কালের পুরাণ-অতি-উৎসাহীদের থেকে সাবধান থাকুন! by সোহরাব হাসান
বিএনপি মানুক বা না মানুক, আগামী দু-একদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। এটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। নির্বাচন ছাড়া যেমন কোনো দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে পারে না, তেমনি নির্বাচন করার জন্য পাঁচ বছর পরপর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করারও বিকল্প নেই। আমাদের বিরোধী দলের আইনজ্ঞ নেতারা এই সহজ সূত্রটি কেন মানতে চান না, তা আমরা বুঝতে অক্ষম।
এই মুহূর্তে যদি বিএনপি ক্ষমতায় থাকত এবং আওয়ামী লীগ ‘দলীয় সরকারের অধীনে’ নির্বাচন কমিশন গঠনে আপত্তি জানাত, তাহলে তাঁরা কি মেনে নিতেন? আসলে একটি নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হলে আরেকটি কমিশন গঠন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। বিএনপির নেতারা সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজের পদত্যাগের উদাহরণ টানতে পারেন। কিন্তু তিনি কী কারণে, কোন পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছিলেন তা নিশ্চয়ই তাঁদের মনে আছে।
এম এ সাঈদের বিদায়ের পর যখন বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ আপত্তি করেনি। করলেও বিএনপি সরকার আমলে নেয়নি। জোরালো আপত্তি ও প্রতিবাদ তখনই উঠল, যখন তিনি দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করলেন, এক কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিলেন। এরপর বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখেও এম এ আজিজ কিন্তু পদত্যাগ করেননি, অফিসে যাওয়া থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল। বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদটি দখল করেননি, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনও সাজালেন নিজের খেয়ালখুশিমতো। তিনি এমন ব্যক্তিকে কমিশনার পদে নিয়োগ দিলেন, যিনি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। এবার আওয়ামী লীগ সরকার যদি এ ধরনের নিয়োগ দেয় তাহলে সেই নির্বাচন কমিশনও বিতর্কিত হবে। রাস্তায় আন্দোলন হবে।
আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই হয়তো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। গতকাল অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠিয়ে দিয়েছে। সিইসিসহ সম্ভবত পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে তালিকা পাঠানোর আগে অনুসন্ধান কমিটি যেসব নাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে পেয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারত। সে ক্ষেত্রে জনগণ জানতে পারত কোন দল কার কার নাম দিয়েছে এবং অনুসন্ধান কমিটি তাদের থেকে কোন নাম বাদ দিয়েছে, কোন নাম রেখেছে।
বিদায়ী নির্বাচন কমিশন অনেক ভালো কাজ করেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও অনেকগুলো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে করে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। নির্বাচনি আইনেও তারা অনেক পরিবর্তন এনেছে। দেশে যখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের প্রবল প্রতাপে বিধ্বস্ত, তখন নির্বাচন কমিশনকে একটি মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে বিদায়ী সিইসি এবং তাঁর দুই সহযোগী সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। পরিচয়পত্রসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তাঁরা ভুয়া ভোটার করার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। বিদায়ী ইসি যেসব সুপারিশ রেখে গেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করলে নির্বাচনে মাস্তানি ও টাকার খেলা কমে যাবে। এত সব সাফল্য ও কৃতিত্ব সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দলের আপত্তির মুখে বিদায়ী কমিশনের কারও পুনর্নিযুক্তি সমীচীন হতো না। তাতে তাদের পাঁচ বছরের সাফল্য ও কৃতিত্বই শুধু ম্লান হবে না, নতুন নির্বাচন কমিশন শুরুতেই হোঁচট খেত। অনুসন্ধান কমিটি শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ।
২.
