রাজনীতি-বিএনপির যুদ্ধের আহ্বান? by মশিউল আলম
গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চার দলের জনসভায় জোটের প্রধান নেতা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেক শক্ত শক্ত কথা বলেছেন। যেমন, অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জাতীয় সংসদে তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হয়ে যাঁরা সরকার গঠন করেছেন, ক্ষমতার মেয়াদের অর্ধেকটা পেরোতে না-পেরোতেই তাঁদের ‘অবিলম্বে পদত্যাগ’ করতে বলা
শক্ত কথাই বটে! বেগম জিয়া আরও বললেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া তাঁর দল ও জোট আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না। এটা অবশ্য শক্ত কথা নয়, এমন কথা শুনে কেউ অবাক হবেন না। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া এই দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, কারসাজিমুক্ত, সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে বলেন, তাঁর সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে এবং সব দল সেই নির্বাচনে অংশ নেবে। আমরা ধরে নিতে পারি, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার উত্তর দিলেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া।
কিন্তু একই সঙ্গে খালেদা জিয়া আরও যা বললেন, তা বড্ড শক্ত কথা। সরকার পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের চেষ্টা করছে বলে তিনি সরকারি দলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘পুলিশ বাদ দিয়ে আপনারা আসুন, আমরাও আসি; দেখেন কী হয়।’ এটা বড়ই সাংঘাতিক কথা; শান্তিপ্রিয় নিরীহ জনগণের জন্য ভয়ের কথা! বেগম খালেদা জিয়া অতীতে বলেছেন, বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য আমার ছাত্রদলই যথেষ্ট; কিন্তু এভাবে সরাসরি যুদ্ধের আহ্বান জানানো তাঁর এটাই প্রথম। তাঁর আগে একই কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সরকার বা দলের প্রধান ছিলেন না। এমন হঠকারী কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, যদিও তা কাম্য নয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া তো একজন রাষ্ট্রনেতা, তিনি তো দুই দফায় এ দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কী করে এমন হঠকারী, দায়িত্বহীন, অপরিণামদর্শী কথা প্রকাশ্য জনসভায় উচ্চারণ করতে পারলেন, যা মধ্যযুগীয় গোত্রপ্রধানদের মতো শোনায়? বাংলাদেশ কি হুতু-তুতসিদের দেশ? নাকি মধ্যযুগীয় কোনো গোত্রসমাজ, যেখানে গোত্রপ্রধানদের নির্দেশে বিবদমান গোত্রগুলোর মানুষ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হতো, হাজারে হাজারে প্রাণ হারাত? বেগম খালেদা জিয়া কি তাঁর দলকে একটি গোত্র বলে মনে করেন, যার সদস্যরা তাঁর অপরিণামদর্শী আহ্বানে নিজ নিজ বিচারবুদ্ধি হারিয়ে লাঠিসোঁটা-অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজপথে নেমে আসবেন, ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রতিপক্ষের লোকজনের প্রাণ সংহারের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা করতে গিয়ে নিজেরাও হারাবেন প্রাণ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ?
ধরা যাক, শান্তিপ্রিয় সভ্য মানুষকে সভ্যতার বোধ অবশ করে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে তাঁর দলের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়লেন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। একইভাবে তাঁদের বিরোধীপক্ষেও যুদ্ধংদেহী সশস্ত্র লড়াকুদের অভাব হলো না। অবশ্য আওয়ামী লীগ পুলিশকে বসিয়ে রেখে শুধু তার কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নামিয়ে দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু যদি কল্পনা করে দেখি, কী অবস্থা দাঁড়াবে তাহলে? বাংলাদেশের চেহারা দাঁড়াবে রুয়ান্ডা-বুরুন্ডির মতো। রাজপথের হানাহানি কেবল রাজপথেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে ঘরবাড়ি পর্যন্ত। তারপর কী হবে?
একটু থেমে পেছনে ফিরে চেয়ে দেখি না কেন? আজ বিএনপি ও তার নেতা-নেত্রীরা যে ধরনের হঠকারী কথাবার্তা বলছেন, যেসব নেতিবাচক আচরণ করছেন, বিএনপির সরকারের আমলে বিরোধী আওয়ামী লীগ ও তার নেতা-নেত্রীরাও তা-ই করেছেন। ২০০৬ সালের শেষের দিকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আর সরকারি বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মী-সমর্থকদের কয়েক দিনের মারামারিতেই দেশ হয়ে পড়েছিল অরক্ষিত, জাতি হয়ে পড়েছিল ‘অভিভাবকহীন’। এরপর সামরিক ‘অভিভাবকেরা’ এসে গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত রেলগাড়িটাকে আবার লাইনে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিলেন, সেসবের ফল রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের জন্য কতটা তিক্ত আর কী পীড়াদায়ক হয়েছিল, তা তাঁদের চেয়ে ভালো আর কে উপলব্ধি করতে পারবে?
তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করে কথা বলতে হয়—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেন এই কথাটাই বোঝাতে চাচ্ছে। সরকারি দলের মন্ত্রী-সাংসদ ও অন্য নেতারা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেও মাঝেমধ্যেই এমন কথা উচ্চারিত হচ্ছে, যাতে মনে হয়, বিরোধী জোটকে তাঁরা রাজনৈতিক অংশীদার বলে গণ্যই করেন না। মুখে তাঁরা বলে চলেছেন, বিরোধী দল সংসদে আসুক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এমন আচরণ করছেন, যার ফলে বিরোধী জোট সংসদ বর্জনসহ বিরুদ্ধবাদিতায় আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। বিশেষ করে, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের যে কোনো কার্যকর রাজনৈতিক সম্পর্কই নেই, তার বড় দায়ভার তো সরকারকেই নিতে হয়। সভ্য গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় এমন ঘটনা বিরল, যেখানে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের কোনো যোগাযোগ, মতামতের কোনো আদান-প্রদান থাকবে না, যেখানে বিরোধী দল কেবলই সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম চালাবে, আর সরকার একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আর দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালাবে। পৃথিবীতে এমন গণতান্ত্রিক দেশ বিরল, যেখানে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই পরাজিত দল সরকারের পতন ঘটানোর ফন্দি-ফিকির খুঁজতে আরম্ভ করে দেবে, আর সরকারবিরোধী দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে সর্বতোভাবে অগ্রাহ্য করে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণার পর আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধছে, সরকার সেটা মোটেই আমলে নিতে চাইছে না বলে মনে হচ্ছে। আদালতের রায় ঘোষণার পর থেকে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো বলে আসছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। এটা যে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন অবস্থায় এখন থেকেই বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন। দুই নেতাকে এক টেবিলে মুখোমুখি বসেই যে আলোচনা করতে হবে, এমন নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে আলোচনা হতে পারে। উভয় পক্ষ বিভিন্ন উপলক্ষে জনগণকে সাক্ষী মেনে গণমাধ্যমে পরস্পরের উদ্দেশে যেসব কথাবার্তা বলছে, সেগুলো নিয়ে তারা সরাসরি নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করতে পারে। কিন্তু কোনো পক্ষেই তেমন মনোভাবের লেশমাত্র নেই। সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি, কারণ, সব দল যাতে নির্বাচনে অংশ নেয়, নির্বাচন যেন সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সে ব্যবস্থা তো সরকারকেই করতে হবে। এ জন্য আলোচনায় বসার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে বললেন, চোর-বাটপারদের সঙ্গে বসে কী হবে? এ বড়ই দুঃখের কথা। কোনো রাষ্ট্রনেতার মুখে এমন কথা একদমই মানায় না। এ ধরনের কথা বলে রাজনৈতিক সংকটকে কেবল প্রকটতার দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানার চেষ্টা করেছেন, তাঁর দলের মন্ত্রী-নেতাদের এক বিরাট অংশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কী? নিজের দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো আদালত পর্যন্ত যেতে না দিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে, রাখা হয়েছে শুধু বিরোধী দলের নেতাদের দুর্নীতির মামলা। স্বয়ং দুদকের চেয়ারম্যানের ভাষায়, দুর্নীতি দমন কমিশনকে করে ফেলা হয়েছে নখদন্তহীন। এমন অবস্থায় নিজেদের নিষ্কলুষ আর বিরোধীদের চোর-বাটপার বলে তাচ্ছিল্য করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আছে বরং বিনয়ের প্রচণ্ড অভাব, যেমন বিনয় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়।
ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের শিক্ষা শুধু এই নয় যে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও হঠকারী আচরণের ফলে কেবল নিজেদেরই বিপদে পড়তে হয়। শিক্ষাটি হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার গণতান্ত্রিক পন্থা বাদ দিয়ে বলপ্রয়োগের কৌশলকেই রাজনৈতিক সাফল্যের দর্শন হিসেবে বিশ্বাস করলে বিপন্ন হয় গোটা দেশ, পুরো জাতি। ৪০ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা কোনো রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেনি—এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর নেই!
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
কিন্তু একই সঙ্গে খালেদা জিয়া আরও যা বললেন, তা বড্ড শক্ত কথা। সরকার পুলিশ দিয়ে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের চেষ্টা করছে বলে তিনি সরকারি দলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘পুলিশ বাদ দিয়ে আপনারা আসুন, আমরাও আসি; দেখেন কী হয়।’ এটা বড়ই সাংঘাতিক কথা; শান্তিপ্রিয় নিরীহ জনগণের জন্য ভয়ের কথা! বেগম খালেদা জিয়া অতীতে বলেছেন, বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য আমার ছাত্রদলই যথেষ্ট; কিন্তু এভাবে সরাসরি যুদ্ধের আহ্বান জানানো তাঁর এটাই প্রথম। তাঁর আগে একই কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, সরকার বা দলের প্রধান ছিলেন না। এমন হঠকারী কথা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে, যদিও তা কাম্য নয়। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া তো একজন রাষ্ট্রনেতা, তিনি তো দুই দফায় এ দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কী করে এমন হঠকারী, দায়িত্বহীন, অপরিণামদর্শী কথা প্রকাশ্য জনসভায় উচ্চারণ করতে পারলেন, যা মধ্যযুগীয় গোত্রপ্রধানদের মতো শোনায়? বাংলাদেশ কি হুতু-তুতসিদের দেশ? নাকি মধ্যযুগীয় কোনো গোত্রসমাজ, যেখানে গোত্রপ্রধানদের নির্দেশে বিবদমান গোত্রগুলোর মানুষ রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামায় লিপ্ত হতো, হাজারে হাজারে প্রাণ হারাত? বেগম খালেদা জিয়া কি তাঁর দলকে একটি গোত্র বলে মনে করেন, যার সদস্যরা তাঁর অপরিণামদর্শী আহ্বানে নিজ নিজ বিচারবুদ্ধি হারিয়ে লাঠিসোঁটা-অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাজপথে নেমে আসবেন, ঝাঁপিয়ে পড়বেন প্রতিপক্ষের লোকজনের প্রাণ সংহারের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা করতে গিয়ে নিজেরাও হারাবেন প্রাণ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ?
ধরা যাক, শান্তিপ্রিয় সভ্য মানুষকে সভ্যতার বোধ অবশ করে দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে তাঁর দলের বেশ কিছুসংখ্যক সদস্য রাস্তায় রাস্তায় নেমে পড়লেন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। একইভাবে তাঁদের বিরোধীপক্ষেও যুদ্ধংদেহী সশস্ত্র লড়াকুদের অভাব হলো না। অবশ্য আওয়ামী লীগ পুলিশকে বসিয়ে রেখে শুধু তার কর্মী-সমর্থকদের রাস্তায় নামিয়ে দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু যদি কল্পনা করে দেখি, কী অবস্থা দাঁড়াবে তাহলে? বাংলাদেশের চেহারা দাঁড়াবে রুয়ান্ডা-বুরুন্ডির মতো। রাজপথের হানাহানি কেবল রাজপথেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে ঘরবাড়ি পর্যন্ত। তারপর কী হবে?
একটু থেমে পেছনে ফিরে চেয়ে দেখি না কেন? আজ বিএনপি ও তার নেতা-নেত্রীরা যে ধরনের হঠকারী কথাবার্তা বলছেন, যেসব নেতিবাচক আচরণ করছেন, বিএনপির সরকারের আমলে বিরোধী আওয়ামী লীগ ও তার নেতা-নেত্রীরাও তা-ই করেছেন। ২০০৬ সালের শেষের দিকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ আর সরকারি বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মী-সমর্থকদের কয়েক দিনের মারামারিতেই দেশ হয়ে পড়েছিল অরক্ষিত, জাতি হয়ে পড়েছিল ‘অভিভাবকহীন’। এরপর সামরিক ‘অভিভাবকেরা’ এসে গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত রেলগাড়িটাকে আবার লাইনে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব পদক্ষেপ নিলেন, সেসবের ফল রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের জন্য কতটা তিক্ত আর কী পীড়াদায়ক হয়েছিল, তা তাঁদের চেয়ে ভালো আর কে উপলব্ধি করতে পারবে?
তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করে কথা বলতে হয়—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেন এই কথাটাই বোঝাতে চাচ্ছে। সরকারি দলের মন্ত্রী-সাংসদ ও অন্য নেতারা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠেও মাঝেমধ্যেই এমন কথা উচ্চারিত হচ্ছে, যাতে মনে হয়, বিরোধী জোটকে তাঁরা রাজনৈতিক অংশীদার বলে গণ্যই করেন না। মুখে তাঁরা বলে চলেছেন, বিরোধী দল সংসদে আসুক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এমন আচরণ করছেন, যার ফলে বিরোধী জোট সংসদ বর্জনসহ বিরুদ্ধবাদিতায় আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। বিশেষ করে, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের যে কোনো কার্যকর রাজনৈতিক সম্পর্কই নেই, তার বড় দায়ভার তো সরকারকেই নিতে হয়। সভ্য গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় এমন ঘটনা বিরল, যেখানে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের কোনো যোগাযোগ, মতামতের কোনো আদান-প্রদান থাকবে না, যেখানে বিরোধী দল কেবলই সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম চালাবে, আর সরকার একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী আর দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন চালাবে। পৃথিবীতে এমন গণতান্ত্রিক দেশ বিরল, যেখানে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই পরাজিত দল সরকারের পতন ঘটানোর ফন্দি-ফিকির খুঁজতে আরম্ভ করে দেবে, আর সরকারবিরোধী দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে সর্বতোভাবে অগ্রাহ্য করে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষণার পর আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধছে, সরকার সেটা মোটেই আমলে নিতে চাইছে না বলে মনে হচ্ছে। আদালতের রায় ঘোষণার পর থেকে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলো বলে আসছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। এটা যে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন অবস্থায় এখন থেকেই বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ হওয়া প্রয়োজন। দুই নেতাকে এক টেবিলে মুখোমুখি বসেই যে আলোচনা করতে হবে, এমন নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে আলোচনা হতে পারে। উভয় পক্ষ বিভিন্ন উপলক্ষে জনগণকে সাক্ষী মেনে গণমাধ্যমে পরস্পরের উদ্দেশে যেসব কথাবার্তা বলছে, সেগুলো নিয়ে তারা সরাসরি নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করতে পারে। কিন্তু কোনো পক্ষেই তেমন মনোভাবের লেশমাত্র নেই। সরকারি দলের দায়িত্ব বেশি, কারণ, সব দল যাতে নির্বাচনে অংশ নেয়, নির্বাচন যেন সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, সে ব্যবস্থা তো সরকারকেই করতে হবে। এ জন্য আলোচনায় বসার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে অবস্থানকালে এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী দলকে ইঙ্গিত করে বললেন, চোর-বাটপারদের সঙ্গে বসে কী হবে? এ বড়ই দুঃখের কথা। কোনো রাষ্ট্রনেতার মুখে এমন কথা একদমই মানায় না। এ ধরনের কথা বলে রাজনৈতিক সংকটকে কেবল প্রকটতার দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি জানার চেষ্টা করেছেন, তাঁর দলের মন্ত্রী-নেতাদের এক বিরাট অংশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা কী? নিজের দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাগুলো আদালত পর্যন্ত যেতে না দিয়ে প্রত্যাহার করা হয়েছে, রাখা হয়েছে শুধু বিরোধী দলের নেতাদের দুর্নীতির মামলা। স্বয়ং দুদকের চেয়ারম্যানের ভাষায়, দুর্নীতি দমন কমিশনকে করে ফেলা হয়েছে নখদন্তহীন। এমন অবস্থায় নিজেদের নিষ্কলুষ আর বিরোধীদের চোর-বাটপার বলে তাচ্ছিল্য করার মধ্যে কোনো গৌরব নেই। আছে বরং বিনয়ের প্রচণ্ড অভাব, যেমন বিনয় রাষ্ট্রনেতাদের কাছে প্রত্যাশা করা হয়।
ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। ইতিহাসের শিক্ষা শুধু এই নয় যে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও হঠকারী আচরণের ফলে কেবল নিজেদেরই বিপদে পড়তে হয়। শিক্ষাটি হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার গণতান্ত্রিক পন্থা বাদ দিয়ে বলপ্রয়োগের কৌশলকেই রাজনৈতিক সাফল্যের দর্শন হিসেবে বিশ্বাস করলে বিপন্ন হয় গোটা দেশ, পুরো জাতি। ৪০ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে এই শিক্ষা কোনো রাজনৈতিক দলই গ্রহণ করেনি—এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর নেই!
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments