অরণ্যে রোদন-ক্ষমা করুন, বাংলার কৃষক by আনিসুল হক

ক্ষমা করবেন, বাংলাদেশের কৃষকসমাজ। ক্ষমা করবেন জয়পুরের আক্কেলপুরের পালশা গ্রামের বর্গাচাষি আজিজার রহমান (৬০)। জনাব, আজিজার রহমান, আপনার ছবি আমরা দেখেছি ২ অক্টোবর ২০১১-এর প্রথম আলোয়। বাংলাদেশের যেকোনো কৃষকের মতোই আপনার চেহারা। আপনার পরিশ্রমে গড়া শরীর, আপনার গালে সাদা দাড়ি।


আপনার পরনে লুঙ্গি, গায়ে চেক শার্ট। আপনার হাতে হাতকড়া। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রতীক যে পুলিশ, তাদেরই একজন সদস্য আপনার হাতে হাতকড়া পরিয়ে জয়পুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ধরে আছেন। আপনার অপরাধ, আপনি বর্গাচাষি। আপনার অপরাধ, আপনি ১২ বছর আগে জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ১০ হাজার টাকা, আলু চাষ করবেন বলে। আপনি আলু চাষ করেছিলেনও, কিন্তু দাম পাননি, তাই ওই ঋণ শোধ করতে পারেননি, ২০১০ সালে তার পরিমাণ সুদে-আসলে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার টাকার বেশি। শহীদ কাদরি নামের একজন কবি রাষ্ট্র সম্পর্কে কবিতা লিখেছেন, আপনি তা পড়েননি। তিনি লিখেছেন, রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট। রাষ্ট্র আপনার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়েছে, আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আপনাকে থানাহাজতে নেওয়া হয়েছে। আপনার ছবি আমরা প্রথম আলোয় দেখেছি। আপনার এই অপমানের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমাদের করার কিছুই নেই।
জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবুল বারকাত সজ্জন ব্যক্তি। আপনার ছবি দেখে বাংলাদেশের আরও অনেক মানুষের মতো তাঁর হূদয়ও কেঁদে উঠেছে, তিনি নিজে আপনার ঋণ শোধ করেছেন। ২ অক্টোবরই আপনাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। আরও অনেক সহূদয় মানুষই আপনাকে ঋণমুক্ত করার জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করতে প্রস্তুত বলে আমাদের জানিয়েছেন। তাতে আমাদের ব্যথিত হূদয় কিছুটা শুশ্রূষা পায় বটে, কিন্তু বাস্তবতার তাতে খুব একটা বদল ঘটে না। আমরা ভুলে যেতে পারি না, আমাদের রাজনীতি, আমাদের রাষ্ট্রনীতি, আমাদের ভদ্রলোকপনা আপনাদের হাতে চিরদিনের হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে, সেটাই আসলে বাংলাদেশের আসল চিত্র।
মুক্তির গান ছবিতে, আজিজুর রহমান, আপনাকে আমরা দেখেছি। আপনার মাথায় তখন মাথাল ছিল কিংবা হেলমেট, আর আপনার হাতে ছিল অস্ত্র। ওই ছবি বানানো নয়, একাত্তর সালের সত্যিকারের ফুটেজ। আপনি বাংলার কৃষক, একাত্তর সালে আপনিই যুদ্ধ করেছেন। আপনার কাহিনি আমরা পড়েছি মাহবুব আলমের লেখা গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে বইয়ে, একাত্তর সালে বাংলার কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষ কীভাবে যুদ্ধ করেছেন, তাই জেনেছি। যুদ্ধশেষে আপনি ফিরে গেছেন আপনার খেতে, আবার লেগে পড়েছেন চাষবাসের কাজে। একাত্তরে লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আজ লোকসংখ্যা ১৬ কোটি। আপনার পরিশ্রম, আপনার সৃজনশক্তি, আপনার প্রতিবিন্দু রক্ত-ঘাম উজাড় করে দিয়ে আপনি উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছেন। যে ২ অক্টোবর আপনার হাতকড়া পরা ছবিটা ছাপা হয়েছিল, সেদিনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন উৎপাদনশীলতাবিষয়ক সেমিনারে অংশ নিতে, গিয়েছিলেন রূপসী বাংলা হোটেলে, ঘোষণা দিয়েছেন, প্রতিবছর ২ অক্টোবর এই দেশে পালিত হবে উৎপাদনশীলতা দিবস। আপনি, বাংলাদেশের কৃষক, আপনার চেয়ে উৎপাদনশীলতা বেশি আর কে দেখাতে পেরেছে এই দেশে? এই পৃথিবীতে? বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১০৪৫ জন। আমেরিকার মোট আয়তন ৯.৮৩ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে যদি যুক্তরাষ্ট্রে লোক বসাই, ওই দেশের মোট লোকসংখ্যা হবে এক হাজার কোটিরও বেশি। তার মানে আমেরিকার কৃষককে যদি বলা হয়, সারা পৃথিবীর লোককে খাওয়াতে হবে এবং তার পরও আরও ৩০০ কোটি লোকের খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকতে হবে, তাদের ওপর যে চাপটা পড়ত, বাংলাদেশের কৃষকেরা সেই চাপটা অত্যন্ত সার্থকতার সঙ্গে বহন করে চলেছেন। আজ আমরা যে খেতে পাই, তার পেছনে আছে আপনার মতো কৃষকদের অবদান। আমাদের ভালো থাকা, আমাদের এগিয়ে যাওয়া, সবকিছু বাংলাদেশের কৃষকের ঘামের কাছে, রক্তের কাছে, অশ্রুবিন্দুর কাছে ঋণী।
আপনারা আমাদের ভালো থাকার ব্যবস্থা করেছেন নিজেদের খারাপ থাকার বিনিময়ে। আপনারা আমাদের খাওয়াচ্ছেন-পরাচ্ছেন নিজেরা না খেয়েদেয়ে। সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘ওই যে দাঁড়ায়ে নতশির
মূক সবে— ম্লানমুখে লেখা শতাব্দীর বেদনার
করুণ কাহিনী, স্কন্ধ যত চাপে ভার
বহি চলে মন্দগতি, যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার...’
