মধ্যপ্রাচ্য-ইসরায়েল কি ইরান আক্রমণ করবে? by মশিউল আলম
গত শতকের নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ করে আসছে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এখন এই সন্দেহ আরও গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি সৌদি আরবের বাদশারও আশঙ্কা, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
২০০৮ সালের ২০ এপ্রিল রিয়াদের মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের সদর দপ্তরে পাঠানো একটি গোপন তারবার্তা থেকে জানা যায়, সৌদি বাদশা আবদুল্লাহ ইরানে হামলা করে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন অনেক বার। যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি রাষ্ট্রদূত আল জুবায়েরও রিয়াদে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মাইকেল জিফয়েলারকে বলেছেন, ‘সাপের মাথাটি কেটে ফেলার জন্য বাদশা আপনাদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা এখনো চালায়নি; কিন্তু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিলম্বিত করার বা বন্ধ করে দেওয়ার উপায় খুঁজছে। ইরান বলে আসছে, তারা পরমাণুকেন্দ্র স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসাক্ষেত্রের মতো বেসামরিক কাজের জন্য, বোমা তৈরির কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। দেশটি এখন একটি পরমাণুকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চালাচ্ছে কয়েকটিতে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা নিয়ে মূলত আপত্তি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাঁচ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানিই যথেষ্ট। কিন্তু ইরান তাদের অন্তত দুটি কেন্দ্রে ২০ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন করছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, তাদের কাছে তথ্য আছে যে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে এমন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, যা করা হয় সাধারণত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে। ফলে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে বলে সংস্থাটির মনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাটির প্রধান পরিদর্শক হেরম্যান নেকার্টসের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি পরিদর্শক দল গত সপ্তাহে তিন দিনের জন্য ইরান সফরে গিয়েছিল। কিন্তু সফর শেষে ভিয়েনায় ফিরে নেক্যার্টস বলেছেন, ইরান তাঁদের তেমন সহযোগিতা করেনি, পরিদর্শন সফল হয়নি। এ মাসের ২১-২২ তারিখে তাঁরা আবার ইরানের পরমাণু কর্মসূচিগুলো পরিদর্শন করতে দেশটিতে যাবেন।
পরমাণু পরিদর্শক দলের এই সফরটি ঘটে ইরানের কথিত ‘পরমাণু উচ্চাভিলাষ’কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির তিক্ততা সম্প্রতি বেড়ে ওঠার পটভূমিতে। জানুয়ারির প্রথম দিকে ইরান ঘোষণা করে, তারা ফোর্দো পরমাণু স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করেছে। পাহাড়ের মধ্যে স্থাপিত ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি যেকোনো ধরনের সামরিক আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত বলে বিবিসি-সিএনএনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে। ইরান প্রথমে বলে, ওই কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা বলেছে, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে (২০ শতাংশ পর্যন্ত)। এতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্ষেপে গিয়ে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অর্থব্যবস্থার ওপর অবরোধ কঠোরতর করার হুমকি দিয়েছে। ইরানের পাল্টা হুমকি: হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পারস্য উপসাগরীয় পথ ধরে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচলের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথটি (বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহন হয়) বন্ধ হয়ে গেলে তেলের বাজারে বিরাট সমস্যা দেখা দেবে। আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা তাই বলছে, ইরানকে তারা কোনোভাবেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে দেবে না, প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপ নেবে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ইসরায়েলের। এই দেশটির নেতারা মনে করেন, ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, তাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের সর্বশেষ জানা তথ্য হলো, ইরানের হাতে বর্তমানে আছে প্রায় চার টন নিম্নমানের (অসমৃদ্ধ) ইউরেনিয়াম। ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আছে ১০০ কিলোগ্রাম; ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করলে তা থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যাবে চারটি। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল আভিভ কোচাভির সাম্প্রতিক এক মন্তব্য এ রকম: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ্ খামেনি যদি নির্দেশ দেন, তাহলে প্রথম পারমাণবিক বোমাটির মালিক হতে ইরানের সময় লাগবে এক বছর, আর পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরি করতে লাগবে বছর দুয়েক। সুপরিচিত পরমাণু বিশেষজ্ঞ ডেভিড অলব্রাইডের প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির (আইএসআইএস) তথ্য হচ্ছে, ২০১২ সালের মধ্যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নেবে না। প্রথমত, পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপযোগী মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পর্যাপ্ত সামর্থ্য এখনো ইরানের নেই; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অবরোধ, ইসরায়েলের দিক থেকে সামরিক আক্রমণের আশঙ্কা ইত্যাদি নানা কিছু বিবেচনা করে ইরান সেই ঝুঁকি নিতে এখনো যাচ্ছে না। ইরানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ চলছে এবং তার মাশুল ইরানকে গুনতে হচ্ছে, দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়ে ১৬ শতাংশে উঠেছে, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ২৪ শতাংশ, গড় প্রবৃদ্ধি বস্তুত থেমে গিয়েছে। (এসব তথ্য ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সূত্রের।) এ রকম পরিস্থিতিতে ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনাটি পিছিয়ে দেবে।
কিন্তু ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে যে ইরানকে এখনই থামাতে হবে। তারা বলছে, ইরানকে আর সময় দেওয়া যাবে না, কারণ সময় দিলে এমন এক দিন আসবে যখন দেশটির বিরুদ্ধে করার আর কিছুই থাকবে না। মানে, মাত্র একটা পারমাণবিক বোমাও যদি ইরান বানিয়ে ফেলে, তাহলে আর তাকে স্পর্শ করা যাবে না। ইসরায়েলের উপপ্রধানমন্ত্রী ও কৌশলগত বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রী মোশে ইয়ালোন সম্প্রতি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হলে তা হবে মুক্ত বিশ্ব ও আরব জাহানের জন্য বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের ব্যাপার এবং অবশ্যই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য বিরাট এক হুমকি। তখন ইরান আরব অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব ফলাবে, সেসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাবে, হামলা বেড়ে যাবে ইসরায়েল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপরও; এবং সবচেয়ে বেশি হামলা হবে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর।
তাই ইসরায়েল চায়, এখনই সামরিক হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হোক ইরানের সবগুলো পরমাণু প্রকল্প। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা হলো, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরানের পরমাণু প্রকল্পগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার মতো প্রথাগত (অপারমাণবিক) অস্ত্রশস্ত্র পেন্টাগনের নেই। ইসরায়েলি উপপ্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য নাকচ করে দিতে বললেন, সামরিক আক্রমণ চালিয়ে ইরানের সবগুলো পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়া অবশ্যই সম্ভব।
বহুজাতিকভাবে যদি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ইসরায়েল একাই ইরানে হামলা চালাতে চায়। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে ইসরায়েলের পক্ষে থাকতে হবে। এই সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ইসরায়েলের ও ইউরোপ-আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে জোর প্রচারণা চলছে। ইসরায়েলি সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান গত ২৫ জানুয়ারি নিউইর্য়ক টাইমস-এ এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের তিনটি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। এগুলোর ওপর নির্ভর করছে ইরানের ব্যাপারে ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত কী হবে। এক. ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াটিকে ধ্বংস বা বিলম্বিত করার সামরিক শক্তি-সামর্থ্য কি ইসরায়েলের আছে? এবং ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ চালালে ইরান যে পাল্টা আঘাত হানবে, তা মোকাবিলার সামর্থ্য কি ইসরায়েলের আছে? দুই. ইরানের ওপর আক্রমণ চালানোর পক্ষে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর কি সমর্থন আছে? এবং তিন. ইরানের দিক থেকে যে পারমাণবিক হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার সম্ভাব্য সবগুলো বিকল্প পথ কি শেষ হয়ে গেছে? ইরানে সামরিক আক্রমণ চালানো ছাড়া আর কোনো বিকল্পই কি অবশিষ্ট নেই? যদি কোনো বিকল্প না থাকে, তবে কি আক্রমণ চালানোর সর্বশেষ সুযোগ এখনই?
ইসরায়েলের ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের বরাত দিয়ে রনেন বার্গম্যান বলছেন, এই তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘হ্যাঁ’। কিন্তু এই উত্তর নিশ্চয়ই ভুল। খোদ ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাই বলছে: ইসরায়েলের দিকে দুই লাখ মিসাইল তাক করে রেখেছে ইরান। আর সর্বশেষ গত শুক্রবার দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দৃঢ় কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন: ইসরায়েল হামলা চালালে তার পাল্টা জবাব দেওয়ার সামর্থ্য ইরানের আছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা এখনো চালায়নি; কিন্তু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিলম্বিত করার বা বন্ধ করে দেওয়ার উপায় খুঁজছে। ইরান বলে আসছে, তারা পরমাণুকেন্দ্র স্থাপন করেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসাক্ষেত্রের মতো বেসামরিক কাজের জন্য, বোমা তৈরির কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। দেশটি এখন একটি পরমাণুকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ চালাচ্ছে কয়েকটিতে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহূত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা নিয়ে মূলত আপত্তি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাঁচ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানিই যথেষ্ট। কিন্তু ইরান তাদের অন্তত দুটি কেন্দ্রে ২০ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন করছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে, তাদের কাছে তথ্য আছে যে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচিতে এমন কিছু বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, যা করা হয় সাধারণত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে। ফলে ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে বলে সংস্থাটির মনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাটির প্রধান পরিদর্শক হেরম্যান নেকার্টসের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি পরিদর্শক দল গত সপ্তাহে তিন দিনের জন্য ইরান সফরে গিয়েছিল। কিন্তু সফর শেষে ভিয়েনায় ফিরে নেক্যার্টস বলেছেন, ইরান তাঁদের তেমন সহযোগিতা করেনি, পরিদর্শন সফল হয়নি। এ মাসের ২১-২২ তারিখে তাঁরা আবার ইরানের পরমাণু কর্মসূচিগুলো পরিদর্শন করতে দেশটিতে যাবেন।
পরমাণু পরিদর্শক দলের এই সফরটি ঘটে ইরানের কথিত ‘পরমাণু উচ্চাভিলাষ’কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির তিক্ততা সম্প্রতি বেড়ে ওঠার পটভূমিতে। জানুয়ারির প্রথম দিকে ইরান ঘোষণা করে, তারা ফোর্দো পরমাণু স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করেছে। পাহাড়ের মধ্যে স্থাপিত ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রটি যেকোনো ধরনের সামরিক আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত বলে বিবিসি-সিএনএনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে। ইরান প্রথমে বলে, ওই কেন্দ্রে পাঁচ শতাংশ ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি তারা বলেছে, চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহারের সমৃদ্ধকরণের মাত্রা বাড়াতে হয়েছে (২০ শতাংশ পর্যন্ত)। এতে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ক্ষেপে গিয়ে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ অর্থব্যবস্থার ওপর অবরোধ কঠোরতর করার হুমকি দিয়েছে। ইরানের পাল্টা হুমকি: হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়া হবে। পারস্য উপসাগরীয় পথ ধরে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ চলাচলের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথটি (বিশ্বের ২০ শতাংশ জ্বালানি তেল পরিবহন হয়) বন্ধ হয়ে গেলে তেলের বাজারে বিরাট সমস্যা দেখা দেবে। আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা তাই বলছে, ইরানকে তারা কোনোভাবেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করতে দেবে না, প্রয়োজনে সামরিক পদক্ষেপ নেবে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ইসরায়েলের। এই দেশটির নেতারা মনে করেন, ইরান ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, তাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দাদের সর্বশেষ জানা তথ্য হলো, ইরানের হাতে বর্তমানে আছে প্রায় চার টন নিম্নমানের (অসমৃদ্ধ) ইউরেনিয়াম। ২০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আছে ১০০ কিলোগ্রাম; ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করলে তা থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যাবে চারটি। ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান মেজর জেনারেল আভিভ কোচাভির সাম্প্রতিক এক মন্তব্য এ রকম: ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ্ খামেনি যদি নির্দেশ দেন, তাহলে প্রথম পারমাণবিক বোমাটির মালিক হতে ইরানের সময় লাগবে এক বছর, আর পারমাণবিক ওয়ারহেড তৈরি করতে লাগবে বছর দুয়েক। সুপরিচিত পরমাণু বিশেষজ্ঞ ডেভিড অলব্রাইডের প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির (আইএসআইএস) তথ্য হচ্ছে, ২০১২ সালের মধ্যে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নেবে না। প্রথমত, পরমাণু অস্ত্র তৈরির উপযোগী মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পর্যাপ্ত সামর্থ্য এখনো ইরানের নেই; দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক অবরোধ, ইসরায়েলের দিক থেকে সামরিক আক্রমণের আশঙ্কা ইত্যাদি নানা কিছু বিবেচনা করে ইরান সেই ঝুঁকি নিতে এখনো যাচ্ছে না। ইরানের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ চলছে এবং তার মাশুল ইরানকে গুনতে হচ্ছে, দেশটিতে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়ে ১৬ শতাংশে উঠেছে, বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার এখন ২৪ শতাংশ, গড় প্রবৃদ্ধি বস্তুত থেমে গিয়েছে। (এসব তথ্য ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সূত্রের।) এ রকম পরিস্থিতিতে ইরান হয়তো পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পরিকল্পনাটি পিছিয়ে দেবে।
কিন্তু ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মহলের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে যে ইরানকে এখনই থামাতে হবে। তারা বলছে, ইরানকে আর সময় দেওয়া যাবে না, কারণ সময় দিলে এমন এক দিন আসবে যখন দেশটির বিরুদ্ধে করার আর কিছুই থাকবে না। মানে, মাত্র একটা পারমাণবিক বোমাও যদি ইরান বানিয়ে ফেলে, তাহলে আর তাকে স্পর্শ করা যাবে না। ইসরায়েলের উপপ্রধানমন্ত্রী ও কৌশলগত বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রী মোশে ইয়ালোন সম্প্রতি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হলে তা হবে মুক্ত বিশ্ব ও আরব জাহানের জন্য বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের ব্যাপার এবং অবশ্যই ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্য বিরাট এক হুমকি। তখন ইরান আরব অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর ওপর কর্তৃত্ব ফলাবে, সেসব দেশের ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাবে, হামলা বেড়ে যাবে ইসরায়েল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপরও; এবং সবচেয়ে বেশি হামলা হবে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর।
তাই ইসরায়েল চায়, এখনই সামরিক হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হোক ইরানের সবগুলো পরমাণু প্রকল্প। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক আগে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা হলো, মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইরানের পরমাণু প্রকল্পগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার মতো প্রথাগত (অপারমাণবিক) অস্ত্রশস্ত্র পেন্টাগনের নেই। ইসরায়েলি উপপ্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্য নাকচ করে দিতে বললেন, সামরিক আক্রমণ চালিয়ে ইরানের সবগুলো পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে দেওয়া অবশ্যই সম্ভব।
বহুজাতিকভাবে যদি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ইসরায়েল একাই ইরানে হামলা চালাতে চায়। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে ইসরায়েলের পক্ষে থাকতে হবে। এই সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ইসরায়েলের ও ইউরোপ-আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে জোর প্রচারণা চলছে। ইসরায়েলি সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান গত ২৫ জানুয়ারি নিউইর্য়ক টাইমস-এ এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের তিনটি প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। এগুলোর ওপর নির্ভর করছে ইরানের ব্যাপারে ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত কী হবে। এক. ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রক্রিয়াটিকে ধ্বংস বা বিলম্বিত করার সামরিক শক্তি-সামর্থ্য কি ইসরায়েলের আছে? এবং ইসরায়েল ইরানে আক্রমণ চালালে ইরান যে পাল্টা আঘাত হানবে, তা মোকাবিলার সামর্থ্য কি ইসরায়েলের আছে? দুই. ইরানের ওপর আক্রমণ চালানোর পক্ষে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলোর কি সমর্থন আছে? এবং তিন. ইরানের দিক থেকে যে পারমাণবিক হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করার সম্ভাব্য সবগুলো বিকল্প পথ কি শেষ হয়ে গেছে? ইরানে সামরিক আক্রমণ চালানো ছাড়া আর কোনো বিকল্পই কি অবশিষ্ট নেই? যদি কোনো বিকল্প না থাকে, তবে কি আক্রমণ চালানোর সর্বশেষ সুযোগ এখনই?
ইসরায়েলের ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের বরাত দিয়ে রনেন বার্গম্যান বলছেন, এই তিনটি প্রশ্নেরই উত্তর ‘হ্যাঁ’। কিন্তু এই উত্তর নিশ্চয়ই ভুল। খোদ ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাই বলছে: ইসরায়েলের দিকে দুই লাখ মিসাইল তাক করে রেখেছে ইরান। আর সর্বশেষ গত শুক্রবার দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দৃঢ় কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন: ইসরায়েল হামলা চালালে তার পাল্টা জবাব দেওয়ার সামর্থ্য ইরানের আছে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments