জ্ঞানকোষ-ছোটদের বাংলাপিডিয়ায় বড় ভুল by মোকারম হোসেন
আমরা বিশেষ কোনো জ্ঞান কিংবা তথ্যের জন্য সাধারণত এনসাইক্লোপিডিয়া বা জ্ঞানকোষের সাহায্য নিই। আমাদের বড় গ্রন্থাগারগুলোতে সর্বদাই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পাওয়া যায়। আছে অনেক সুসম্পাদিত জুনিয়র এনসাইক্লোপিডিয়াও।
প্রসঙ্গত, Childৎen's Bৎitanica, ম্যাকমিলানের Ouৎ Woৎld Encyclopedia ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘদিন আমাদের এমন কোনো জ্ঞানকোষ ছিল না। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী ছোটদের জন্য পাঁচ খণ্ডের একটি শিশু বিশ্বকোষ প্রকাশ করে। বিশ্বকোষটি সবকিছু মিলিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য জ্ঞানকোষ হিসেবে সবার আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এরপর ২০০৩ সালে বেশ ঘটা করে প্রকাশিত হলো বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া। আমরা অনেকটাই আশ্বস্ত হই, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য আর খুব একটা দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না। অল্প সময়ের মধ্যেই সংগ্রহ করতে পারব কাঙ্ক্ষিত তথ্যটি। কিন্তু অচিরেই আমাদের ভুল ভাঙল। বাংলাপিডিয়ায় ব্যবহূত বিভিন্ন তথ্য বিভ্রান্তি তৈরি করল। ফলে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে শীর্ষস্থান হারাতে হলো বাংলাপিডিয়াকে। তার কয়েক বছর পর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত নওরোজ জাহানের লেখা A Field guide to Bangladeshi floweৎs গ্রন্থটিও তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। ভুলে ভরা এই গ্রন্থটি প্রকাশের আগে কোনো বিষয় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা সহায়তা নেওয়া হয়নি। যদিও এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন প্রকৃতিবিদ ড. নওয়াজেশ আহমদ ও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা।
সর্বশেষ এ বছর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ছোটদের বাংলাপিডিয়া আমাদের আরেকবার হতাশ করেছে। দুই খণ্ডের এই জ্ঞানকোষ শিশু তো বটেই, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। একেবারে প্রথমেই সবার কাছে বইয়ের আকার ও ওজনের বিষয়টি আপত্তিকর মনে হবে। এমন ঢাউস আকারের এবং ওজনদার বই ছোটদের পক্ষে নাড়াচাড়া করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। সে ক্ষেত্রে এই জ্ঞানকোষটি একাধিক খণ্ডে হতে পারত। বিদেশে ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো সাধারণত কম পৃষ্ঠায় একাধিক খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। এখানেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা যেত।
এবার তথ্যগত ভুল প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথম খণ্ডের ৫৮ পৃষ্ঠায় শরিফা ফলের নাম লেখা হয়েছে আতা। প্রকৃত অর্থে আতা ও শরিফা ফল একেবারেই আলাদা। ৫৯ পৃষ্ঠায় মাল্টা ফলের ছবির ক্যাপশন লেখা হয়েছে জাম্বুরা। জাম্বুরার পোশাকি নাম বাতাবিলেবু। এখানে বাতাবিলেবু নামটিও ব্যবহার করা হয়নি। যদিও সারা দেশের মানুষ ফলটিকে এই নামেই চেনে। ৬০ পৃষ্ঠায় মৌসুমি ফুলের বর্ণনায় কিছু অসংগতি রয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে বই থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। ‘...বাংলাদেশের মৌসুমি ফুলের মধ্যে কদম, সূর্যমুখী, জিনিয়া, গাঁদা, দোপাটি, মর্নিংগ্লোরি, ডেইজি ইত্যাদি। আর শীত ও বসন্তকালীন ফুলের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, এস্টার, মোরগফুল, কসমস ইত্যাদি।...’ এখানে শীত ও বসন্তকালীন যেসব ফুলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তন্মধ্যে বসন্তের একটি ফুলও নেই। অথচ পলাশ, পারিজাত, শিমুল বসন্তের খুবই আলোচিত ফুল। তাহলে আমরা শিশুদের কী শেখাচ্ছি! কাউকে ভুল শেখানোর কোনো অধিকার কি আমাদের আছে?
৬১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘তোড়া, মালা বা অন্য কোনো আকর্ষণীয় সাজে সাজানোর জন্য যেসব ফুল বিক্রি করা হয়, তাকে কাঁটাফুল বলে।...’ আদতে এ ধরনের ফুলকে ইংরেজিতে ‘কাট-ফ্লাওয়ার’ বলা হয়। কাঁটাফুল নামে উদ্ভিদবিজ্ঞানে কোনো শব্দ আছে কি না জানা নেই, তবে কাঁটাফুল বলতে কাঁটাযুক্ত ফুল হতে পারে।
মাধবীলতা নামে যে ফুলের ছবি ব্যবহূত হয়েছে, তা আসলে মধুমালতী বা মধুমঞ্জরি। ইংরেজি নাম রেঙ্গুনক্রিপার। রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করেছেন মধুমঞ্জরি। বস্তুত, মাধবীলতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। দুটোই আলাদা ধরনের ফুল। মাধবী ফোটে প্রাক্-বসন্তে। খুবই ক্ষণস্থায়ী। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে/এসে হেসেই বলে “যাই যাই যাই”।’ আর মধুমঞ্জরি শীতকাল ছাড়া প্রায় সারা বছরই ফোটে। ফুলের গোড়ায় আছে মৌগ্রন্থি। সম্ভবত এ কারণেই এমন নামকরণ। (পৃ. ৬১)
এই গ্রন্থে ব্যবহূত ছবিগুলোর কোনো তথ্যসূত্র উল্লিখিত নেই। বর্তমান কপিরাইট নিয়ম অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র বা আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ করা বাধ্যবাধকতার মধ্যেই পড়ে। তাতে প্রকাশনাও সমৃদ্ধ হয়।
বিস্তৃত পরিসরের এই জ্ঞানকোষ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ মাত্র এই কয়েক পৃষ্ঠার। বাকি ভুক্তিগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। জ্ঞানকোষের অন্যান্য ভুক্তি সম্পর্কে বিষয় বিশেষজ্ঞরা যদি তাঁদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেন এবং গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও পরিশীলিত সংস্করণ আমরা পাব। কারণ, শিশুরা ভুল শিখে কিংবা ভুল জেনে বড় হোক, এটা আমরা চাই না।
এই জ্ঞানকোষ প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বাংলাপিডিয়া ট্রাস্টি বোর্ড এবং সম্পাদনা পরিষদ মিলিয়ে অন্তত ৩০ জন অধ্যাপক। তাঁরা কি এই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করেননি? এ ধরনের বিশেষ জ্ঞানকোষ প্রকাশের ক্ষেত্রে (শিশুতোষ) অবশ্যই কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত শিশুসাহিত্যিক, যাঁরা ছোটদের নিয়ে কাজ করেন বা ভাবেন, তাঁদের থাকা প্রয়োজন ছিল। তবু এশিয়াটিক সোসাইটির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে এই ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হলে সবাই উপকৃত হবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
taৎupallab@gmail.com
সর্বশেষ এ বছর এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত ছোটদের বাংলাপিডিয়া আমাদের আরেকবার হতাশ করেছে। দুই খণ্ডের এই জ্ঞানকোষ শিশু তো বটেই, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। একেবারে প্রথমেই সবার কাছে বইয়ের আকার ও ওজনের বিষয়টি আপত্তিকর মনে হবে। এমন ঢাউস আকারের এবং ওজনদার বই ছোটদের পক্ষে নাড়াচাড়া করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। সে ক্ষেত্রে এই জ্ঞানকোষটি একাধিক খণ্ডে হতে পারত। বিদেশে ছোটদের এনসাইক্লোপিডিয়াগুলো সাধারণত কম পৃষ্ঠায় একাধিক খণ্ডে প্রকাশ করা হয়। এখানেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা যেত।
এবার তথ্যগত ভুল প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথম খণ্ডের ৫৮ পৃষ্ঠায় শরিফা ফলের নাম লেখা হয়েছে আতা। প্রকৃত অর্থে আতা ও শরিফা ফল একেবারেই আলাদা। ৫৯ পৃষ্ঠায় মাল্টা ফলের ছবির ক্যাপশন লেখা হয়েছে জাম্বুরা। জাম্বুরার পোশাকি নাম বাতাবিলেবু। এখানে বাতাবিলেবু নামটিও ব্যবহার করা হয়নি। যদিও সারা দেশের মানুষ ফলটিকে এই নামেই চেনে। ৬০ পৃষ্ঠায় মৌসুমি ফুলের বর্ণনায় কিছু অসংগতি রয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে বই থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। ‘...বাংলাদেশের মৌসুমি ফুলের মধ্যে কদম, সূর্যমুখী, জিনিয়া, গাঁদা, দোপাটি, মর্নিংগ্লোরি, ডেইজি ইত্যাদি। আর শীত ও বসন্তকালীন ফুলের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, এস্টার, মোরগফুল, কসমস ইত্যাদি।...’ এখানে শীত ও বসন্তকালীন যেসব ফুলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তন্মধ্যে বসন্তের একটি ফুলও নেই। অথচ পলাশ, পারিজাত, শিমুল বসন্তের খুবই আলোচিত ফুল। তাহলে আমরা শিশুদের কী শেখাচ্ছি! কাউকে ভুল শেখানোর কোনো অধিকার কি আমাদের আছে?
৬১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘তোড়া, মালা বা অন্য কোনো আকর্ষণীয় সাজে সাজানোর জন্য যেসব ফুল বিক্রি করা হয়, তাকে কাঁটাফুল বলে।...’ আদতে এ ধরনের ফুলকে ইংরেজিতে ‘কাট-ফ্লাওয়ার’ বলা হয়। কাঁটাফুল নামে উদ্ভিদবিজ্ঞানে কোনো শব্দ আছে কি না জানা নেই, তবে কাঁটাফুল বলতে কাঁটাযুক্ত ফুল হতে পারে।
মাধবীলতা নামে যে ফুলের ছবি ব্যবহূত হয়েছে, তা আসলে মধুমালতী বা মধুমঞ্জরি। ইংরেজি নাম রেঙ্গুনক্রিপার। রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করেছেন মধুমঞ্জরি। বস্তুত, মাধবীলতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। দুটোই আলাদা ধরনের ফুল। মাধবী ফোটে প্রাক্-বসন্তে। খুবই ক্ষণস্থায়ী। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে/এসে হেসেই বলে “যাই যাই যাই”।’ আর মধুমঞ্জরি শীতকাল ছাড়া প্রায় সারা বছরই ফোটে। ফুলের গোড়ায় আছে মৌগ্রন্থি। সম্ভবত এ কারণেই এমন নামকরণ। (পৃ. ৬১)
এই গ্রন্থে ব্যবহূত ছবিগুলোর কোনো তথ্যসূত্র উল্লিখিত নেই। বর্তমান কপিরাইট নিয়ম অনুযায়ী এসব ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র বা আলোকচিত্রীর নাম উল্লেখ করা বাধ্যবাধকতার মধ্যেই পড়ে। তাতে প্রকাশনাও সমৃদ্ধ হয়।
বিস্তৃত পরিসরের এই জ্ঞানকোষ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ মাত্র এই কয়েক পৃষ্ঠার। বাকি ভুক্তিগুলোর অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। জ্ঞানকোষের অন্যান্য ভুক্তি সম্পর্কে বিষয় বিশেষজ্ঞরা যদি তাঁদের মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেন এবং গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও পরিশীলিত সংস্করণ আমরা পাব। কারণ, শিশুরা ভুল শিখে কিংবা ভুল জেনে বড় হোক, এটা আমরা চাই না।
এই জ্ঞানকোষ প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন বাংলাপিডিয়া ট্রাস্টি বোর্ড এবং সম্পাদনা পরিষদ মিলিয়ে অন্তত ৩০ জন অধ্যাপক। তাঁরা কি এই তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করেননি? এ ধরনের বিশেষ জ্ঞানকোষ প্রকাশের ক্ষেত্রে (শিশুতোষ) অবশ্যই কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত শিশুসাহিত্যিক, যাঁরা ছোটদের নিয়ে কাজ করেন বা ভাবেন, তাঁদের থাকা প্রয়োজন ছিল। তবু এশিয়াটিক সোসাইটির এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ভবিষ্যতে এই ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হলে সবাই উপকৃত হবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক, সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব।
taৎupallab@gmail.com
No comments