রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চাইলে সংলাপের বিকল্প নেই-রাজনীতি by জিল্লুর রহমান খান
বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটছে, তা নিয়ে দ্বিমত করা চলে না। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যে ৬ শতাংশের বেশি থাকছে তার পেছনে অগণিত ছোট-বড় উদ্যোক্তার অবদান রয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প সরকারকেই সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এ পর্যন্ত সঠিক অবস্থানে চলছে বলে মনে হয় না।
বিশ্বব্যাংক যখন আপত্তি তুলেছে তখন সরকারের বলা ভালো ছিল যে, তোমরা কীভাবে কাজটি সম্পাদিত হবে দেখতে চাও_ সেটা বলো। 'দুদক সেতু নির্মাণ কাজে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি'_ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দাতাদের সন্তুষ্ট করা যাবে বলে মনে হয় না। এতে বরং অন্যান্য প্রকল্পে তাদের সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছি দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। বিশ্বের সবচেয়ে সবল অর্থনীতির দেশটির অর্থনীতি নিয়ে এখন অনেকের উদ্বেগ রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপ ব্যাপক। তার চেয়ে বড় চাপ বেকারত্বের। অর্থনীতিতে মন্দার কারণে বিনিয়োগে প্রভাব পড়ছে। আর বিনিয়োগে মন্দা চললে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানের বাজারে। সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিতে এক নম্বর পরাশক্তির দেশটিতে বেকারত্বের হার এখন ৯ শতাংশের বেশি। বেকারদের জীবনযাপন কত কষ্টের, সেটা বাংলাদেশের কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগের। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ১১.৫৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১০.৬৩ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্যের জন্য ব্যয় যা বেড়েছে, খাদ্যবহির্ভূত খাতে বেড়েছে আরও বেশি হারে। জানুয়ারিতে এটা ছিল গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১৩.১৬ শতাংশ। যাতায়াত, শিক্ষা, বাড়ি ভাড়া প্রভৃতি নানা খাত ধরা হয়েছে এতে।
তবে কি বলব যে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ রয়েছে একই কাতারে? উভয় দেশেই মানুষ রয়েছে অশেষ কষ্টে?
এটা মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশে জনগণের জন্য অনেক ধরনের নিরাপত্তাবলয় থাকে। বেকারদের জন্য রয়েছে সরকারি ভাতা। চাকরি না থাকলেও বছর দুয়েক তারা চালিয়ে নিতে পারে। চিকিৎসার প্রয়োজনে নূ্যনতম কিছু সরকারি সেবা সবাই পেয়ে যায়। যখন অর্থনীতি সংকটে পড়ে, বাজার অস্থির হয়ে ওঠে, তখন ১৫-২০ শতাংশ মানুষ সেখানে যথেষ্ট দুর্ভোগে পড়ে। বাদবাকি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষের জীবনে সেটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে না। এ কারণে কেউ সেখানে নতুন করে গেলে অর্থনীতির সমস্যা চট করে বুঝে উঠতে পারবে না। বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলে ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষের জীবনে তার প্রভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ, যা মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সাড়ে চার শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে আরও রয়েছে ৫৫ লাখ অর্ধবেকার। এই বেকার ও অর্ধবেকারদের পাশে কিন্তু সরকারের পক্ষে সেভাবে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এ কারণে চাল-ডাল-তেলের বাজার চড়ে গেলে, বাড়ি ভাড়া এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে এ জনগোষ্ঠীর কষ্টের শেষ থাকে না। তাদের বাইরে আরও লাখ লাখ মানুষ রয়েছে যারা প্রতিদিন কাজ করছে এবং মজুরিও পাচ্ছে; কিন্তু তারা ভালো আছে সেটা বলা যাবে না। তাদের বলতে পারি, কোনো রকমে বেঁচে থাকছে। তাদের কষ্টের দিনে সরকার মাসের পর মাস খাদ্যের জোগান দেবে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেবে না। কারও অসুখ হলে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা মিলবে না। আমাদের মতো দেশে ১০-১৫ শতাংশ মানুষ ভালো থাকে। মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। বাকিদের সংখ্যা যেহেতু অনেক, তাই সহজেই সংকট বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুদ্ধ চালিয়েছে। আফগানিস্তানে লড়ছে। এর বোঝা বিপুল। ফিলিপাইন ও কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে তাদের অনেক সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েন রয়েছে। বারাক ওবামা এ চোরাবালি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। তবে সবসময়ই চেষ্টা থাকে সমঝোতার। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো বিরোধীদের অব্যাহত সংসদ বর্জনের ঘটনা ঘটে না। তাই বলে রাজনৈতিক সংঘাত যে কম, সেটা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রেও বিরোধীরা কারণে-অকারণে সরকারের বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রবণতা হাস্যকরভাবে ধরা পড়ে। পাল্টাপাল্টির ঘটনাও কম নয়। মরণপণ বিরোধিতাও দেখা যায়। কিন্তু আইন করতে হলে সরকারকে বিরোধীদের আমলে নিতেই হয়। আর এ কারণেই প্রতিটি ইস্যুতেই উভয় পক্ষ সমঝোতার সূত্র সন্ধানে সচেষ্ট থাকে।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রায় সব ইস্যুতেই তাদের সম্পর্ক আদা-কাঁচকলার মতো। এক দল ক্ষমতায় থাকলে আরেক দল অব্যাহত সংসদ বর্জনের নীতি অনুসরণ করে। গত দুটি সংসদে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন জোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিরোধী দল প্রায় প্রান্তিক অবস্থানে। তবে তাদের প্রাপ্ত আসনের সঙ্গে পপুলার ভোট আদৌ আনুপাতিক নয়। বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট পেয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ, কিন্তু সংসদে আসন পেয়েছে দশ ভাগের এক ভাগ। আগেরবার আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশের বেশি, কিন্তু আসন ছিল ২০ শতাংশ। এ কারণে নির্বাচন পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার সাধন জরুরি হয়ে পড়েছে। আসন সংখ্যা যাই হোক না কেন প্রধান বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের। এটা রক্ষা করা হয়নি; কিন্তু তা করার সুযোগ শেষ হয়েও যায়নি। নির্বাচনে দলের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংসদে আসন বরাদ্দ করা সংবিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়, কিন্তু এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বণ্টনে সমস্যা থাকার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনকে বিপুল ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাও জরুরি। অনেকে মনে করেন, প্রধান দুটি দল যেভাবে চলছে তাতে বিরোধী পক্ষের আসন যথেষ্ট কম থাকা বরং শাপে বর হয়, আসন কাছাকাছি থাকলে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং শাসন কাজে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এটা কাটিয়ে উঠতে পারাই তো নেতৃত্বগুণ। দেশবাসীর প্রত্যাশা হচ্ছে তাদের মধ্যে সমঝোতার। সংসদে যাদের অবস্থান রয়েছে তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। শেখ হাসিনার সামরিক শাসনবিরোধী অবস্থান সুবিদিত। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট দলবলে তিনি অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু সংসদে যেহেতু এসব দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাই তাদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে।
দেশে দুর্নীতি আছে এবং তার মাত্রা ব্যাপক। অনেক দেশে বলা হয়, দুর্নীতি হচ্ছে লুব্রিকেন্টের মতো, যা কাজ সহজ করে দেয়। কিন্তু ঘুষ নিয়ে কাজ না করার অনেক ঘটনা আমরা বাংলাদেশে দেখি। এখানে নিয়ন্ত্রকরা জড়িয়ে পড়ছে অন্যায়ে। শেয়ারবাজারে বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারি তদন্ত কমিটি কিছু ব্যক্তিকে দায়ী করেছে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিরোধীরা দুর্বল, এটা ভেবে সরকার যদি আত্মপ্রসাদে মগ্ন থাকে সেটা ভুল হবে। প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে বিরোধীরা যথেষ্টসংখ্যক মানুষের সমর্থন ভোগ করে। পরবর্তী নির্বাচনে তারা সরকার সমর্থক ৩-৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারলেই আসনসংখ্যা অনেক বাড়িয়ে নিতে পারবে। আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে, যখন বিরোধীরা তেমন সবাক ও সমালোচনামুখর থাকে না, তখন দলের ভেতরেই প্রবণতা দেখা যায়। শেয়ারবাজার ইস্যুতে তোফায়েল আহমেদ অর্থমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তারানা হালিম। এ ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। তৃতীয় পক্ষ এর প্রতি নজর রাখে। প্রধান দুটি দলের সংঘাতকেও তারা বিশেষভাবে আমলে নেয়। সেনাশাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের কয়েকবার হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি না চাইলে অবশ্যই সংলাপের পথে চলতে হবে। দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসতে হবে। দেশের স্থিতিশীলতা ও সভ্যতার এটা ভিত্তি।
