সময়ের প্রতিধ্বনি-প্রণব মুখার্জির আসন্ন ঢাকা সফর এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক by মোস্তফা কামাল
বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশে আসছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝালাই করতেই তিনি এই সফর করবেন বলে পত্রিকাগুলোতে রিপোর্ট বেরিয়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছে, শেখ হাসিনার মান ভাঙাতে ঢাকায় আসছেন প্রণব।
এর মানে হচ্ছে, দুই দেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে ভারত।
বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চুক্তি সই, সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে গড়িমসি এবং সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা শীতল করেছে। এই শীতল সম্পর্কের অবসান হওয়ার দরকার বলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে ভারতের সুধীসমাজের পক্ষ থেকে সে দেশের সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। ভারতের গণমাধ্যম তো প্রকাশ্যেই বলছে, 'ভারতের জন্য বাংলাদেশ যা করেছে, এর বিনিময়ে ভারতের উচিত দুই হাত খুলে বাংলাদেশকে দেওয়া।' কিন্তু ভারতের আমলাদের হাত খোলা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকাতেও রাজি নন তাঁরা। অথচ ভারত বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে। চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগও তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি শুধু ভারতকে দিয়েই যাবে? ভারতের কাছ থেকে কিছু পাবে না? এটা কি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল? সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কেউ 'উদার হস্তে' ভারতকে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে সব সময় তৈরি থাকেন। বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের একটি অংশের ধারণা, তাঁদের 'মিস হ্যান্ডেলিং'য়ের কারণে তিস্তা চুক্তি ঝুলে গেছে। ট্রানজিটের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য ছাড়াই একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ভারতের দেওয়া ঋণ নিয়েও সরকারকে বিপদে পড়তে হয়। রেল ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে ভারতের দেওয়া ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তও শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয় সরকারকে। কারণ ভারত ঋণ ছাড় করতে গিয়ে বাংলাদেশকে কঠিন শর্ত দিয়ে বসে। এসব ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা মারাত্মকভাবে ফুটে ওঠে।
অথচ বাংলাদেশ একটু কৌশলী হলেই কিন্তু ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করতে পারত। আমরা বারবারই বলে এসেছি, ভারতের গান্ধী পরিবার এবং বাংলাদেশের শেখ পরিবারের মধ্যে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দুই পরিবারই দুই দেশের ক্ষমতার চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বাংলাদেশ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে নিঃশর্ত সহযোগিতা প্রদান করে। এ ধরনের সহযোগিতা অতীতে কোনো সরকারের আমলেই ভারত পায়নি। এর ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল, তা অনেকটাই প্রশমিত হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও সরকারের বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের এই অবদানের কথা স্মরণ করে ভারতের গণমাধ্যম এবং সুধীসমাজ। তাদের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের উচিত একতরফাভাবে সহযোগিতা করা। ভারতের বর্তমান সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলেও 'চাণক্য কূটনীতির ধ্বজাধারী' সাউথ ব্লক (পররাষ্ট্র দপ্তর) জিলাপির প্যাঁচ দিয়ে সব কিছু আটকে দিচ্ছে। সেই প্যাঁচে বাংলাদেশের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সে অবস্থাতেই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের ট্রাক, লরি চলাচলের আয়োজন চলছে!
