সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা-ভীতি ছড়িয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের ছক ছিল by কামরুল হাসান

দেশের সর্বস্তরে ত্রাস সৃষ্টি করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ ও তাঁর সঙ্গীরা। বড় রাজনৈতিক দল, বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসন এবং গণমাধ্যম-কেও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। আদালতকেও তাঁরা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।


সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফ ও মেজর (অব.) এ কে এম জাকির হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেন। আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৯ জানুয়ারি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে তাঁরা জবানবন্দি দেন। জবানবন্দির একটি পর্ব ৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে।
জবানবন্দিতে জাকির বলেন, সারা দেশে সান্ধ্য আইন জারি, অবৈধ সম্পদ উদ্ধারের নামে এলাকায় এলাকায় অভিযান, মেজর জেনারেল ও এর ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অপসারণ, শরিয়া আইন প্রবর্তন এবং সংবাদ মাধ্যমকে নিজের মতো ব্যবহার করে ইশরাকের নেতৃত্বাধীন তথাকথিত সরকার দেশকে নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করেছিল।
জাকির জবানবন্দিতে বলেন, ২০০৯ সালের নভেম্বরে তিনি অবসরে যান। এরপর কিছুদিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত রোজার শেষদিকে তাঁর সাবেক প্রশিক্ষক লে. কর্নেল এহসান ইউসুফের সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাসে দেখা হয়। তিনি একটি ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁকে গুলশান নিকেতনে ইশরাক আহমেদের কাছে নিয়ে যান। ঈদের পর ইশরাক আহমেদের কার্যালয়ে জীবনবৃত্তান্ত দিয়ে আসেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ইশরাক তাঁকে বাসায় ডাকেন। তিনি সেখানে গিয়ে এহসান ইউসুফ ও মেজর জিয়াউল হককে দেখতে পান। জিয়া তাঁকে বলেন, এহসান তাঁকে সেখানে নিয়ে এসেছেন। এরপর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চারজন সেখানে একাধিক বৈঠক করেন।
জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়ানো: জবানবন্দিতে জাকির বলেন, দেশকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ইশরাক তাঁর পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত জানান। ইশরাক বলেছিলেন, ওই সময় (ক্ষমতা নেওয়ার পর) সারা দেশে সান্ধ্য আইন দেওয়া হবে। সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে। বিমানবন্দর দিয়ে লোকজন শুধু আসতে পারবে, কিন্তু দেশ ছেড়ে কেউ যেতে পারবে না। সান্ধ্য আইন চলা অবস্থায় ঘরে ঘরে বিশেষ ধরনের নিরীক্ষাব্যবস্থা চালু হবে। একেক দিন একেক এলাকায় মানুষের সম্পদের হিসাব নেওয়া হবে। যারা ভয়ে অবৈধ সম্পদের কথা বলবে না, তাদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে সেগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হবে।
এহসান ইউসুফ জবানবন্দিতে বলেন, নারীনীতি বাতিল, হিজাবব্যবস্থা প্রবর্তন ও শরিয়া ব্যাংকব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা ছিল তাঁদের।
সরকারব্যবস্থা: জাকির জবানবন্দিতে বলেন, তাঁদের বৈঠকের মূল বিষয় ছিল সামরিক বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা নিয়ে। ইশরাক বলতেন, দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দিয়ে দেশ চালাতে হবে। কীভাবে রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করা হবে, কীভাবে সরকার গঠন করা হবে, এসব নিয়ে তিনি কথা বলতেন। সমাজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দিয়ে তিনি সরকার গঠন করার পরিকল্পনার কথা জানান। সংবিধান কী অবস্থায় থাকবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই জবানবন্দিতে। সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল দিয়ে দেশ পরিচালনার কথাও বলেছিলেন ইশরাক। তিনি নিজে এর প্রধান হতে চেয়েছিলেন।
সেনা কর্মকর্তারা যা করতেন: আদালতে জাকির বলেন, তাঁদের পরিকল্পনামতো মেজর জেনারেল পদের একজন কর্মকর্তা সেনা সদর দপ্তর দখল করবেন এবং তিনি নিজেকে সেনাপ্রধান ঘোষণা করবেন। তাঁর সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদের এক কর্মকর্তা চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) হিসেবে কাজ করবেন। এহসান ইউসুফ জবানবন্দিতে বলেন, লে. জেনারেল পদের এক কর্মকর্তাকে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেবেন। সব মুখ্য কর্মকর্তাকে (পিএসও) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেবেন। তবে বর্তমানে বেসামরিক প্রশাসনে সচিব পদে থাকা কর্মকর্তাদের কী হবে, তার উল্লেখ নেই জবানবন্দিতে।
সংবাদমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ: সাংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে ইশরাক বলেন, যেকোনো সময় তিনি একটি দেশীয় চ্যানেল ও কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা টিভিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবেন। তিনি বলেন, সান্ধ্য আইন চলার সময় বিগত সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে বক্তব্য দেওয়া হবে এবং তা সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হবে। এ ছাড়া শেখ ফজলে নূর তাপসের ওপর হামলায় গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে কারাগার থেকে বের করে আনা হবে।
রাজনৈতিক দলের কী হবে: এহসান ইউসুফ জবানবন্দিতে বলেন, ওই সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলের সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিবেরা আদালতে যেতে পারেন। কিন্তু আদালতের মাধ্যমে বলানো হবে, রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুযায়ী দেশ চলবে। অবশ্য এর আগেই রাষ্ট্রপতি পদে তাঁরা পছন্দের লোক নিয়োগ দেবেন। আর রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম থাকবে না।
জাকির বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর তাঁর ই-মেইলে মেজর জিয়া একটি বার্তা পাঠান। ৩০ ডিসেম্বর রাতে তিনি গ্রেপ্তার হন।

No comments

Powered by Blogger.