মাছ কি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ? by ড. আনোয়ারা বেগম শেলী
'মাছে-ভাতে বাঙালি'_বহু প্রাচীন এই পরিচিতি আমরা গর্বের সঙ্গে বহন করে চলেছি। আমাদের জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ আমিষের যে চাহিদা রয়েছে, তার ৬০ শতাংশেরই জোগান দেয় মাছ। খাদ্য হিসেবেও মাছ আমাদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করে। উপরন্তু পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য হিসেবে কর্মক্ষম ও সুস্থ জীবন নির্বাহ করার অপার সুযোগ এনে দেয়।
কিন্তু আমাদের খাদ্যবাজারে হঠাৎ করে নতুন এক দুর্যোগ দেখা দিয়েছে। খাদ্যে প্রতিনিয়তই বিষ মেশানো হচ্ছে। সবজি, ফল, তেল, ঘি, দুধ, মাংস, দই, মিষ্টি, চকোলেট, বিস্কুট, সফ্ট ড্রিংক্স, জুস, জেলি, মসলা_সব কিছুতে অবিরাম বিষ মেশানোর প্রক্রিয়া চলছে। কিছুদিন আগে চীনে গুঁড়ো দুধ ও শিশুখাদ্যে মেলামিন মেশানো নিয়ে দুনিয়াব্যাপী তোলপাড় হয়েছিল। আমাদের দেশে দুধে ফরমালিন মেশানোর ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি। মৌসুমি ফলের দেশ হিসেবে খ্যাত আমাদের আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, কুল_সব ফল আজ রাসায়নিক বিষযুক্ত। সবজিতে কীটনাশকের ব্যবহার পর্যন্ত চলছে। গণমাধ্যমে এসব খবর প্রকাশিত হলেও এ নিয়ে তেমন কোনো তোলপাড় নেই। অথচ চিকিৎসকদের মতে, খাদ্যের সঙ্গে অখাদ্য রাসায়নিক পদার্থ ও বিষ গ্রহণের ফলে নানা রকম অসুখ-বিসুখের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাছের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, মাছকে অনিরাপদ খাদ্যে পরিণত করা হচ্ছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। প্রথমত, অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মতোই মাছেও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ মেশানো হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মানুষ নানাভাবে মাছের আবাসভূমিকে বিষাক্ত করছে, যে পরিবেশে বেড়ে ওঠা মাছ জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মাছচাষের বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু দূষণ ঘটছে। যেমন_হ্যাচারিতে মাছের খাদ্যের সঙ্গে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, যা পরবর্তীকালে মানবদেহে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
খাদ্য হিসেবে মাছকে অনিরাপদ করার ক্ষেত্রে দূষণের ধরনগুলো হচ্ছে_জৈব (প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইটস), রাসায়নিক (মাছচাষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ড্রাগ রেসিডিউ, পেস্টিসাইডস, প্রাকৃতিক বিষাক্ত দ্রব্য, প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি) এবং বিভিন্ন ধরনের ধাতু এবং এদের যৌগ (ক্যাডমিয়াম, লেড, কপার, জিংক, আর্সেনিক)। মাছচাষে ব্যবহার করা যাবে এমন অনুমোদিত কিছু ওষুধ রয়েছে, যেগুলো সুনির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে; এবং সেসব ওষুধ ব্যবহারের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেই মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। যেমন_অঙ্েিটট্রাসাইক্লিন ব্যবহারের কমপক্ষে ৩০ দিন পর মাছ আহরণ করা যাবে। সালফার ডাই-মিথোঙ্নি ব্যবহারের ৪২ দিন পর মাছ আহরণ করতে হবে। শুঁটকি মাছের ক্ষেত্রে নগ্নভাবে বিষাক্ত দ্রব্য মেশানো হয়। আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও শুঁটকির খোলায় মাছির যন্ত্রণায় দাঁড়ানো যেত না। কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটার সমুদ্রতীরে বড় বড় শুঁটকিখোলায় গিয়ে দেখেছি, কোনো মাছি নেই। উন্মুক্ত বেলাভূমিজুড়ে রশিতে, চাটাইয়ে ধান-চালের মতো করে শুঁটকি শুকিয়ে নিচ্ছে জেলেরা। এর কারণ শুঁটকিতে মেশানো হচ্ছে ডিডিটি, নগোস, কপার সালফেট, বি্লচিং পাউডার। এগুলোর প্রতিটি দ্রব্য মারাত্মক বিষ। এগুলোর প্রতিক্রিয়া বংশপরম্পরায় চলতে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
রাজধানী ঢাকায় এখন দেড় কোটি মানুষের বসবাস। তাদের প্রতিদিনকার বর্জ্যের একটি বিশাল অংশ গিয়ে পড়ছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে। সেই সঙ্গে আছে ক্রমবর্ধমান শিল্পবর্জ্য। এসব বর্জ্যে মিশে আছে হেভি মেটাল, যেগুলো বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়, সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাছসহ জলজ প্রাণীর খাদ্য শিকলে। আর সেই মাছ খাওয়ার ফলে সেসব বিষাক্ত দ্রব্য মানব শরীরেও চলে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, কপার ইত্যাদির দূষণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে ক্রোমিয়াম; এবং তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ ট্যানারির বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা নদীর টেংরা, টাটকিনি, টাকি, বাতাসি, বেলে ও চাপিলা মাছ নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় পাঁচ ধরনের হেভি মেটালের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
মাছ পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু পানি যদি দূষিত হয়, তাহলে মাছ যাবে কোথায়? ফলে মাছের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটবে এবং সেই মাছ খেয়ে বিষক্রিয়া মানবদেহে ছড়াবে। সে ক্ষেত্রে পানিদূষণ রোধ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমাদের প্রস্তাবিত পানি আইন-২০১১-তে অপরিকল্পিত শিল্পবর্জ্য যে দেশব্যাপী নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, তা দূর করার ব্যাপারে কার্যকর কোনো ধারা বা কঠোর শাস্তি বিধানের কথা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন-১৯৯৫ পানিদূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর। তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানিদূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করা অত্যন্ত জরুরি। উপরন্তু পানির বিভিন্ন উৎস সংরক্ষণ এবং গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ধারা থাকা আবশ্যক।
লেখক : পরিচালক, কারিতাস মৎস্য কর্মসূচি
খাদ্য হিসেবে মাছকে অনিরাপদ করার ক্ষেত্রে দূষণের ধরনগুলো হচ্ছে_জৈব (প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্যারাসাইটস), রাসায়নিক (মাছচাষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ড্রাগ রেসিডিউ, পেস্টিসাইডস, প্রাকৃতিক বিষাক্ত দ্রব্য, প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি) এবং বিভিন্ন ধরনের ধাতু এবং এদের যৌগ (ক্যাডমিয়াম, লেড, কপার, জিংক, আর্সেনিক)। মাছচাষে ব্যবহার করা যাবে এমন অনুমোদিত কিছু ওষুধ রয়েছে, যেগুলো সুনির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে; এবং সেসব ওষুধ ব্যবহারের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেই মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। যেমন_অঙ্েিটট্রাসাইক্লিন ব্যবহারের কমপক্ষে ৩০ দিন পর মাছ আহরণ করা যাবে। সালফার ডাই-মিথোঙ্নি ব্যবহারের ৪২ দিন পর মাছ আহরণ করতে হবে। শুঁটকি মাছের ক্ষেত্রে নগ্নভাবে বিষাক্ত দ্রব্য মেশানো হয়। আজ থেকে ১০-১২ বছর আগেও শুঁটকির খোলায় মাছির যন্ত্রণায় দাঁড়ানো যেত না। কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটার সমুদ্রতীরে বড় বড় শুঁটকিখোলায় গিয়ে দেখেছি, কোনো মাছি নেই। উন্মুক্ত বেলাভূমিজুড়ে রশিতে, চাটাইয়ে ধান-চালের মতো করে শুঁটকি শুকিয়ে নিচ্ছে জেলেরা। এর কারণ শুঁটকিতে মেশানো হচ্ছে ডিডিটি, নগোস, কপার সালফেট, বি্লচিং পাউডার। এগুলোর প্রতিটি দ্রব্য মারাত্মক বিষ। এগুলোর প্রতিক্রিয়া বংশপরম্পরায় চলতে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
রাজধানী ঢাকায় এখন দেড় কোটি মানুষের বসবাস। তাদের প্রতিদিনকার বর্জ্যের একটি বিশাল অংশ গিয়ে পড়ছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে। সেই সঙ্গে আছে ক্রমবর্ধমান শিল্পবর্জ্য। এসব বর্জ্যে মিশে আছে হেভি মেটাল, যেগুলো বায়ো-ডিগ্রেডেবল নয়, সরাসরি অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মাছসহ জলজ প্রাণীর খাদ্য শিকলে। আর সেই মাছ খাওয়ার ফলে সেসব বিষাক্ত দ্রব্য মানব শরীরেও চলে আসছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার পানিতে লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, কপার ইত্যাদির দূষণ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে ক্রোমিয়াম; এবং তা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ ট্যানারির বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা নদীর টেংরা, টাটকিনি, টাকি, বাতাসি, বেলে ও চাপিলা মাছ নিয়ে পরিচালিত গবেষণায় পাঁচ ধরনের হেভি মেটালের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
মাছ পানি ছাড়া বাঁচতে পারে না। কিন্তু পানি যদি দূষিত হয়, তাহলে মাছ যাবে কোথায়? ফলে মাছের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটবে এবং সেই মাছ খেয়ে বিষক্রিয়া মানবদেহে ছড়াবে। সে ক্ষেত্রে পানিদূষণ রোধ করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমাদের প্রস্তাবিত পানি আইন-২০১১-তে অপরিকল্পিত শিল্পবর্জ্য যে দেশব্যাপী নদী, খাল ও জলাধারগুলোকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে, তা দূর করার ব্যাপারে কার্যকর কোনো ধারা বা কঠোর শাস্তি বিধানের কথা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আইন-১৯৯৫ পানিদূষণ প্রতিরোধে অকার্যকর। তাই প্রস্তাবিত পানি আইনে পানিদূষণ প্রতিরোধের জন্য একটি পৃথক পরিচ্ছেদ সংযোজন করা অত্যন্ত জরুরি। উপরন্তু পানির বিভিন্ন উৎস সংরক্ষণ এবং গুণগত মান বজায় রেখে দূষণ প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন পরিচ্ছেদ ও ধারা থাকা আবশ্যক।
লেখক : পরিচালক, কারিতাস মৎস্য কর্মসূচি
No comments