাল করা, প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা, গাড়ি ভাঙচুর, মারামারি_আজ পর্যন্ত কী হয়নি সর্বোচ্চ আদালতে। সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী, যাঁদের আইন ভালো করেই জানা আছে, তাঁরা এমন বেআইনি কাজ করেন কিভাবে? এঁদের কি আইনজীবীর পরিচয় ধরে রাখার কোনো নৈতিক অধিকার আছে?
সুশাসনের স্বার্থে, আইনের শাসনের স্বার্থে এভাবে উল্টো পথে হাঁটা অবিলম্বে আমাদের বন্ধ করা উচিত। আদালতে যেসব মামলা হয়, তার কোনটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক আর কোনটি প্রকৃত অপরাধমূলক_আদালতই তা নির্ধারণ করবে। হয়রানিমূলক মামলাগুলো আদালত থেকেই খারিজ হয়ে যাবে। ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানিমূলক মামলা করার জন্য মামলার বাদীকেও দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গণহারে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা মনে করি, মহাজোট সরকার যে তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রকৃত অর্থেই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তার প্রমাণ তারা এখনো রাখতে পারে। আর সে জন্য এ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে যত মামলা তারা প্রত্যাহার করেছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত করে আদালতের হাতে নিষ্পত্তি করার ভার অর্পণ করতে পারে। একইভাবে বিগত জোট সরকারের আমলে যেসব মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল সেগুলোও পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।
আমরা সমাজে শান্তি চাই এবং বিশ্বাস করি, অপরাধে উৎসাহ জুগিয়ে কোনো অবস্থাতেই সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায় না। আমরা আশা করি, রাষ্ট্র সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক : সাংবাদিক
No comments