কালের পুরাণ-ধন্যবাদ অম্বিকা সনি এবং ভারতে বাংলাদেশের টিভি by সোহরাব হাসান

ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অম্বিকা সনিকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। অনেক বিলম্বে হলেও তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভারতে না দেখানোর কাজটি ঠিক হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ভারতের যেসব নীতিনির্ধারক এত দিন বলে আসছিলেন, সেখানে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো দেখানো না-দেখানোর ব্যাপারে সরকারের কিছু করণীয় নেই, তাঁদের কথাও ভুল প্রমাণিত হলো।


করণীয় আছে বলেই ভারতের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেবল মন্ত্রী নন, মন্ত্রীর বরাতে সরকারি বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া যে খবরটি ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছে, তার শেষাংশ ছিল এরূপ:
‘ভারতের কয়েক লাখ বাংলাভাষীর মধ্যে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে দেশটির স্থানীয় কেব্ল নেটওয়ার্কে বাংলাদেশি চ্যানেলগুলোর প্রবেশের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা চলে আসছে।’ (প্রথম আলো, ১৮ সেপ্টেম্বর)
পাঠক, লক্ষ করুন। পিটিআই বলেছে, ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও তার ওপর ‘অলিখিত নিষেধাজ্ঞা’ চলে আসছে।
কেন এই ‘অলিখিত নিষেধাজ্ঞা’—সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে যাঁরা এত দিন আমাদের বোকা বানাতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কিছু কথার জবাব দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, যোগাযোগ, কানেক্টিভিটি, তথ্য ও অনুষ্ঠান বিনিময়—সবকিছু একতরফা হবে। সেটি কখনোই সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, ব্যাধির লক্ষণ; বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়, বৈরিতার কলঙ্কদাগ।
ভারত বিশাল দেশ, সেখানে অসংখ্য ভাষা, অসংখ্য জনগোষ্ঠী। ভূমির দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ গুণ, জনসংখ্যার দিক দিয়ে প্রায় নয় গুণ। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো কি প্রযুক্তি, কি নির্মাণ কৌশল, কি কলাকুশলী—কোনো দিক দিয়েই ভারতের সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবে না। তার পরও ‘অলিখিত নিষেধাজ্ঞার’ একটাই কারণ থাকতে পারে, বাংলা ভাষার প্রতি বৈরিতা। বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ মনোভাব। বাংলাদেশের সব টিভি চ্যানেল বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান এবং সংবাদ প্রচার করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোও বাংলা অনুষ্ঠান করে। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষের যোগাযোগ বাড়াতে, একে অপরের জীবনধারা জানতে টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান বিনিময় হওয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বিটিভি ও দূরদর্শনের মধ্যে অনুষ্ঠান বিনিময়ে চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি কার্যকর হলে বিটিভির অনুষ্ঠান ভারতীয় দর্শকেরা দেখতে পারবে। আর দূরদর্শনের অনুষ্ঠান যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ আগে থেকেই দেখে আসছে, সেহেতু চুক্তি তাদের জন্য নতুন কোনো সুযোগ এনে দিচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ চায়, সরকারি-বেসরকারি সব টিভি চ্যানেল ভারতে দেখানো হোক। ভারতের টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে সেখানকার জীবনধারা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারছে। বাংলাদেশের নাটক, সংগীত, বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে ভারতের মানুষ জানবে না কেন?
অম্বিকা সনি যে ভারতে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল দেখানোর ব্যাপারে আলোচনায় রাজি হয়েছেন, তাকে আমরা এক ধাপ অগ্রগতি বলব। এত দিন ভারতের সরকার, আমলা ও কূটনীতিকেরা বলে আসছিলেন, ‘আমাদের কিছু করণীয় নেই। এটি শুধু কেব্ল অপারেটরদের বিষয়। আমরা ওতে মাথা ঘামাতে যাব কেন?’ তাদের সেই যুক্তি ও তথ্য যে ঠিক ছিল না, তার প্রমাণ অম্বিকা সনির বয়ান। তবে এটুকু আসতেও বাংলাদেশকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক দেনদরবার করতে হয়েছে।
বাংলাদেশে মনমোহনের সফরের সময়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চারজন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। তাঁরা কথা দিয়েছিলেন, ভারতে যাতে বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান দেখানো হয়, সেই উদ্যোগ তাঁরা নেবেন। সময়টি ভাবুন, ভারত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না করায় বাংলাদেশের মানুষ হতাশ হয়েছে, কিন্তু অতিথির অসম্মান করেনি। মুখ্যমন্ত্রীদের সেই বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতে বাংলাদেশের অনুষ্ঠান দেখানোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে দুই দেশের জনগণের সঙ্গে জনগণের সহযোগিতার সুযোগ আরও বাড়বে।’