বর্তমানে দুটি দলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধ তুঙ্গে। কিন্তু এ প্রশ্নে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য ফয়সালা হলেই যে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ প্রশমিত হবে এমন আশা করা ঠিক নয়। উপদেষ্টা পরিষদে কারা যাবেন, নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে গঠিত হবে_ এসব নানা ইস্যুতে নতুন করে বিরোধ দেখা দেবে। উভয় পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এমনটিই করেছিলেন।
দুই পক্ষ দীর্ঘ সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থানে থাকলে কী পরিণতি নেমে আসে, সেটা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। এ সরকারের খুঁটির জোর প্রকৃতপক্ষে ছিল সামরিক বাহিনী। তারা উভয়েই দুই বছরের এ শাসনকালে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তাদের অনেক নেতার কারাদণ্ড হয়েছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। দুর্নীতির ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করে তাদের হেয় করা হয়েছে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে আমরা দেখছি, এ দুটি দল পরস্পরকে যতটা ঘৃৃণা করে সেনাবাহিনীতে ততটা করে না। এর পরিবর্তে বরং তাদের তোয়াজ করার মনোভাবই প্রকাশ পায়। এ অবসান ঘটাতে না পারলে তাদের ফের মূল্য দিতে হতে পারে এবং অনেকের আশঙ্কা, তা আগেরবারের চেয়েও চড়া হতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটছে, তা নিয়ে দ্বিমত করা চলে না। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যে ৬ শতাংশের বেশি থাকছে তার পেছনে অগণিত ছোট-বড় উদ্যোক্তার অবদান রয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প সরকারকেই সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এ পর্যন্ত সঠিক অবস্থানে চলছে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংক যখন আপত্তি তুলেছে তখন সরকারের বলা ভালো ছিল যে, তোমরা কীভাবে কাজটি সম্পাদিত হবে দেখতে চাও_ সেটা বলো। 'দুদক সেতু নির্মাণ কাজে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি'_ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দাতাদের সন্তুষ্ট করা যাবে বলে মনে হয় না। এতে বরং অন্যান্য প্রকল্পে তাদের সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যায় না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এ বাস্তবতা প্রধান দুটি দলকে বিবেচনায় রাখতে হবে। জনগণের স্বার্থকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিলে তারা অনেক ইস্যুতে অবশ্যই পরস্পরের কাছে আসতে পারবেন।
জিল্লুর রহমান খান : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইমেরিটাস অধ্যাপক, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছি দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। বিশ্বের সবচেয়ে সবল অর্থনীতির দেশটির অর্থনীতি নিয়ে এখন অনেকের উদ্বেগ রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চাপ ব্যাপক। তার চেয়ে বড় চাপ বেকারত্বের। অর্থনীতিতে মন্দার কারণে বিনিয়োগে প্রভাব পড়ছে। আর বিনিয়োগে মন্দা চললে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে কর্মসংস্থানের বাজারে। সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিতে এক নম্বর পরাশক্তির দেশটিতে বেকারত্বের হার এখন ৯ শতাংশের বেশি। বেকারদের জীবনযাপন কত কষ্টের, সেটা বাংলাদেশের কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি উদ্বেগের। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরো জানিয়েছে, জানুয়ারি মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ছিল পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে ১১.৫৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে ছিল ১০.৬৩ শতাংশ। এ সময়ে খাদ্যের জন্য ব্যয় যা বেড়েছে, খাদ্যবহির্ভূত খাতে বেড়েছে আরও বেশি হারে। জানুয়ারিতে এটা ছিল গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১৩.১৬ শতাংশ। যাতায়াত, শিক্ষা, বাড়ি ভাড়া প্রভৃতি নানা খাত ধরা হয়েছে এতে।
তবে কি বলব যে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ রয়েছে একই কাতারে? উভয় দেশেই মানুষ রয়েছে অশেষ কষ্টে?
এটা মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি প্রভৃতি উন্নত দেশে জনগণের জন্য অনেক ধরনের নিরাপত্তাবলয় থাকে। বেকারদের জন্য রয়েছে সরকারি ভাতা। চাকরি না থাকলেও বছর দুয়েক তারা চালিয়ে নিতে পারে। চিকিৎসার প্রয়োজনে নূ্যনতম কিছু সরকারি সেবা সবাই পেয়ে যায়। যখন অর্থনীতি সংকটে পড়ে, বাজার অস্থির হয়ে ওঠে, তখন ১৫-২০ শতাংশ মানুষ সেখানে যথেষ্ট দুর্ভোগে পড়ে। বাদবাকি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নারী-পুরুষের জীবনে সেটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলে না। এ কারণে কেউ সেখানে নতুন করে গেলে অর্থনীতির সমস্যা চট করে বুঝে উঠতে পারবে না। বাংলাদেশের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের চিত্র ভিন্ন। এখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলে ৮০-৮৫ শতাংশ মানুষের জীবনে তার প্রভাব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ, যা মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সাড়ে চার শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, দেশে আরও রয়েছে ৫৫ লাখ অর্ধবেকার। এই বেকার ও অর্ধবেকারদের পাশে কিন্তু সরকারের পক্ষে সেভাবে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এ কারণে চাল-ডাল-তেলের বাজার চড়ে গেলে, বাড়ি ভাড়া এবং শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লে এ জনগোষ্ঠীর কষ্টের শেষ থাকে না। তাদের বাইরে আরও লাখ লাখ মানুষ রয়েছে যারা প্রতিদিন কাজ করছে এবং মজুরিও পাচ্ছে; কিন্তু তারা ভালো আছে সেটা বলা যাবে না। তাদের বলতে পারি, কোনো রকমে বেঁচে থাকছে। তাদের কষ্টের দিনে সরকার মাসের পর মাস খাদ্যের জোগান দেবে না, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেবে না। কারও অসুখ হলে হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা মিলবে না। আমাদের মতো দেশে ১০-১৫ শতাংশ মানুষ ভালো থাকে। মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ হলেও তাদের কিছু যায় আসে না। বাকিদের সংখ্যা যেহেতু অনেক, তাই সহজেই সংকট বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে যুদ্ধ চালিয়েছে। আফগানিস্তানে লড়ছে। এর বোঝা বিপুল। ফিলিপাইন ও কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে তাদের অনেক সৈন্য স্থায়ীভাবে মোতায়েন রয়েছে। বারাক ওবামা এ চোরাবালি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে রাজনীতির অঙ্গনে। তবে সবসময়ই চেষ্টা থাকে সমঝোতার। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো বিরোধীদের অব্যাহত সংসদ বর্জনের ঘটনা ঘটে না। তাই বলে রাজনৈতিক সংঘাত যে কম, সেটা বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রেও বিরোধীরা কারণে-অকারণে সরকারের বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রবণতা হাস্যকরভাবে ধরা পড়ে। পাল্টাপাল্টির ঘটনাও কম নয়। মরণপণ বিরোধিতাও দেখা যায়। কিন্তু আইন করতে হলে সরকারকে বিরোধীদের আমলে নিতেই হয়। আর এ কারণেই প্রতিটি ইস্যুতেই উভয় পক্ষ সমঝোতার সূত্র সন্ধানে সচেষ্ট থাকে।
বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রায় সব ইস্যুতেই তাদের সম্পর্ক আদা-কাঁচকলার মতো। এক দল ক্ষমতায় থাকলে আরেক দল অব্যাহত সংসদ বর্জনের নীতি অনুসরণ করে। গত দুটি সংসদে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন জোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। বিরোধী দল প্রায় প্রান্তিক অবস্থানে। তবে তাদের প্রাপ্ত আসনের সঙ্গে পপুলার ভোট আদৌ আনুপাতিক নয়। বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোট পেয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ, কিন্তু সংসদে আসন পেয়েছে দশ ভাগের এক ভাগ। আগেরবার আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৪০ শতাংশের বেশি, কিন্তু আসন ছিল ২০ শতাংশ। এ কারণে নির্বাচন পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার সাধন জরুরি হয়ে পড়েছে। আসন সংখ্যা যাই হোক না কেন প্রধান বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের। এটা রক্ষা করা হয়নি; কিন্তু তা করার সুযোগ শেষ হয়েও যায়নি। নির্বাচনে দলের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী সংসদে আসন বরাদ্দ করা সংবিধান অনুযায়ী সম্ভব নয়, কিন্তু এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বণ্টনে সমস্যা থাকার কথা নয়। নির্বাচন কমিশনকে বিপুল ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাও জরুরি। অনেকে মনে করেন, প্রধান দুটি দল যেভাবে চলছে তাতে বিরোধী পক্ষের আসন যথেষ্ট কম থাকা বরং শাপে বর হয়, আসন কাছাকাছি থাকলে সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা এবং শাসন কাজে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এটা কাটিয়ে উঠতে পারাই তো নেতৃত্বগুণ। দেশবাসীর প্রত্যাশা হচ্ছে তাদের মধ্যে সমঝোতার। সংসদে যাদের অবস্থান রয়েছে তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলতে হবে। শেখ হাসিনার সামরিক শাসনবিরোধী অবস্থান সুবিদিত। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ক্যান্টনমেন্টে সৃষ্ট দলবলে তিনি অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু সংসদে যেহেতু এসব দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাই তাদের সঙ্গে কথা বলতেই হবে।
