কলকাতার চিঠি-কলকাতার বনেদিবাড়ির দুর্গাপূজা by অমর সাহা
কলকাতা এখন শারদীয় উৎসবের আনন্দে ভাসছে। চারদিকে শুধু উৎসবের ঢেউ। চারদিকে আলোর রোশনাই। উৎসব দিকে দিকে। এবার কলকাতায় সর্বজনীন পূজা হচ্ছে দুই হাজার ৩৬৯টি। গত বছরের তুলনায় ১৬৫টি বেশি। এবারও কলকাতায় এই শারদোৎসব ঘিরে আনন্দের ঘাটতি নেই; বৈচিত্র্যের অভাব নেই। চলছে থিমের লড়াই।
কলকাতার শারদীয় উৎসব আজ গোটা বিশ্বে অন্যতম সেরা উৎসব হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। এই উৎসব দেখতে এখনো ভারতের বিভিন্ন রাজ্য আর দেশ-বিদেশের মানুষ এসে জড় হয় কলকাতায়। আর এই উৎসবে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ আসে কলকাতায়; হয় উৎসবের ভাগিদার। শুধু কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি এই উৎসবের আনন্দে মেতেছে ভারতের রাজধানী দিল্লি, মুম্বাইসহ ত্রিপুরা, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, উত্তর প্রদেশ, আসাম, মেঘালয় রাজ্যের বাঙালি হিন্দুরা।
এই উৎসবের ব্যাপ্তি এখন সর্বজনীন পূজার পরিমণ্ডল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বনেদিবাড়ির পূজায়ও। এই পূজার আয়োজন যেমন ব্যাপক, তেমনি খরচের বহরও বিশাল। ফলে লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মতো এই পূজা বাড়ি বাড়ি হয় না। সাবেকি আমল থেকেই এই পূজা সাধারণত রাজা, জমিদার আর বনেদিবাড়ির আঙিনাতেই হয়ে আসছে। পরে অবশ্য এই পূজা সর্বজনীন রূপ নেয়। তাই কলকাতার সেই সাবেকি বনেদিবাড়ির পূজা এখনো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নি; মানুষও এখন ভিড় করছে বনেদিবাড়ির পূজা দেখতে।
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, কলকাতায় মাটির দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয় দক্ষিণ কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়িতে, সেই ১৬১০ সালে। এই বংশের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরে। রাজা মানসিংহের কাছ থেকে জমিদারি পাওয়ার পর তিনি হন সাবর্ণ রায় চৌধুরী। বড়িশায় ছিল তাঁর কাছারিবাড়ি। এই বাড়িতেই তিনি ১৬১০ সালে শুরু করেন প্রথম দুর্গাপূজা। সেই থেকে ৪০০ বছর ধরে এই বাড়ির আটচালা মণ্ডপে চলছে এই দুর্গাপূজা। প্রতিমার একদিকে এখনো রামের মূর্তি, অন্যদিকে শিবের মূর্তি থাকে। এই মণ্ডপের সামনে ছিল দুর্গাদালান নাটমন্দির। সেটি আজ জীর্ণদশাপ্রাপ্ত। কেবল ছাদবিহীন কয়েকটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে।
আবার ১৭৬০ সালে কলকাতার বড়বাজার এলাকার দর্জিপাড়ার দাঁ-বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন রামনারায়ণ দাঁ। এই বাড়ির পূজা দেখতে সেদিন লর্ড ক্লাইভও এসেছিলেন। দাঁ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম দাঁ বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন দর্জিপাড়ায়। তারপর শুরু করেছিলেন বড়বাজারে মশলার ব্যবসা। তাঁর পুত্র রামনারায়ণ শুরু করেন দুর্গাপূজা।
বরাহনগরের দত্তবাড়ির পূজার সূচনা করেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা পরশুরাম দত্তের পৌত্র জানকী রাম, সেই ১৭৭৪ সালে। পরশুরাম হুগলির সপ্তগ্রাম থেকে কলকাতার বরাহনগরে এসে বসতি করেছিলেন। এখানে তৈরি হয়েছিল দুর্গামণ্ডপ ও ঠাকুর দালান।
১৭৭৫ সালে কলকাতার বিডন স্ট্রিটে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন রামদুলাল দে সরকার। রামদুলালের দুই পুত্র ছিলেন সাতুবাবু ও লাটুবাবু। সাতুবাবু ছিলেন সেতারবাদক আর লাটুবাবু ছিলেন পালোয়ান। আজও এই পূজা সাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা হিসেবে খ্যাত।
উত্তর কলকাতার মিত্রবাড়ির পূজার সূচনা করেন নীলমণি মিত্রের পৌত্র রাধাকৃষ্ণ মিত্র ১৮০৭ সালে। মধ্য কলকাতার ঠনঠনিয়া দত্তবাড়ির পূজা শুরু করেন এই বংশের পূর্বপুরুষ দ্বারকানাথ দত্ত ১৮৫৫ সালে। জোড়াসাঁকোর চন্দ্র দাঁর বাড়ির পূজা শুরু হয় ১৮৫৯ সালে। কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের এই বাড়ির পূজা শুরু করেছিলেন এই বংশের পূর্বপুরুষ নরসিংহ দত্ত দাঁ। তিনি ছিলেন আবার কলকাতার প্রখ্যাত বন্দুক ব্যবসায়ী। তিনিই কলকাতায় বন্দুকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এন সি দাঁ অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
মধ্য কলকাতার বউবাজারের নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের গণেশ চন্দ্রের বাড়ির দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন গণেশ চন্দ্র, সেই ১৮৭৭ সালে। গণেশ চন্দ্র ছিলেন একজন নামী আইনজীবী। তাঁর নামে কলকাতায় আছে গণেশচন্দ্র এভিনিউ। গণেশচন্দ্রের নাতি ছিলেন স্বাধীনতাযোদ্ধা নির্মল চন্দ্র। তাঁর নামেও সড়ক আছে। এই বাড়িতে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, সরোজিনী নাইডু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ বিশিষ্টজন। উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের অমৃতলাল দাঁর বাড়ির দুর্গাপূজা শুরু করেন এই বংশের পূর্বপুরুষ অমৃতলাল দাঁ। ১৮৮৩ সালে। আবার দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ির দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেছিলেন সুরেন্দ্র মাধব মল্লিক। সেই ১৯২৫ সালে। সুরেন্দ্র মাধব ছিলেন টালিউড তারকা রঞ্জিত মল্লিকের ঠাকুরদা। এখন এই পূজা রঞ্জিত মল্লিকের পূজা বলে পরিচিত।
এ তো গেল কলকাতার নামীদামি বনেদিবাড়ির পূজার কথা। আর সর্বজনীন পূজার তো শেষ নেই কলকাতায়। এবার এই সর্বজনীন পূজা হচ্ছে দুই হাজার ৩৬৯টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূজা হচ্ছে বাগবাজার সর্বজনীন, টালাপার্ক সর্বজনীন, কুমারটুলি সর্বজনীন, আহিরীটোলা সর্বজনীন, শোভাবাজার সর্বজনীন, কালীঘাট মিলন সংঘ, কলেজ স্কয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক, সন্তোষ মিত্র স্কয়ার, শিয়ালদহ রেলওয়ে অ্যাথলেটিক, একডালিয়া এভারগ্রিন, সিংহী পার্ক, সেলিমপুর পল্লি, বাবুবাগান, যোথপুর পার্ক, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, মুদিয়ালি, বোস পুকুর শীতলামন্দির, কসবা শিবমন্দির, বড়িশা ক্লাব, তালবাগান সর্বজনীন, অজেয় সংহতি, পুটিয়ারি সর্বজনীন, পার্ক সার্কাস সর্বজনীন, তেলেঙ্গা বাগান, চালতা বাগান, সুরুচি সংঘ, শ্রীভূমি স্পোর্টিং, দমদম পার্ক তরুণ সংঘ, সল্ট লেক এফ ডি ব্লক, শেঠ পুকুর সর্বজনীন ইত্যাদি।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
এই উৎসবের ব্যাপ্তি এখন সর্বজনীন পূজার পরিমণ্ডল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার বনেদিবাড়ির পূজায়ও। এই পূজার আয়োজন যেমন ব্যাপক, তেমনি খরচের বহরও বিশাল। ফলে লক্ষ্মী বা সরস্বতী পূজার মতো এই পূজা বাড়ি বাড়ি হয় না। সাবেকি আমল থেকেই এই পূজা সাধারণত রাজা, জমিদার আর বনেদিবাড়ির আঙিনাতেই হয়ে আসছে। পরে অবশ্য এই পূজা সর্বজনীন রূপ নেয়। তাই কলকাতার সেই সাবেকি বনেদিবাড়ির পূজা এখনো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যায়নি; মানুষও এখন ভিড় করছে বনেদিবাড়ির পূজা দেখতে।
ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, কলকাতায় মাটির দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয় দক্ষিণ কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়িতে, সেই ১৬১০ সালে। এই বংশের পূর্বপুরুষ লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের বাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরে। রাজা মানসিংহের কাছ থেকে জমিদারি পাওয়ার পর তিনি হন সাবর্ণ রায় চৌধুরী। বড়িশায় ছিল তাঁর কাছারিবাড়ি। এই বাড়িতেই তিনি ১৬১০ সালে শুরু করেন প্রথম দুর্গাপূজা। সেই থেকে ৪০০ বছর ধরে এই বাড়ির আটচালা মণ্ডপে চলছে এই দুর্গাপূজা। প্রতিমার একদিকে এখনো রামের মূর্তি, অন্যদিকে শিবের মূর্তি থাকে। এই মণ্ডপের সামনে ছিল দুর্গাদালান নাটমন্দির। সেটি আজ জীর্ণদশাপ্রাপ্ত। কেবল ছাদবিহীন কয়েকটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে।
আবার ১৭৬০ সালে কলকাতার বড়বাজার এলাকার দর্জিপাড়ার দাঁ-বাড়িতে দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেন রামনারায়ণ দাঁ। এই বাড়ির পূজা দেখতে সেদিন লর্ড ক্লাইভও এসেছিলেন। দাঁ বংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম দাঁ বাঁকুড়া থেকে এসেছিলেন দর্জিপাড়ায়। তারপর শুরু করেছিলেন বড়বাজারে মশলার ব্যবসা। তাঁর পুত্র রামনারায়ণ শুরু করেন দুর্গাপূজা।
বরাহনগরের দত্তবাড়ির পূজার সূচনা করেন এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা পরশুরাম দত্তের পৌত্র জানকী রাম, সেই ১৭৭৪ সালে। পরশুরাম হুগলির সপ্তগ্রাম থেকে কলকাতার বরাহনগরে এসে বসতি করেছিলেন। এখানে তৈরি হয়েছিল দুর্গামণ্ডপ ও ঠাকুর দালান।
১৭৭৫ সালে কলকাতার বিডন স্ট্রিটে দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন রামদুলাল দে সরকার। রামদুলালের দুই পুত্র ছিলেন সাতুবাবু ও লাটুবাবু। সাতুবাবু ছিলেন সেতারবাদক আর লাটুবাবু ছিলেন পালোয়ান। আজও এই পূজা সাতুবাবু-লাটুবাবুর পূজা হিসেবে খ্যাত।
উত্তর কলকাতার মিত্রবাড়ির পূজার সূচনা করেন নীলমণি মিত্রের পৌত্র রাধাকৃষ্ণ মিত্র ১৮০৭ সালে। মধ্য কলকাতার ঠনঠনিয়া দত্তবাড়ির পূজা শুরু করেন এই বংশের পূর্বপুরুষ দ্বারকানাথ দত্ত ১৮৫৫ সালে। জোড়াসাঁকোর চন্দ্র দাঁর বাড়ির পূজা শুরু হয় ১৮৫৯ সালে। কলকাতার বিবেকানন্দ রোডের এই বাড়ির পূজা শুরু করেছিলেন এই বংশের পূর্বপুরুষ নরসিংহ দত্ত দাঁ। তিনি ছিলেন আবার কলকাতার প্রখ্যাত বন্দুক ব্যবসায়ী। তিনিই কলকাতায় বন্দুকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এন সি দাঁ অ্যান্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা।
মধ্য কলকাতার বউবাজারের নির্মল চন্দ্র স্ট্রিটের গণেশ চন্দ্রের বাড়ির দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন গণেশ চন্দ্র, সেই ১৮৭৭ সালে। গণেশ চন্দ্র ছিলেন একজন নামী আইনজীবী। তাঁর নামে কলকাতায় আছে গণেশচন্দ্র এভিনিউ। গণেশচন্দ্রের নাতি ছিলেন স্বাধীনতাযোদ্ধা নির্মল চন্দ্র। তাঁর নামেও সড়ক আছে। এই বাড়িতে এসেছেন মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ, সরোজিনী নাইডু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ বিশিষ্টজন। উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের অমৃতলাল দাঁর বাড়ির দুর্গাপূজা শুরু করেন এই বংশের পূর্বপুরুষ অমৃতলাল দাঁ। ১৮৮৩ সালে। আবার দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ির দুর্গাপূজার প্রবর্তন করেছিলেন সুরেন্দ্র মাধব মল্লিক। সেই ১৯২৫ সালে। সুরেন্দ্র মাধব ছিলেন টালিউড তারকা রঞ্জিত মল্লিকের ঠাকুরদা। এখন এই পূজা রঞ্জিত মল্লিকের পূজা বলে পরিচিত।
এ তো গেল কলকাতার নামীদামি বনেদিবাড়ির পূজার কথা। আর সর্বজনীন পূজার তো শেষ নেই কলকাতায়। এবার এই সর্বজনীন পূজা হচ্ছে দুই হাজার ৩৬৯টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পূজা হচ্ছে বাগবাজার সর্বজনীন, টালাপার্ক সর্বজনীন, কুমারটুলি সর্বজনীন, আহিরীটোলা সর্বজনীন, শোভাবাজার সর্বজনীন, কালীঘাট মিলন সংঘ, কলেজ স্কয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক, সন্তোষ মিত্র স্কয়ার, শিয়ালদহ রেলওয়ে অ্যাথলেটিক, একডালিয়া এভারগ্রিন, সিংহী পার্ক, সেলিমপুর পল্লি, বাবুবাগান, যোথপুর পার্ক, বাদামতলা আষাঢ় সংঘ, মুদিয়ালি, বোস পুকুর শীতলামন্দির, কসবা শিবমন্দির, বড়িশা ক্লাব, তালবাগান সর্বজনীন, অজেয় সংহতি, পুটিয়ারি সর্বজনীন, পার্ক সার্কাস সর্বজনীন, তেলেঙ্গা বাগান, চালতা বাগান, সুরুচি সংঘ, শ্রীভূমি স্পোর্টিং, দমদম পার্ক তরুণ সংঘ, সল্ট লেক এফ ডি ব্লক, শেঠ পুকুর সর্বজনীন ইত্যাদি।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।
No comments