এ বিষয়টিকে যে দেন-দরবারের শর্ত হিসেবে নেবে তা নয়, বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা বলছেন, বাংলাদেশের স্বার্থেই নাকি ভারতকে যত দ্রুত সম্ভব ট্রানজিট দেওয়া দরকার! আবার বলা হচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি চাওয়া নাকি অশোভন দেখায়! সারা বিশ্বেই এক দেশ আরেক দেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে। বিনিময়ে পাচ্ছে ট্রানজিট ফি। আমরা কেন ফি ছাড়াই ট্রানজিট দেব? আমার জানামতে, ভারত-পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন নিয়ে আলোচনা চলছে। ইরান থেকে ভারতে গ্যাস আনতে হলে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। ট্রানজিট ফির বিনিময়ে পাকিস্তান ভারতকে পাইপলাইন স্থাপনে ট্রানজিট দিতে রাজি। বাংলাদেশেরও আপত্তি করার কিছু নেই। তবে ট্রানজিট ফি অবশ্যই আদায় করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যাও আদায় করে নিতে হবে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি নিজের উপলব্ধি থেকেই বলেছেন, 'ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা দরকার।' এ জন্য কী পথ বের করা যায়, তা তিনি খতিয়ে দেখছেন। আমরা তো ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছে প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইতে পারি! আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভারতের বাজারে ঢুকতে পারলে সেখানে বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। নূ্যনতম দু-তিনটি পণ্য ভারতের বাজার ধরতে পারলে বাণিজ্য ঘাটতি বলে কোনো শব্দ থাকবে না। আমরা তো ট্রানজিটকে বাণিজ্য সুবিধা লাভের 'ট্রামকার্ড' হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম! অবশ্য সেই সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
এদিকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সুরাহা হলো না, অথচ ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তি সই করেছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বারবারই বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প ভারত বাস্তবায়ন করবে না। গত বছর ঢাকা সফরকালেও তিনি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তার পরও ভারত ওই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি কেন উল্টো সুরে কথা বলছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেছেন, ভারত সেচকাজের জন্য বাঁধ নির্মাণ করছে। অথচ ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি সই করেছে। এই তথ্য কি দীপু মনির কাছে নেই?
আমরা জানতে পেরেছি, প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ঢাকা সফরে আসছেন। আসলে তিনি বরাবরই বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক। বাঙালি এই নেতা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চান। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জানেন। তিনি নিশ্চয়ই সেই বিষয়গুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন এবং সমাধানের পথ খুঁজবেন। বাংলাদেশকে কিভাবে সহযোগিতা করা যায় তাও খতিয়ে দেখবেন।
প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী হলেও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর পরেই সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে বাংলাদেশের অসন্তুষ্টি দূর করতে পারেন। তা ছাড়া ভারত সরকারের মূল চালিকাশক্তি সোনিয়া গান্ধীও শেখ হাসিনা সরকারকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে আন্তরিক। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ইতিবাচক মনোভাবকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগানো উচিত। এতে শুধু যে শেখ হাসিনা সরকার লাভবান হবে তা নয়, এ দেশের মানুষের মনে যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হচ্ছে তাও কেটে যাবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান। প্রতিবেশী এই দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের ভ্রান্তনীতির কারণে সেই মনোভাব চাঙ্গা হোক, তা নিশ্চয়ই তারা চাইবে না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সুপার হাইওয়ের যুগে কোনো দেশকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তার প্রমাণ ভূরি ভূরি দেওয়া যাবে।
ভারত বড় দেশ। শুধু আকারে নয়, জনসংখ্যা এবং এর অর্থনীতির আকারও বেশ বড়। এখন দেশটির দৃষ্টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দিকে। প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোকে নিয়েই ভারতকে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিবেশী ছোট হলেও তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক ফোরামে ছোট দেশগুলোর সমর্থন লাভ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিজেদের বড়ত্ব জাহির করায় কোনো কৃতিত্ব নেই। আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে নিজের মুখ যাতে লজ্জায় ঢেকে না যায় সেই কাজটি ভারতকে করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ভারত নিজেদেরই একঘরে করে ফেলছে। এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে ভারতকে খোলামন নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা সব সময়ই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অসামান্য অবদান স্মরণ করি। পাশাপাশি ভারতের মতোই একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভারতকে আমরা পাশে পেতে চাই। প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার ঘোষণাই দেবেন বলে আশা করছি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