দেশে দুর্নীতি আছে এবং তার মাত্রা ব্যাপক। অনেক দেশে বলা হয়, দুর্নীতি হচ্ছে লুব্রিকেন্টের মতো, যা কাজ সহজ করে দেয়। কিন্তু ঘুষ নিয়ে কাজ না করার অনেক ঘটনা আমরা বাংলাদেশে দেখি। এখানে নিয়ন্ত্রকরা জড়িয়ে পড়ছে অন্যায়ে। শেয়ারবাজারে বিশৃঙ্খলার জন্য সরকারি তদন্ত কমিটি কিছু ব্যক্তিকে দায়ী করেছে; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
বিরোধীরা দুর্বল, এটা ভেবে সরকার যদি আত্মপ্রসাদে মগ্ন থাকে সেটা ভুল হবে। প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে বিরোধীরা যথেষ্টসংখ্যক মানুষের সমর্থন ভোগ করে। পরবর্তী নির্বাচনে তারা সরকার সমর্থক ৩-৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারলেই আসনসংখ্যা অনেক বাড়িয়ে নিতে পারবে। আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে, যখন বিরোধীরা তেমন সবাক ও সমালোচনামুখর থাকে না, তখন দলের ভেতরেই প্রবণতা দেখা যায়। শেয়ারবাজার ইস্যুতে তোফায়েল আহমেদ অর্থমন্ত্রীর তীব্র সমালোচনা করেছেন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তারানা হালিম। এ ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। তৃতীয় পক্ষ এর প্রতি নজর রাখে। প্রধান দুটি দলের সংঘাতকেও তারা বিশেষভাবে আমলে নেয়। সেনাশাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের কয়েকবার হয়েছে। তার পুনরাবৃত্তি না চাইলে অবশ্যই সংলাপের পথে চলতে হবে। দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসতে হবে। দেশের স্থিতিশীলতা ও সভ্যতার এটা ভিত্তি।
বর্তমানে দুটি দলের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধ তুঙ্গে। কিন্তু এ প্রশ্নে উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য ফয়সালা হলেই যে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ প্রশমিত হবে এমন আশা করা ঠিক নয়। উপদেষ্টা পরিষদে কারা যাবেন, নির্বাচন কমিশন কাদের নিয়ে গঠিত হবে_ এসব নানা ইস্যুতে নতুন করে বিরোধ দেখা দেবে। উভয় পক্ষ থেকে সমানসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে। ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এমনটিই করেছিলেন।
দুই পক্ষ দীর্ঘ সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থানে থাকলে কী পরিণতি নেমে আসে, সেটা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমরা দেখেছি। এ সরকারের খুঁটির জোর প্রকৃতপক্ষে ছিল সামরিক বাহিনী। তারা উভয়েই দুই বছরের এ শাসনকালে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তাদের অনেক নেতার কারাদণ্ড হয়েছে। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছে। দুর্নীতির ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করে তাদের হেয় করা হয়েছে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে আমরা দেখছি, এ দুটি দল পরস্পরকে যতটা ঘৃৃণা করে সেনাবাহিনীতে ততটা করে না। এর পরিবর্তে বরং তাদের তোয়াজ করার মনোভাবই প্রকাশ পায়। এ অবসান ঘটাতে না পারলে তাদের ফের মূল্য দিতে হতে পারে এবং অনেকের আশঙ্কা, তা আগেরবারের চেয়েও চড়া হতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটছে, তা নিয়ে দ্বিমত করা চলে না। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি যে ৬ শতাংশের বেশি থাকছে তার পেছনে অগণিত ছোট-বড় উদ্যোক্তার অবদান রয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প সরকারকেই সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার এ পর্যন্ত সঠিক অবস্থানে চলছে বলে মনে হয় না। বিশ্বব্যাংক যখন আপত্তি তুলেছে তখন সরকারের বলা ভালো ছিল যে, তোমরা কীভাবে কাজটি সম্পাদিত হবে দেখতে চাও_ সেটা বলো। 'দুদক সেতু নির্মাণ কাজে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি'_ এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে দাতাদের সন্তুষ্ট করা যাবে বলে মনে হয় না। এতে বরং অন্যান্য প্রকল্পে তাদের সহায়তা পাওয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশে তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা আপাতত দেখা যায় না। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এ বাস্তবতা প্রধান দুটি দলকে বিবেচনায় রাখতে হবে। জনগণের স্বার্থকে সবকিছুর ওপরে স্থান দিলে তারা অনেক ইস্যুতে অবশ্যই পরস্পরের কাছে আসতে পারবেন।
জিল্লুর রহমান খান : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইমেরিটাস অধ্যাপক, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
No comments