শনিবার রাতে টেলিভিশন চ্যানেলে খবর দেখছিলাম। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বরগুনা জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। ওই বৈঠকে তিনি যে কথা বলেছেন, তাতে এই বৈরী ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশেও সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ক্ষীণ আশার আলোর আভাস পাওয়া যায়। যে নেত্রী ও তাঁর দল এক বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন; হরতাল, লংমার্চ, গণমিছিল, সভা-সমাবেশ করছেন, সেই নেত্রীর মুখে তত্ত্বাবধায়কের স্থলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা সমঝোতারই ইঙ্গিত দেয়। তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে এক নয়, তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর তা অজানা থাকার কথা নয়।
বিরোধীদলীয় নেতা এই বক্তব্য তখনই দিলেন, যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসার জন্য দুই পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে গত সপ্তাহে তিনি একাধিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। ঘরোয়া আলোচনায় বিএনপির নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহাস্য ছবি প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। দুই দলের নেতাদের এ রকম ‘মধুর মোলাকাত’ গত তিন বছরে একবারও দেখিনি। এই ত্রিপক্ষীয় হাসির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার সংশোধনী প্রস্তাবের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। অতীতে দেখেছি, বিদেশি রাষ্ট্রদূতের প্রাতরাশ অনুষ্ঠান ছাড়া সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা একসঙ্গে বসেন না। এটি যে আমাদের রাজনীতিক ও রাজনীতির জন্য কত বড় লজ্জার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিএনপির নেত্রীর সংশোধনী প্রস্তাবটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব নেই। এখন যেটি হতে পারে, তা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যেভাবে করা হয়েছে, তাতে মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই সরকার পদত্যাগ করবে এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিদায়ী সরকারপ্রধানকে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে বা কাজ চালিয়ে যেতে বলবেন। তখন ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দলীয় বা জোট সরকারের অস্তিত্ব থাকবে না।
এর পাশাপাশি আরও একটি খবর। গতকাল যুগান্তর-এর প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আইন হচ্ছে’। এতে আরও বলা হয়, ‘প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। প্রস্তাবিত রূপরেখায় সরকারি দলের পাঁচজন ও বিরোধী দলের পাঁচজন থাকবেন এই অন্তর্বর্তী সরকারে।’
এই খবর সত্য হলে তা হবে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার পথে এককদম এগোনো। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলে খালেদা জিয়া ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন অন্তর্বর্তীকালীন রূপরেখা কী হবে? উভয় পক্ষের লক্ষ্য যদি হয় অবাধ, সুষ্ঠু একটি নির্বাচন, তাহলে রূপরেখা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনের আগেই জয়ী হতে চায়, কখনই সমস্যার সমাধান হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু রুটিনওয়ার্ক করবে, সেহেতু সেই সরকারের আকার ছোট হবে। সরকারের কপাল থেকে দলীয় ছাপ মুছে ফেলতে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল থেকে প্রতিনিধি নেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৫-৯৬ সালে স্যার নিনিয়ান ৫+৫ ফর্মুলা দিয়েছিলেন। সেটিও দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। ওই সময় নির্বাচন কমিশনের এত লোকবল ছিল না, তার নিজস্ব সচিবালয় ছিল না, আইনি রক্ষাকবচও শিথিল ছিল। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন যেসব প্রস্তাব রেখে যাচ্ছে, তা কার্যকর হলে নির্বাচন কমিশন আরও শক্তিশালী হবে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে যা খশি তা-ই করিয়ে নিতে পারবে না। যেমন পারেনি নারায়নগঞ্জে, পারেনি কুমিল্লায়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিরোধী নেতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁর এই ধন্যবাদ শর্তমুক্ত ছিল না। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার নিজে গণতন্ত্রের পথে থাকলে বিরোধী দল শত চেষ্টা করেও তা ধ্বংস করতে পারে না। আর সরকার বিধ্বংসী হলে বিরোধী দল চুপচাপ ঘরে বসে থাকলেও গণতন্ত্রকে বাঁচানো যায় না। বিএনপির আমলে যে উপর্যুপরি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তার পেছনে সরকারি দলের মদদ ছিল বলে আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগ যে অসত্য নয়, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাই তার প্রমাণ। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ মিলে কেন বিরোধী দলের কর্মসূচি ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে? বিরোধী দল নির্বিঘ্নে কোনো কর্মসূচি পালন করলে তার রেশ থাকে কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু পুলিশ বা সরকারি দল সেই কর্মসূচিতে বাধা দিলে তার রেশ বহুদিন চলতে থাকে। নতুন কর্মসূচি মানে নতুন সংঘাত। ২৯-৩০ জানুয়ারি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যা হয়েছে, তার দায় সরকার এড়াবে কীভাবে? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘২৯ জানুয়ারি বিরোধী দলের গণমিছিলে নাশকতার আশঙ্কা ছিল।’ সে জন্য তারা বিএনপিকে কর্মসূচি পরিবর্তনের অনুরোধ করতে পারত, তাদের কাছে নাশকতার তথ্য-প্রমাণ থাকলে জনগণকে জানাতে পারত। কিন্তু তা না করে সরকারি দলের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মহা আতঙ্ক সৃষ্টি করল। ৩০ জানুয়ারি বিএনপির গণমিছিল শান্তিপূর্ণই হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অতি-উৎসাহী নেতাদের বলি, বিরোধী দলের কর্মসূচি নিয়ে অকারণে মাথা গরম না করে দেশ ও জনগণের সমস্যার দিকে নজর দিন। ঘর সামলান। বিরোধী দলের কথা না শুনুন অন্তত নিজ দল ও জোটের সাংসদদের কথা শুনুন। সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণটি বোঝার চেষ্টা করুন। বিএনপির ‘চলো চলো ঢাকা চলো কর্মসূচি’ নিয়ে জনগণ বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নয়। তারা উদ্বিগ্ন শেয়ারবাজারের পতন ও বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে। তারা উদ্বিগ্ন পদ্মা সেতু না হওয়ায়। তারা উদ্বিগ্ন বেকারত্বে, টাকার অবমূল্যায়নে। তারা উদ্বিগ্ন ব্যাংকের তারল্যসংকটে। তারা কখনই তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়তে চায় না।
সরকারি ও বিরোধী দলের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ও বিতর্কের অবসান ঘটান। বছরের পর বছর এ নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ চলতে পারে না। যত দ্রুত সম্ভব এ নিয়ে একটি সমঝোতায় আসুন। এ কারণে শঙ্কা জাগে যে, দুই দলেই এমন অতি-উৎসাহী কিছু নেতা আছেন, যাঁরা সমঝোতা চান না। বিরোধ জিইয়ে রাখলে তাঁদের গুরুত্ব বাড়ে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ইতিমধ্যে বিএনপির নেত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁরা আগের অবস্থান থেকে একটুও সরে যাননি।’ আওয়ামী লীগেও এ রকম অতি-উৎসাহী নেতার অভাব নেই। দেশে শান্তি ও জনজীবনে স্বস্তি চাইলে এই অতি-উৎসাহীদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। সাবধান থাকুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
এম এ সাঈদের বিদায়ের পর যখন বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ আপত্তি করেনি। করলেও বিএনপি সরকার আমলে নেয়নি। জোরালো আপত্তি ও প্রতিবাদ তখনই উঠল, যখন তিনি দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করলেন, এক কোটি ২০ লাখ ভুয়া ভোটার দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিলেন। এরপর বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখেও এম এ আজিজ কিন্তু পদত্যাগ করেননি, অফিসে যাওয়া থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল। বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদটি দখল করেননি, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনও সাজালেন নিজের খেয়ালখুশিমতো। তিনি এমন ব্যক্তিকে কমিশনার পদে নিয়োগ দিলেন, যিনি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। এবার আওয়ামী লীগ সরকার যদি এ ধরনের নিয়োগ দেয় তাহলে সেই নির্বাচন কমিশনও বিতর্কিত হবে। রাস্তায় আন্দোলন হবে।
আগামী দু-এক দিনের মধ্যেই হয়তো নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। গতকাল অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠিয়ে দিয়েছে। সিইসিসহ সম্ভবত পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে তালিকা পাঠানোর আগে অনুসন্ধান কমিটি যেসব নাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে পেয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারত। সে ক্ষেত্রে জনগণ জানতে পারত কোন দল কার কার নাম দিয়েছে এবং অনুসন্ধান কমিটি তাদের থেকে কোন নাম বাদ দিয়েছে, কোন নাম রেখেছে।
বিদায়ী নির্বাচন কমিশন অনেক ভালো কাজ করেছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও অনেকগুলো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে করে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। নির্বাচনি আইনেও তারা অনেক পরিবর্তন এনেছে। দেশে যখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের প্রবল প্রতাপে বিধ্বস্ত, তখন নির্বাচন কমিশনকে একটি মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে বিদায়ী সিইসি এবং তাঁর দুই সহযোগী সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। পরিচয়পত্রসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে তাঁরা ভুয়া ভোটার করার পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন। বিদায়ী ইসি যেসব সুপারিশ রেখে গেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করলে নির্বাচনে মাস্তানি ও টাকার খেলা কমে যাবে। এত সব সাফল্য ও কৃতিত্ব সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দলের আপত্তির মুখে বিদায়ী কমিশনের কারও পুনর্নিযুক্তি সমীচীন হতো না। তাতে তাদের পাঁচ বছরের সাফল্য ও কৃতিত্বই শুধু ম্লান হবে না, নতুন নির্বাচন কমিশন শুরুতেই হোঁচট খেত। অনুসন্ধান কমিটি শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য তাদের ধন্যবাদ।
২.
শনিবার রাতে টেলিভিশন চ্যানেলে খবর দেখছিলাম। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বরগুনা জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। ওই বৈঠকে তিনি যে কথা বলেছেন, তাতে এই বৈরী ও বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশেও সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ক্ষীণ আশার আলোর আভাস পাওয়া যায়। যে নেত্রী ও তাঁর দল এক বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছেন; হরতাল, লংমার্চ, গণমিছিল, সভা-সমাবেশ করছেন, সেই নেত্রীর মুখে তত্ত্বাবধায়কের স্থলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের কথা সমঝোতারই ইঙ্গিত দেয়। তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে এক নয়, তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর তা অজানা থাকার কথা নয়।
বিরোধীদলীয় নেতা এই বক্তব্য তখনই দিলেন, যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসার জন্য দুই পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে গত সপ্তাহে তিনি একাধিক সমাবেশে বক্তব্য দিয়েছেন। ঘরোয়া আলোচনায় বিএনপির নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সহাস্য ছবি প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। দুই দলের নেতাদের এ রকম ‘মধুর মোলাকাত’ গত তিন বছরে একবারও দেখিনি। এই ত্রিপক্ষীয় হাসির সঙ্গে বিরোধীদলীয় নেতার সংশোধনী প্রস্তাবের কোনো যোগসূত্র আছে কি না তা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। অতীতে দেখেছি, বিদেশি রাষ্ট্রদূতের প্রাতরাশ অনুষ্ঠান ছাড়া সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা একসঙ্গে বসেন না। এটি যে আমাদের রাজনীতিক ও রাজনীতির জন্য কত বড় লজ্জার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিএনপির নেত্রীর সংশোধনী প্রস্তাবটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, ‘পঞ্চদশ সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্ব নেই। এখন যেটি হতে পারে, তা হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী যেভাবে করা হয়েছে, তাতে মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই সরকার পদত্যাগ করবে এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিদায়ী সরকারপ্রধানকে পরবর্তী সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে বা কাজ চালিয়ে যেতে বলবেন। তখন ২০০৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত দলীয় বা জোট সরকারের অস্তিত্ব থাকবে না।
এর পাশাপাশি আরও একটি খবর। গতকাল যুগান্তর-এর প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আইন হচ্ছে’। এতে আরও বলা হয়, ‘প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া প্রণয়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। প্রস্তাবিত রূপরেখায় সরকারি দলের পাঁচজন ও বিরোধী দলের পাঁচজন থাকবেন এই অন্তর্বর্তী সরকারে।’
এই খবর সত্য হলে তা হবে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার পথে এককদম এগোনো। অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলে খালেদা জিয়া ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলবেন অন্তর্বর্তীকালীন রূপরেখা কী হবে? উভয় পক্ষের লক্ষ্য যদি হয় অবাধ, সুষ্ঠু একটি নির্বাচন, তাহলে রূপরেখা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি নির্বাচনের আগেই জয়ী হতে চায়, কখনই সমস্যার সমাধান হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু রুটিনওয়ার্ক করবে, সেহেতু সেই সরকারের আকার ছোট হবে। সরকারের কপাল থেকে দলীয় ছাপ মুছে ফেলতে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দল থেকে প্রতিনিধি নেওয়া যেতে পারে। ১৯৯৫-৯৬ সালে স্যার নিনিয়ান ৫+৫ ফর্মুলা দিয়েছিলেন। সেটিও দুই পক্ষের আলোচনার ভিত্তি