বাংলাদেশকে না জানিয়ে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চুক্তি সই, সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে গড়িমসি এবং সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো দুই দেশের সম্পর্ক কিছুটা শীতল করেছে। এই শীতল সম্পর্কের অবসান হওয়ার দরকার বলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মনে করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে ভারতের সুধীসমাজের পক্ষ থেকে সে দেশের সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। ভারতের গণমাধ্যম তো প্রকাশ্যেই বলছে, 'ভারতের জন্য বাংলাদেশ যা করেছে, এর বিনিময়ে ভারতের উচিত দুই হাত খুলে বাংলাদেশকে দেওয়া।' কিন্তু ভারতের আমলাদের হাত খোলা তো দূরের কথা, বাংলাদেশের দিকে ফিরে তাকাতেও রাজি নন তাঁরা। অথচ ভারত বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট সুবিধা চাচ্ছে। চট্টগ্রাম নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগও তারা হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি শুধু ভারতকে দিয়েই যাবে? ভারতের কাছ থেকে কিছু পাবে না? এটা কি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, নাকি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল? সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কেউ 'উদার হস্তে' ভারতকে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে সব সময় তৈরি থাকেন। বিশেষজ্ঞ এবং সরকারের একটি অংশের ধারণা, তাঁদের 'মিস হ্যান্ডেলিং'য়ের কারণে তিস্তা চুক্তি ঝুলে গেছে। ট্রানজিটের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য ছাড়াই একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদ্যোগ সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। ভারতের দেওয়া ঋণ নিয়েও সরকারকে বিপদে পড়তে হয়। রেল ও সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নে ভারতের দেওয়া ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্তও শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয় সরকারকে। কারণ ভারত ঋণ ছাড় করতে গিয়ে বাংলাদেশকে কঠিন শর্ত দিয়ে বসে। এসব ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা মারাত্মকভাবে ফুটে ওঠে।
অথচ বাংলাদেশ একটু কৌশলী হলেই কিন্তু ভারতের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করতে পারত। আমরা বারবারই বলে এসেছি, ভারতের গান্ধী পরিবার এবং বাংলাদেশের শেখ পরিবারের মধ্যে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দুই পরিবারই দুই দেশের ক্ষমতার চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বাংলাদেশ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে নিঃশর্ত সহযোগিতা প্রদান করে। এ ধরনের সহযোগিতা অতীতে কোনো সরকারের আমলেই ভারত পায়নি। এর ফলে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ ছিল, তা অনেকটাই প্রশমিত হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও সরকারের বেশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশের এই অবদানের কথা স্মরণ করে ভারতের গণমাধ্যম এবং সুধীসমাজ। তাদের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারতের উচিত একতরফাভাবে সহযোগিতা করা। ভারতের বর্তমান সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলেও 'চাণক্য কূটনীতির ধ্বজাধারী' সাউথ ব্লক (পররাষ্ট্র দপ্তর) জিলাপির প্যাঁচ দিয়ে সব কিছু আটকে দিচ্ছে। সেই প্যাঁচে বাংলাদেশের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সে অবস্থাতেই বাংলাদেশের বুক চিরে ভারতের ট্রাক, লরি চলাচলের আয়োজন চলছে!
এ বিষয়টিকে যে দেন-দরবারের শর্ত হিসেবে নেবে তা নয়, বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা বলছেন, বাংলাদেশের স্বার্থেই নাকি ভারতকে যত দ্রুত সম্ভব ট্রানজিট দেওয়া দরকার! আবার বলা হচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট ফি চাওয়া নাকি অশোভন দেখায়! সারা বিশ্বেই এক দেশ আরেক দেশকে ট্রানজিট দিচ্ছে। বিনিময়ে পাচ্ছে ট্রানজিট ফি। আমরা কেন ফি ছাড়াই ট্রানজিট দেব? আমার জানামতে, ভারত-পাকিস্তান ও ইরানের মধ্যে ত্রিদেশীয় গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন নিয়ে আলোচনা চলছে। ইরান থেকে ভারতে গ্যাস আনতে হলে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। ট্রানজিট ফির বিনিময়ে পাকিস্তান ভারতকে পাইপলাইন স্থাপনে ট্রানজিট দিতে রাজি। বাংলাদেশেরও আপত্তি করার কিছু নেই। তবে ট্রানজিট ফি অবশ্যই আদায় করতে হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যাও আদায় করে নিতে হবে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি নিজের উপলব্ধি থেকেই বলেছেন, 'ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা দরকার।' এ জন্য কী পথ বের করা যায়, তা তিনি খতিয়ে দেখছেন। আমরা তো ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছে প্রধান প্রধান পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চাইতে পারি! আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় ভারতের বাজারে ঢুকতে পারলে সেখানে বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। নূ্যনতম দু-তিনটি পণ্য ভারতের বাজার ধরতে পারলে বাণিজ্য ঘাটতি বলে কোনো শব্দ থাকবে না। আমরা তো ট্রানজিটকে বাণিজ্য সুবিধা লাভের 'ট্রামকার্ড' হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম! অবশ্য সেই সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
এদিকে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সুরাহা হলো না, অথচ ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প বাস্তবায়ন চুক্তি সই করেছে। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বারবারই বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প ভারত বাস্তবায়ন করবে না। গত বছর ঢাকা সফরকালেও তিনি এ কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তার পরও ভারত ওই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জোর প্রতিবাদ জানিয়েছে। তার পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি কেন উল্টো সুরে কথা বলছেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেছেন, ভারত সেচকাজের জন্য বাঁধ নির্মাণ করছে। অথচ ভারত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি সই করেছে। এই তথ্য কি দীপু মনির কাছে নেই?
আমরা জানতে পেরেছি, প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জি অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে ঢাকা সফরে আসছেন। আসলে তিনি বরাবরই বাংলাদেশের ব্যাপারে ইতিবাচক। বাঙালি এই নেতা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চান। তা ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের অসন্তুষ্টির ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জানেন। তিনি নিশ্চয়ই সেই বিষয়গুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন এবং সমাধানের পথ খুঁজবেন। বাংলাদেশকে কিভাবে সহযোগিতা করা যায় তাও খতিয়ে দেখবেন।
প্রণব মুখার্জি অর্থমন্ত্রী হলেও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর পরেই সর্বভারতীয় নেতা হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি ইচ্ছা করলে বাংলাদেশের অসন্তুষ্টি দূর করতে পারেন। তা ছাড়া ভারত সরকারের মূল চালিকাশক্তি সোনিয়া গান্ধীও শেখ হাসিনা সরকারকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে আন্তরিক। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ইতিবাচক মনোভাবকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগানো উচিত। এতে শুধু যে শেখ হাসিনা সরকার লাভবান হবে তা নয়, এ দেশের মানুষের মনে যে ভারতবিরোধী মনোভাব তৈরি হচ্ছে তাও কেটে যাবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে সক্ষম যে পাকিস্তান, নেপাল এবং বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাব বিদ্যমান। প্রতিবেশী এই দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের ভ্রান্তনীতির কারণে সেই মনোভাব চাঙ্গা হোক, তা নিশ্চয়ই তারা চাইবে না। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এই সুপার হাইওয়ের যুগে কোনো দেশকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তার প্রমাণ ভূরি ভূরি দেওয়া যাবে।
ভারত বড় দেশ। শুধু আকারে নয়, জনসংখ্যা এবং এর অর্থনীতির আকারও বেশ বড়। এখন দেশটির দৃষ্টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দিকে। প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোকে নিয়েই ভারতকে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিবেশী ছোট হলেও তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক ফোরামে ছোট দেশগুলোর সমর্থন লাভ করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজেই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিজেদের বড়ত্ব জাহির করায় কোনো কৃতিত্ব নেই। আন্তর্জাতিক ফোরামে গিয়ে নিজের মুখ যাতে লজ্জায় ঢেকে না যায় সেই কাজটি ভারতকে করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো যেখানে তাদের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিচ্ছে, সেখানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ভারত নিজেদেরই একঘরে করে ফেলছে। এ ধরনের চিন্তাধারা থেকে ভারতকে খোলামন নিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা সব সময়ই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অসামান্য অবদান স্মরণ করি। পাশাপাশি ভারতের মতোই একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভারতকে আমরা পাশে পেতে চাই। প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করার ঘোষণাই দেবেন বলে আশা করছি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com
No comments