চারদিক-চলচ্চিত্রে আলোকিত চ্যানেল আই
দুজন দুরন্ত তরুণ, অকপট। দুঃসাহসী, গভীর মননশীল। ধীমান ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত দুই তরুণ এই চ্যানেল আইয়ের জন্ম দেয়। একজন ফরিদুর রেজা সাগর। আমার যখনই সাগরের সঙ্গে দেখা হয়, তখনই তার বাবা চলচ্চিত্রকার ফজলুল হক সাহেবের কথা মনে পড়ে যায়।
আমি যাঁদের কাছ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতি শিখেছি, ফজলুল হক সাহেব তাঁদের একজন। আরেকজন ুুনিঃশব্দ গনগনে আগুনের মতো তরুণ—শাইখ সিরাজ, যার রক্তে রক্তে বাংলার ধান-পাটের গন্ধ ঘুরে বেড়ায়। তেপান্তরের কৃষকেরা যেন তাকে বাউলের সুরে সুরে সারা দিনই ডাকে। আমি তো চ্যানেল আই পরিবারের একজন সদস্য। তাই ওদের এই এক যুগ পূর্তির শুভমুহূর্তে শুধু আশীর্বাদ করতে পারি।
চ্যানেল আইয়ের চলচ্চিত্র নিয়ে লিখছি। যে ফুলটা আজ গন্ধ ছড়াচ্ছে, যার সৌরভ নিয়ে উতলা বাতাস দেশ-বিদেশে যাচ্ছে, সেই গাছটার জন্ম এবং পরিশ্রম আর পরিচর্যার কথা জানাচ্ছি। জন্মপরিচয়টা জানতে পারলে মানুষ খুশি হয়। চ্যানেল আইয়ের এক যুগ হয়ে যাওয়ার ইতিহাসটা জানতে পারেন।
বছর পঞ্চাশ ধরে আমি চলচ্চিত্রে কাজ করছি। চলচ্চিত্রের বহু রকম উত্থান-পতন নিজের চোখে দেখেছি। এত দিন তো মুম্বাইয়ের নকল ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ‘আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র’ বানাতাম। শেষ পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গেলাম অশ্লীল ছবির রমরমা ব্যবসা দেখে। যাঁরা সুস্থ চিন্তার প্রযোজক-পরিচালক ছিলেন, তাঁরা বন্ধ করে দিলেন চলচ্চিত্রের ব্যবসা।
চলচ্চিত্র এমন একটা বড় গণমাধ্যম, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সৃষ্টির উন্মাদনা থাকলে একটি চলচ্চিত্রই গোটা সমাজকে বদলে ফেলতে পারে। সেই উদাহরণ আমাদের দেশে আছে—আমার দেখা জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া।
আবার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন করে নষ্ট বুড়িগঙ্গার পানির মতো দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে চতুর্দিকে। তা-ই হলো, অশ্লীল ছবির ভয়ে দর্শক পারিবারিক সিনেমা হলে আসা বন্ধ করে দিল। সিনেমার কথা শুনলেই পরিবারের মানুষ চমকে ওঠে। নাকে রুমাল দেয়। গিন্নি থু থু ফেলে। অথচ সরকারের সেন্সর সার্টিফিকেট নিয়েই এসব চলছে। চলচ্চিত্রের মানুষ দুই ভাগ হয়ে গেল। যাঁরা গুণী সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব, তাঁরা ছবি বানানো বন্ধ করে দিলেন। আন্দোলন শুরু করলেন। মিছিল নিয়ে পথে নামলেন।
আমরা তখন বেকার। কোনো কোনো পত্রিকায় আমাকে লিখতে হচ্ছে, চলচ্চিত্রজগৎ এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। আবার কোনো পত্রিকায় লিখছি, চলচ্চিত্র এখন জরা-ব্যাধিতে শয্যাশায়িত, মুমূর্ষু। অভিভাবক নেই। অস্থির রাজনীতির দুর্নীতির চোখে চলচ্চিত্রের এই দুরবস্থা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতির দৃষ্টি এখন লুটপাটের দিকে, কী হচ্ছে চলচ্চিত্রে তার কোনো খবরই রাখতে পারছে না। ঠিক এই চলচ্চিত্রের মেঘলা রঙের শেষ বিকেলে এসে নামল দুঃসাহসী সেই দুই যুবক—ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। উচ্চস্বরে ঘোষণা দিল, আমরা, মানে চ্যানেল আই এখন ছবি বানাবে।
চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে দিয়ে শুরু হলো চ্যানেল আইয়ের ছবি। তারপর চাষী নজরুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং আমিসহ অনেকেই নির্মাণ করতে লাগলাম ছবি। কি গ্রামে, কি শহরে—একধরনের মানুষ আছে, যারা কখনো কারোর ভালো চায় না, সব ব্যাপারেই ফোঁড়ন কাটে। আমাদের চলচ্চিত্রে এ রকম লোকের সংখ্যা বেশি। তারা বাঁকা মুখে বলতে লাগল, আমরা নাকি চ্যানেল আইয়ের চামচামি করছি। একের পর এক যখন নতুন নতুন নাম ঘোষণা হচ্ছে চ্যানেল আইতে, তখন আবার ওই দুর্মুখগুলো এসেই অনুরোধ করছে, আমি তো বেকার, আমাকে একটা ছবি দিতে বলেন না! ইতিমধ্যে অশ্লীল ছবি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার শুরু হয়েছে ‘পাইরেসি’, ছবি রিলিজ করার এক মাসের মধ্যেই ক্যাসেট হয়ে চলে যাচ্ছে সারা বাংলাদেশে।
ভয়ংকর অবস্থা। অশ্লীল ছবির ভয়ে মানুষ সিনেমা হলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় বসে এখন পাইরেসি করা ছবির ক্যাসেট দেখে। হলে লোক নেই। প্রযোজকেরা অফিস প্রায় বন্ধ রেখেছেন। এফডিসিতে ছবি কমে গেছে। শাকিব ছাড়া কোনো ছবির শুটিং হয় না। ফ্লোরগুলো খালি পড়ে থাকে। এফডিসি বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপন সংস্থা কিংবা এনটিভি অথবা অন্য কোনো টিভিকে ফ্লোর ভাড়া দিচ্ছে। এই হলো চলচ্চিত্রজগতের অবস্থা। এ রকম অবস্থার ভেতরেও অসম্ভবের পা কেটে দিয়ে চ্যানেল আই একের পর এক ছবি বানাচ্ছে। সেই সব ছবিতে পয়সা তো পাচ্ছেই, আবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাচ্ছে প্রতিবছর। শুধু দেশে নয়, চ্যানেল আইয়ের ছবি বিদেশ থেকেও পুরস্কার আনছে বছর বছর।
এই চ্যানেল আইয়ের বদৌলতেই এফডিসির অবস্থা এখন একটু ভালো। এফডিসির এমডি সাহেবের সবচেয়ে বড় প্রযোজক হলো চ্যানেল আই। আপনারা শুনে অবাক হবেন, মাত্র এই চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই চ্যানেল আই ছবি বানিয়েছে ষাটের অধিক। ১৯৫৬ সালে মুখ ও মুখোশ ছবি প্রথম মুক্তি পায় এফডিসি থেকে। তারপর আজ পর্যন্ত কি কোনো প্রযোজক এত স্বল্প সময়ে এতগুলো ছবি বানিয়েছেন কখনো?
ফরিদুর রেজা সাগর আর শাইখ সিরাজ এই ৪০ বছরে কোনো রাজনীতিবিদ যা পারেনি, তা করেছে। ৬৮ হাজার গ্রামের কৃষকদের বন্ধু হয়ে বেঁচে আছে শাইখ সিরাজ। ফরিদুর রেজা সাগর ক্ষুধার্ত শয্যাশায়ী চলচ্চিত্রকে আবার আস্তে আস্তে দাঁড় করাচ্ছে। এই দুজন মানুষের পেছনে অবশ্যই তাদের প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম রয়েছে। তাই এই মানুষ দুটিকে সম্মানিত করলে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পরিবারের সবাই সম্মানিত হবে।
আমজাদ হোসেন
চ্যানেল আইয়ের চলচ্চিত্র নিয়ে লিখছি। যে ফুলটা আজ গন্ধ ছড়াচ্ছে, যার সৌরভ নিয়ে উতলা বাতাস দেশ-বিদেশে যাচ্ছে, সেই গাছটার জন্ম এবং পরিশ্রম আর পরিচর্যার কথা জানাচ্ছি। জন্মপরিচয়টা জানতে পারলে মানুষ খুশি হয়। চ্যানেল আইয়ের এক যুগ হয়ে যাওয়ার ইতিহাসটা জানতে পারেন।
বছর পঞ্চাশ ধরে আমি চলচ্চিত্রে কাজ করছি। চলচ্চিত্রের বহু রকম উত্থান-পতন নিজের চোখে দেখেছি। এত দিন তো মুম্বাইয়ের নকল ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ‘আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র’ বানাতাম। শেষ পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গেলাম অশ্লীল ছবির রমরমা ব্যবসা দেখে। যাঁরা সুস্থ চিন্তার প্রযোজক-পরিচালক ছিলেন, তাঁরা বন্ধ করে দিলেন চলচ্চিত্রের ব্যবসা।
চলচ্চিত্র এমন একটা বড় গণমাধ্যম, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং সৃষ্টির উন্মাদনা থাকলে একটি চলচ্চিত্রই গোটা সমাজকে বদলে ফেলতে পারে। সেই উদাহরণ আমাদের দেশে আছে—আমার দেখা জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়া।
আবার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন করে নষ্ট বুড়িগঙ্গার পানির মতো দুর্গন্ধ ছড়াতে পারে চতুর্দিকে। তা-ই হলো, অশ্লীল ছবির ভয়ে দর্শক পারিবারিক সিনেমা হলে আসা বন্ধ করে দিল। সিনেমার কথা শুনলেই পরিবারের মানুষ চমকে ওঠে। নাকে রুমাল দেয়। গিন্নি থু থু ফেলে। অথচ সরকারের সেন্সর সার্টিফিকেট নিয়েই এসব চলছে। চলচ্চিত্রের মানুষ দুই ভাগ হয়ে গেল। যাঁরা গুণী সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব, তাঁরা ছবি বানানো বন্ধ করে দিলেন। আন্দোলন শুরু করলেন। মিছিল নিয়ে পথে নামলেন।
আমরা তখন বেকার। কোনো কোনো পত্রিকায় আমাকে লিখতে হচ্ছে, চলচ্চিত্রজগৎ এখন ধ্বংসের মুখোমুখি। আবার কোনো পত্রিকায় লিখছি, চলচ্চিত্র এখন জরা-ব্যাধিতে শয্যাশায়িত, মুমূর্ষু। অভিভাবক নেই। অস্থির রাজনীতির দুর্নীতির চোখে চলচ্চিত্রের এই দুরবস্থা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতির দৃষ্টি এখন লুটপাটের দিকে, কী হচ্ছে চলচ্চিত্রে তার কোনো খবরই রাখতে পারছে না। ঠিক এই চলচ্চিত্রের মেঘলা রঙের শেষ বিকেলে এসে নামল দুঃসাহসী সেই দুই যুবক—ফরিদুর রেজা সাগর ও শাইখ সিরাজ। উচ্চস্বরে ঘোষণা দিল, আমরা, মানে চ্যানেল আই এখন ছবি বানাবে।
চিত্রনায়িকা মৌসুমীকে দিয়ে শুরু হলো চ্যানেল আইয়ের ছবি। তারপর চাষী নজরুল ইসলাম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং আমিসহ অনেকেই নির্মাণ করতে লাগলাম ছবি। কি গ্রামে, কি শহরে—একধরনের মানুষ আছে, যারা কখনো কারোর ভালো চায় না, সব ব্যাপারেই ফোঁড়ন কাটে। আমাদের চলচ্চিত্রে এ রকম লোকের সংখ্যা বেশি। তারা বাঁকা মুখে বলতে লাগল, আমরা নাকি চ্যানেল আইয়ের চামচামি করছি। একের পর এক যখন নতুন নতুন নাম ঘোষণা হচ্ছে চ্যানেল আইতে, তখন আবার ওই দুর্মুখগুলো এসেই অনুরোধ করছে, আমি তো বেকার, আমাকে একটা ছবি দিতে বলেন না! ইতিমধ্যে অশ্লীল ছবি বন্ধ হয়ে গেছে। আবার শুরু হয়েছে ‘পাইরেসি’, ছবি রিলিজ করার এক মাসের মধ্যেই ক্যাসেট হয়ে চলে যাচ্ছে সারা বাংলাদেশে।
ভয়ংকর অবস্থা। অশ্লীল ছবির ভয়ে মানুষ সিনেমা হলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। বাসায় বসে এখন পাইরেসি করা ছবির ক্যাসেট দেখে। হলে লোক নেই। প্রযোজকেরা অফিস প্রায় বন্ধ রেখেছেন। এফডিসিতে ছবি কমে গেছে। শাকিব ছাড়া কোনো ছবির শুটিং হয় না। ফ্লোরগুলো খালি পড়ে থাকে। এফডিসি বাধ্য হয়ে বিজ্ঞাপন সংস্থা কিংবা এনটিভি অথবা অন্য কোনো টিভিকে ফ্লোর ভাড়া দিচ্ছে। এই হলো চলচ্চিত্রজগতের অবস্থা। এ রকম অবস্থার ভেতরেও অসম্ভবের পা কেটে দিয়ে চ্যানেল আই একের পর এক ছবি বানাচ্ছে। সেই সব ছবিতে পয়সা তো পাচ্ছেই, আবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাচ্ছে প্রতিবছর। শুধু দেশে নয়, চ্যানেল আইয়ের ছবি বিদেশ থেকেও পুরস্কার আনছে বছর বছর।
এই চ্যানেল আইয়ের বদৌলতেই এফডিসির অবস্থা এখন একটু ভালো। এফডিসির এমডি সাহেবের সবচেয়ে বড় প্রযোজক হলো চ্যানেল আই। আপনারা শুনে অবাক হবেন, মাত্র এই চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই চ্যানেল আই ছবি বানিয়েছে ষাটের অধিক। ১৯৫৬ সালে মুখ ও মুখোশ ছবি প্রথম মুক্তি পায় এফডিসি থেকে। তারপর আজ পর্যন্ত কি কোনো প্রযোজক এত স্বল্প সময়ে এতগুলো ছবি বানিয়েছেন কখনো?
ফরিদুর রেজা সাগর আর শাইখ সিরাজ এই ৪০ বছরে কোনো রাজনীতিবিদ যা পারেনি, তা করেছে। ৬৮ হাজার গ্রামের কৃষকদের বন্ধু হয়ে বেঁচে আছে শাইখ সিরাজ। ফরিদুর রেজা সাগর ক্ষুধার্ত শয্যাশায়ী চলচ্চিত্রকে আবার আস্তে আস্তে দাঁড় করাচ্ছে। এই দুজন মানুষের পেছনে অবশ্যই তাদের প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম রয়েছে। তাই এই মানুষ দুটিকে সম্মানিত করলে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম পরিবারের সবাই সম্মানিত হবে।
আমজাদ হোসেন
No comments