হতে পারে। ওই সময় নির্বাচন কমিশনের এত লোকবল ছিল না, তার নিজস্ব সচিবালয় ছিল না, আইনি রক্ষাকবচও শিথিল ছিল। বিদায়ী নির্বাচন কমিশন যেসব প্রস্তাব রেখে যাচ্ছে, তা কার্যকর হলে নির্বাচন কমিশন আরও শক্তিশালী হবে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে যা খশি তা-ই করিয়ে নিতে পারবে না। যেমন পারেনি নারায়নগঞ্জে, পারেনি কুমিল্লায়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বিরোধী নেতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁর এই ধন্যবাদ শর্তমুক্ত ছিল না। একই সঙ্গে তিনি বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার নিজে গণতন্ত্রের পথে থাকলে বিরোধী দল শত চেষ্টা করেও তা ধ্বংস করতে পারে না। আর সরকার বিধ্বংসী হলে বিরোধী দল চুপচাপ ঘরে বসে থাকলেও গণতন্ত্রকে বাঁচানো যায় না। বিএনপির আমলে যে উপর্যুপরি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল, তার পেছনে সরকারি দলের মদদ ছিল বলে আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগ যে অসত্য নয়, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাই তার প্রমাণ। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগ ও পুলিশ মিলে কেন বিরোধী দলের কর্মসূচি ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে? বিরোধী দল নির্বিঘ্নে কোনো কর্মসূচি পালন করলে তার রেশ থাকে কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু পুলিশ বা সরকারি দল সেই কর্মসূচিতে বাধা দিলে তার রেশ বহুদিন চলতে থাকে। নতুন কর্মসূচি মানে নতুন সংঘাত। ২৯-৩০ জানুয়ারি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যা হয়েছে, তার দায় সরকার এড়াবে কীভাবে? সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘২৯ জানুয়ারি বিরোধী দলের গণমিছিলে নাশকতার আশঙ্কা ছিল।’ সে জন্য তারা বিএনপিকে কর্মসূচি পরিবর্তনের অনুরোধ করতে পারত, তাদের কাছে নাশকতার তথ্য-প্রমাণ থাকলে জনগণকে জানাতে পারত। কিন্তু তা না করে সরকারি দলের পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মহা আতঙ্ক সৃষ্টি করল। ৩০ জানুয়ারি বিএনপির গণমিছিল শান্তিপূর্ণই হয়েছে।
আওয়ামী লীগের অতি-উৎসাহী নেতাদের বলি, বিরোধী দলের কর্মসূচি নিয়ে অকারণে মাথা গরম না করে দেশ ও জনগণের সমস্যার দিকে নজর দিন। ঘর সামলান। বিরোধী দলের কথা না শুনুন অন্তত নিজ দল ও জোটের সাংসদদের কথা শুনুন। সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণটি বোঝার চেষ্টা করুন। বিএনপির ‘চলো চলো ঢাকা চলো কর্মসূচি’ নিয়ে জনগণ বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নয়। তারা উদ্বিগ্ন শেয়ারবাজারের পতন ও বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে। তারা উদ্বিগ্ন পদ্মা সেতু না হওয়ায়। তারা উদ্বিগ্ন বেকারত্বে, টাকার অবমূল্যায়নে। তারা উদ্বিগ্ন ব্যাংকের তারল্যসংকটে। তারা কখনই তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়তে চায় না।
সরকারি ও বিরোধী দলের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ ও বিতর্কের অবসান ঘটান। বছরের পর বছর এ নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ চলতে পারে না। যত দ্রুত সম্ভব এ নিয়ে একটি সমঝোতায় আসুন। এ কারণে শঙ্কা জাগে যে, দুই দলেই এমন অতি-উৎসাহী কিছু নেতা আছেন, যাঁরা সমঝোতা চান না। বিরোধ জিইয়ে রাখলে তাঁদের গুরুত্ব বাড়ে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ইতিমধ্যে বিএনপির নেত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘তাঁরা আগের অবস্থান থেকে একটুও সরে যাননি।’ আওয়ামী লীগেও এ রকম অতি-উৎসাহী নেতার অভাব নেই। দেশে শান্তি ও জনজীবনে স্বস্তি চাইলে এই অতি-উৎসাহীদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। সাবধান থাকুন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments