স্মৃতিচারণা-‘বড় হয়েছি মুক্তবিহঙ্গের মতো’ by এবিএম মূসা

শৈশব ফেনী জেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামে আমি জন্মেছিলাম। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হওয়ায় আর পর পর আরও ভাইবোন হওয়ায় আমাকে অল্প বয়সেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় নানার বাড়িতে। শুনেছি, আমি যখন জন্মেছি, তখন মায়ের বয়স ১৪ কি ১৫ হবে। নানার বাড়িতে মামি লালন-পালন করতেন আমাকে। সেখানেই বোর্ড স্কুলে পড়াশোনা করতাম। মনে আছে, একজন মাত্র পণ্ডিত মশাই ক্লাস ফোর পর্যন্ত আমাদের সবাইকে পড়াতেন। ক্লাসরুমও ছিল একটি।


আমরা সকালে স্কুলে যেতাম, পণ্ডিত মশাই আমাদের দুপুর পর্যন্ত পড়াতেন, কখনো ঝিমোতেন। এভাবে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়ার পর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা বদলি হলেন চট্টগ্রামে। ভর্তি হলাম চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে। মনে আছে, ফেনী থেকে নিয়মিত চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করতাম। আমি ফেনী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সব স্টেশনের নাম একে একে মুখস্থ বলতে পারতাম। আমার এখন এই বয়সেও সব নাম মনে আছে। মনে হয়, ছোটবেলায় মুখস্থ করার অভ্যাস গড়ে তুললে স্মরণশক্তি বাড়ে। পরবর্তী জীবনে সব সময়ই আমার স্মরণশক্তি ভালো ছিল।

যেভাবে বেড়ে উঠি
স্কুলে পড়াশোনা করার সময় বা শৈশবে আমরা অনেক খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছি। পাঠ্যবই ও পুস্তকের বাইরে আমরা নানা ধরনের বই পড়তাম। খেলাধুলা করতাম। মনে আছে, চট্টগ্রামে যখন স্কুলে পড়ি তখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে অনেক বই পড়তাম। আসলে বই পড়তে উৎসাহিত করার মতো পরিবেশ ছিল। ক্লাসে একটি আলমারিতে নানা ধরনের বই থাকত। লালদীঘির দক্ষিণ পাশে একটা পাঠাগার ছিল। সেখানে পূর্বাশা, প্রবাসী এসব ম্যাগাজিন পাওয়া যেত; পাওয়া যেত দেব সাহিত্য কুটিরের বাচ্চাদের বই। পাঠাগারে বসে এসব বই পড়তাম। কলকাতা থেকে আসত দৈনিক বসুমতী ও অমৃতবাজার পত্রিকা। আমাদের শৈশব ঘরে আটকানো ছিল না। নানা কিছু করতাম আমরা। বলা যায়, মুক্তবিহঙ্গের মতো কৈশোর কেটেছে আমাদের।
এখন শিশুদের জীবন যেন সামরিক জীবন, শৃঙ্খলিত। আমাদের শৈশব যত আনন্দময় ছিল, এখন তা নেই। আমরা খেলাধুলা করতাম, পড়াশোনার বাইরে যাকে বলে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ, তা করতাম। এতে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন সে ধরনের সুযোগ কমে গেছে। এখন পাঠ্যপুস্তক আর লেখাপড়ার চাপ বেশি। বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ হোক, সেদিকে নজর নেই। আমাদের সময় ক্লাসে অল্প কিছু ছেলেমেয়ে থাকত, যারা ভালো ফল করত বা তাদের লক্ষ্য ছিল ভালো ফল করা। আর সবাই সাধারণ পড়াশোনা করত। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে সবাইকেই জিপিএ-৫ পেতে হবে। স্কুলে পড়ার চাপ, এরপর আবার সেই পড়া নিয়েই স্কুলের বাইরে কোচিং—এসব নিয়েই শিশুদের দিন কেটে যায়। অন্য কিছু করার সুযোগই পায় না তারা। আমাদের সময় পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার ছিল, ব্যায়ামাগার ছিল, খেলার মাঠ ছিল। প্রতি পাড়ায় ছিল পুকুর। আজকাল কোনো শিশু ইচ্ছা করলেও পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যেতে পারে না। কংক্রিটের বস্তিতে বাস করে তারা। অর্থনৈতিক চাপও বেড়ে গেছে। আমি ছোটবেলায় নামাজ বা কোরআন শরিফ পড়েছি বাবা-মায়ের কাছে। অ আ ক খ শিখেছি পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে। যে আদর ও যত্ন দিয়ে শুরু হতো আমাদের জীবন, এখন তা হচ্ছে না।

তখন আদর্শ ছিল
সমাজে ও রাজনৈতিক জীবনে যে পরিবর্তনটি আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তা হচ্ছে, আগে আমরা সব ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো অভিভাবকের নির্দেশ, মত, পরামর্শ বা প্রভাবে পরিচালিত হতাম। আমাদের পেছনে সব সময়ই কেউ না কেউ থাকত আদর্শ হিসেবে, তাদের সরাসরি বা পরোক্ষ প্রভাব আমাদের ওপর কাজ করত। আমরা সে অনুযায়ী পরিচালিত হতাম। বিষয়টি অনেকটা গুরু-শিষ্যের মতো। এখন সেই বিষয়টি নেই। এমনকি মুসলিম লীগ আমলের কথাও যদি ধরি, তখন আমরা যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পেরেছি, তাঁদের দ্বারা আমরা নানাভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আগে নেতারা রাজনীতি করতেন আদর্শের জন্য। কর্মীরাও সেই নেতাদের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাঁদের পেছনে রাজনীতি করতেন। এখন নেতারা রাজনীতি করেন টাকাপয়সা বানানোর জন্য। ভোগবাদী, লোভী ও আদর্শহীন নেতাদের পেছনে তাই আদর্শবান কর্মী গড়ে ওঠার কোনো সুযোগ নেই। শুধু রাজনীতি নয়, সব ক্ষেত্রেই এমনটি ছিল। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও আদর্শস্থানীয় অনেকে ছিলেন, যাঁদের আমরা অনুসরণ করেছি, যাঁদের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়েছি। আগে যে একটা আদর্শবাদী ও ভাববাদী অবস্থান ছিল আমাদের সমাজে, তা থেকে এখন আমরা বস্তুবাদী জীবনদর্শনে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

যা দেখতে চাই
আমি এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। নিজের জন্য চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। আমার প্রত্যাশা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। বিষয়টি একটু ভিন্নভাবে বলি। আমার দাদা মক্তবের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ইংরেজদের শাসনে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছিলেন। তিনি আমার বাবাকে বলেছিলেন, ইংরেজদের খেদাও। আমাদের বাবারা দাদাদের কথা শুনে ইংরেজ খেদিয়ে পাকিস্তান বানিয়েছিলেন। দুই বছর যেতে না-যেতেই তাঁরা বুঝলেন এটা কেমন স্বাধীনতা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের পরিবর্তে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন। আমাদের বাবারা এই অবস্থা থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে বলেছিলেন। আমরা তা করেছি। আজ ৪০ বছর পর ভাবছি, আমাদের তো আর যাওয়ার জায়গা নেই। ব্রিটিশরা গেছে, পাকিস্তানিরা গেছে। আমাদের সন্তানদের কাছে আমার চাওয়া হচ্ছে, যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম, তারা সেটা বাস্তবায়ন করুক।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, ছেষট্টির ছয় দফা ও ঊনসত্তরে ছাত্রদের ১১ দফার মধ্যে আছে আমাদের সেই স্বপ্ন। আমরা যেমন আমাদের পিতা ও পিতামহের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি, আমার আশা, আমাদের সন্তান ও নাতিরা সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। আমরা হয়তো অনেক সময় নিয়েছি, কিন্তু আমাদের সন্তানেরা তা অল্প সময়েই করতে পারবে।
অনুলিখন: এ কে এম জাকারিয়া।

No comments

Powered by Blogger.