যেকোনো বিষয়ে ভারতের নীতিনির্ধারক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে একধরনের ভীতি কাজ করে। ছোট্ট বাংলাদেশের কয়েকটি পণ্য ভারতের বিশাল বাজারে যায়, তাতেও নানা আপত্তি ও বিপত্তি। দুই দেশের মন্ত্রীরা বৈঠকে বসে যেসব সিদ্ধান্ত নেন, তা সহজে বাস্তবায়িত হয় না। অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় আটকা পড়ে। ভারতকে নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অভয় দেওয়ার পরও কেন এ ভীতি—তার জবাব মেলে না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, বাংলাদেশে এমন একটি সরকারই চায় ভারত, যারা এখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে ভারতবিরোধী তৎপরতা চালাতে সহায়তা করবে? আর তখন ভারত সরকারের মন্ত্রী, আমলা ও কূটনীতিকেরা বলবেন, ‘আমরা তো সবই দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী তৎপরতা চলায় সেসব দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।’
ভারতের সরকারি হিসাবেই প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয় লাখ বাংলাদেশি ভারতে যায়, যাদের একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী ও চিকিৎসা গ্রহণেচ্ছু। শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের জন্য নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য যায়। সেখানে বসে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় টিভির পাশাপাশি বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান দেখতে চাইবে। সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কি ভারত সরকারের আছে? বাংলাদেশেও ভারতের বহু লোক আসে। কেউ কেউ এখানে চাকরি করেন, ব্যবসা করেন। বাংলাদেশে যদি একটি ভারতীয় চ্যানেল না দেখা যেত, তাঁদের মানসিকতা কেমন হতো? বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কতটা নেতিবাচক হতো? এখন ভারত সম্পর্কেও বাংলাদেশের মানুষ যদি অনুরূপ ধারণা করে থাকে, তার জন্য কি তাদের খুব দোষ দেওয়া যাবে?
বাংলাদেশে ভারতের যেসব টিভি চ্যানেল দেখানো হয়, তার মধ্যে বেশ কিছু আছে নন-পে চ্যানেল, অর্থাৎ এসব চ্যানেলকে তাঁদের অনুষ্ঠান ডাউন লিংক করতে অর্থ দিতে হয় না। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো সেভাবেই দেখানো হয়।
কিন্তু ভারতের বেশ কিছু টিভি চ্যানেল দেখার জন্য বাংলাদেশের কেব্ল অপারেটরদের টাকা গুনতে হয়। ইংরেজি সাপ্তাহিক ব্লিজ-এর ১ জুন সংখ্যায় টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য বাংলাদেশকে যে বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হয় তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে: স্টার প্লাস ১,৯৫,০০০ মার্কিন ডলার, স্টার মুভিজ ১৪,০০০, সনি ১,২৩,০০০, সেটম্যাক্স (সনির অংশ) ৭২,০০০, স্টার গোল্ড ৬১,০০০, জি সিনেমা ৯,৫০০, স্টার স্পোর্টস ৭,০০০, জি প্রিমিয়ার ৩,৯০০, জি অ্যাকশন ২,১০০, জি ক্যাফে ১,৯০০, জি বাংলা ১৭,০০০, তারা মিউজিক ৬,০০০, স্টার ওয়ান ২৩,০০০ ও স্টার ওয়ার্ল্ড ২৩,০০০ মার্কিন ডলার।
কেবল তা-ই নয়, এসব টিভির বিজ্ঞাপনের কল্যাণে বাংলাদেশে তাদের বাজারও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর বিনিময়ে বাংলাদেশের কিছুই কি পাওয়ার নেই?
বাংলাদেশে ১৮০টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল অভ্যন্তরীণ কেব্ল নেটওয়ার্কে যুক্ত করা হয়েছে, যার জন্য কোনো অর্থ দিতে হয় না। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, এনডিটিভি, ডিডব্লিউ, ভোয়া, ফ্রান্স ২৪, এনজিএম, টিভিকিউ, বিএনটি, কার্টুন নেটওয়ার্ক, আরএজে। ভারতও বিশ্বের অধিকাংশ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক টিভি চ্যানেল অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছে। ব্যতিক্রম বাংলাদেশের চ্যানেল।
ভারতের নীতিনির্ধারকেরা বরাবর বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলে বন্ধুত্ব ও মৈত্রী কী করে হবে? স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে এই মুহূর্তে (এমনকি তিস্তার পানি চুক্তি সই না হওয়া সত্ত্বেও) বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত বিএনপির নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। এখন ভারতীয় নেতৃত্বই ঠিক করবেন, তাঁরা এই সর্বনিম্ন পর্যায়কে কাজে লাগিয়ে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করবেন, না দুয়ার এঁটে বসে থাকবেন?
আমরা চাই, বাংলাদেশের আকাশ সব দেশের জন্য মুক্ত থাকুক। ভারতের আকাশও বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হোক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে।’
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohৎab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.