লিখেছেন:
‘শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া।’
এই বর্ণনা তো আপনারই জীবনচিত্র।
আপনারা কোনোমতে আছেন কি নেই, তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না। আপনারা দিনান্ত পরিশ্রম করেন, মাটিতে ফলান সোনার ফসল, কিন্তু তা বিক্রি করে দেন পানির দামে। পানিরও দাম আছে, এক বোতল পানি ১০-২০ টাকায় আমরা কিনে খাই। আপনাদের ফসলের কোনো দাম নেই। প্রথম আলোর ২ অক্টোবর ২০১১ প্রধান প্রতিবেদনে লিখেছে, ঢাকায় এলেই দাম দ্বিগুণ। আপনারা ফসল ফলান, কিন্তু দাম পান না। যা দাম পান, তাতে আপনাদের বিনিয়োগ ফিরে আসে না। অথচ হাত ঘুরে ঢাকায় যখন আসে সেই ফসল, সেই সবজি, বিক্রেতারা ঠিকই দাম পান, ক্রেতারাও দাম দেন। পথে পথে আছে চাঁদাবাজ চক্র, কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে সবজির পাইকারি বিক্রেতাদের চাঁদা দিতে হয় চার দফায়।
তবু আপনাদের কোনো অভিযোগ নেই। ‘নাহি ভর্ৎসে অদৃষ্টেরে, নাহি নিন্দে দেবতারে স্মরি, মানবেরে নাহি দেয় দোষ।’ তাই আপনাদের কোমরেই পড়ে দড়ি, হাতে পড়ে হাতকড়া। ১০ হাজার টাকা ঋণের দায়ে আপনাকে হাজতে যেতে হয়। পাঁচ হাজার টাকা ঋণের জন্য আপনার স্ত্রী-কন্যার নাকের নোলক কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে তারা আত্মহত্যা করেছে, এই খবর আমরা একাধিকবার পড়েছি। আপনাদের টিনের চাল খুলে নিয়ে গেছে ঋণ আদায়কারীরা, সে খবরও কাগজে দেখেছি।
আপনি, বাংলাদেশের কৃষক, আপনার প্রতি রাষ্ট্র নির্মম, আপনার প্রতি রাজনীতিবিদেরা, রাষ্ট্রপরিচালকেরা, সমাজপতিরা ক্ষমাহীন, উদাসীন, উপেক্ষাময়। ১০ হাজার টাকার ঋণ আপনার বেলায় মওকুফ নেই। অথচ এই রাষ্ট্রে বড় বড় ঋণখেলাপি পার পেয়েছে দিনের পর দিন। এই দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। নেতারা, জনপ্রতিনিধিরা টেলিফোনের বিল বকেয়া রাখেন মাসের পর মাস। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের সরকারি আয়ের ওপর থেকে আগের বছরগুলোয় আয়কর মাফ পেয়ে এসেছেন। বড়লোকেরা শেয়ারবাজারে হরিলুট করে দিব্যি আরামে আছেন। কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে আপনাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা। আপনারা তাদের জিন্দাবাদ দিয়ে এসেছেন। আপনাদের ভোটেই ক্ষমতার বদল ঘটে। আপনারাই জনসভার সমাগম বাড়ান। আপনারাই মরেন শয়ে শয়ে; বন্যায়, খরায়, মঙ্গায়, সিডরে, আইলায়, শীতে।
তবু বলি, আপনারাই বীর। আপনারাই দাতা। আপনারা দেন, আপনারা দেওতা। আমরা নিই, আমরা নেওতা, আমরা নেতা।
আপনারা আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন, আর যদি পারেন আমাদের ক্ষমা করে দিন। যদি ক্ষমা করতে না পারেন, আমাদের ঘৃণা করুন। অভিশাপ দিন। কৃষক আজিজার রহমান, আপনার হাতকড়া পরা ছবি কেবল আপনার ছবি নয়, ও হলো আমাদের বন্দী বিবেকেরই ছবি। আপনাকে হাতকড়া পরিয়ে আমরা আমাদের বিবেকের বন্দিত্বই কেবল প্রমাণ করেছি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.