স্মৃতিচারণা-এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা by দ্বিজেন শর্মা
শৈশব পাঠশালার অঙ্গনে তখনো পা পড়েনি। মা ভোরবেলা ঘুম ভাঙিয়ে প্রার্থনায় বসাতেন, শুরু করতেন সূর্যমন্ত্র দিয়ে: ‘জবাকুসুম সংকাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং...।’ কিছু না বুঝলেও ছন্দের একটা রেশ লেগে থাকত অনেকক্ষণ। স্বদেশি আন্দোলনের যুগ চলছিল। শিক্ষকেরা দেশপ্রেমেও উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন। প্রাতঃকালীন সংবৃত মন্ত্রের জায়গাটি একদিন দখল করে নিল ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ পঙিক্তমালা। শুনে মা বললেন, যেন আশীর্বাদ করলেন, ‘দেশপ্রেমিক হও’।
নবম শ্রেণীতে চলে গেলাম শহরের স্কুলে। গান্ধীর জায়গায় এলেন নেতাজি। আজাদ হিন্দ ফৌজের আলোড়ন চলছে তখন, সবার মুখে ‘কদম কদম বাড়য়ে যা’, ‘চল দিল্লি চল’। নেতাজি, শাহেনওয়াজ ধীলন, রশিদ আলী, লক্ষ্মী বাইয়ের ছবি লাগালাম পড়ার ঘরের দেয়ালে। এই ঘোর থাকল কিছুদিন। তারপর হাতে এল নীহার কুমার সরকারের ছোটদের রাজনীতি। পাল্টে গেল আগেকার চিন্তাভাবনা। পড়লাম ইতিহাসের ধারা, মার্ক্সবাদ। বুঝলাম সমাজ বিবর্তনের ধারা, বিসর্জন দিলাম পিতৃদত্ত পইতা। জীবনের ভরকেন্দ্র বদলে গেল। গান্ধী শিখিয়েছিলেন সরল জীবনযাত্রা ও অহিংসা, মার্ক্স শেখালেন শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লব। ম্যান্ডেলীয় বংশগতিসূত্রের নিয়মের মতো দ্বিতীয়টি প্রকট হলেও প্রচ্ছন্ন থাকল প্রথমটি, বিলুপ্ত হলো না। বিএসসি পাস করার পর মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে চাইলেন, পালালাম বাড়ি থেকে। তত দিনে বুর্জোয়া শিক্ষার অসারতা মনে গেঁথে গেছে। বরিশাল বিএম কলেজে মাস্টারি নিলাম। ভাবলাম, ছাত্রদের সমাজতন্ত্র শেখাব, কিন্তু বাদ সাধল পাকিস্তানের বাস্তব অবস্থা। অগত্যা বই পড়া শুরু করলাম। অঢেল বাড়তি সময়। কলেজের বিশাল লাইব্রেরি। পড়লাম নানা ধরনের কত বই—রাজনীতি, ইতিহাস, বাদ গেল না জীববিদ্যাও।
যেভাবে বেড়ে উঠি
বছর দুই কাটল এবং বুঝতে পারলাম, কলেজে শিক্ষকতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আবশ্যক। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেছে নিলাম উদ্ভিদবিদ্যা। এটা ছিল জীবনের ভরকেন্দ্রের আরেকটি শিফট। অচিরেই বুঝতে পারলাম, এত দিনে পণ্ডিত হওয়ার বদলে হয়েছি পণ্ডিতম্মন্য। ইতিহাস, রাজনীতি বাদ দিলাম, নিজের পাঠ্যবিষয়টিও যে এতটা বিস্তৃত ও শাখাবিভক্ত, আগে তা বুঝতে পারিনি। ইংরেজি, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যার চৌকস ছাত্রদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে নিজের পল্লবগ্রাহিতা টের পাই, শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিধি দেখে অবাক হই। ঠিক করলাম বিশেষজ্ঞ হব। জীবনের অঙ্গনে আলো ফেললেন ডারউইন পাঠ্যবইয়ের পাতা থেকে, তাঁকে বসালাম মার্ক্সের পাশে। ঠিক করলাম ডারউইন-ঘেঁষা কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করব। বিদেশে চিঠিপত্র লেখা শুরু হলো, একজন গুরুও জুটে গেলেন। বিষয় নির্বাচিত হলো এক্সপেরিমেন্টাল টেক্সোনমি। কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী জুটল না, বড়ই আঘাত পেলাম। ফিরে গেলাম পুরোনো কলেজে। উদ্ভিদবিদ্যার স্নাতক কোর্স খুলে ছাত্রছাত্রীদের টেক্সোনমি বোঝানোর জন্য বনবাদাড়ে নিয়ে ঘোরা শুরু হলো, হার্বেরিয়ামের সংগ্রহ বাড়তে লাগল এবং সেই সঙ্গে বিদেশযাত্রার স্বপ্নও। কিন্তু সবকিছু ভেস্তে গেল ১৯৬২ সালের ছাত্র-বিক্ষোভে, মাস কয়েক কাটল জেলে, তারপর বছর খানেক পুলিশি নজরদারিতে। হলো না বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা, বাকি জীবনের জন্য আটকা পড়ে গেলাম পল্লবগ্রাহিতার ফাঁদে এবং এখনো তা-ই আছি।
চোরাপথে ভারতে গিয়ে গবেষণাটি শেষ করা যেত, কিন্তু এই সহজ বিকল্প মনে এল না। চলে এলাম ঢাকার নটর ডেম কলেজে এবং লিখতে লেগে গেলাম ঢাকার পথতরুর ইতিবৃত্ত শ্যামলা নিসর্গ—কিন্তু কেন? উত্তর আজও জানি না। বইটি শেষ হলে আবার ফিরে এল বিশেষজ্ঞ হওয়ার বাসনা। সহায় হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, বিষয় ঠিক হলো পূর্ব বাংলার ক্যারোফাইটা। টেক্সোনমি থাকল, বাদ পড়ল এক্সপেরিমেন্টাল আর সেই সঙ্গে ডারউইনের প্রস্থান ও লিনিয়ামের প্রবেশ। আসলে তা নয়, লিনিয়ানের তৈরি জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাস ছিল বিবর্তনের যথার্থ প্রমাণে ডারউইনের বড় সহায়। ক্যারোফাইটা একটি জলজ শৈবাল ও জলমগ্ন থাকে সারা বছর। ঘুরে বেড়াতে লাগলাম নদীনালা ও হাওর-বাঁওড়। ফাদার টিম তাঁর ল্যাব আমাকে ছেড়ে দিলেন। কাজ করতাম ছুটির দুই দিন—শনি ও রবি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, কর্মদিবসে ফাঁকফোকরে। কিন্তু কাজটা শেষ করতে পারলাম না। চলে গেলাম রাশিয়ায় ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে।
রাশিয়ায় যাওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল: সমাজতন্ত্রে বসবাস, ডারউইন জাদুঘর ও মার্ক্সের সমাধি প্রব্রজ্যা, বইয়ে পড়া কিউ গার্ডেন ও ভার্সাই উদ্যান দেখা। তাড়া ছিল এ জন্য যে সম্ভবত ইউরোপ দেখার এটাই আমার শেষ সুযোগ। বিদেশবাস আমার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই অশেষ সুফলপ্রদ হয়েছিল। অনুবাদসূত্রে মার্ক্স-এঙ্গেলস ও লেনিনের কিছু মৌলিক রচনা পড়তে পেরেছিলাম, ডারউইনের জন্মস্থান ও কর্মস্থল থেকে ভবিষ্যৎ কাজকর্মের জন্য প্রভূত অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম, লন্ডন ও প্যারিসের পার্কগুলোর সৌন্দর্য উদ্যানশিল্পে আবিষ্ট করেছিল, নিত্যদিনের অনুবাদকর্মের সুবাদে গদ্যরচনার প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল এবং সর্বোপরি পশ্চিমের ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমাজজীবনের ফারাক প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালের লেখায় এসব অভিজ্ঞতা আমাকে পর্যাপ্ত সহায়তা জুগিয়েছে এবং সব কূপমণ্ডূকতা থেকে আমাকে মুক্ত রেখেছে। সমাজতন্ত্রের পতন ও পরবর্তী পরিবর্তনগুলো দেখা দুঃসহ হলেও আমার জন্য ছিল এক দুর্লভ সৌভাগ্যও।
১৯৭২ সালে প্রগতি প্রকাশনের কাজকর্ম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়ি এবং মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিই। এতেও আমার লাভের পুঁজি ভারী হয়েছে। স্কুলশিক্ষকতায় এখানেই হাতেখড়ি। শিশুমন ও তাদের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হয়েছিল এবং কিছু পরীক্ষার চেষ্টাও করেছিলাম। এ জগৎ বড়ই কৌতূহলোদ্দীপক, তবে তাতে নির্বিশেষ আত্মোৎসর্গ প্রয়োজন। ইতিপূর্বে অনেক বছর কলেজে শিক্ষকতা করেছি, কিছু লিখেছিও। ফলে একটা ভিত্তি তৈরি হয়েও ছিল। বছর দুই সেখানে ছিলাম, কিন্তু ছাত্রাভাবে একসময় সেটি বন্ধ হয়ে যায়। উচিত ছিল দেশে ফিরে এ ধরনের কোনো স্কুলে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রকৃতির মাঝখানে শিক্ষকতা; কিন্তু তত দিনে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে আর বাস্তবতাও ছিল প্রতিকূল।
ওরে বিহঙ্গ
দেশে ফিরি ১৯৯৫ সালে। তারপর পেনশন ও স্থায়ী স্টে-পারমিটের আশায় ২০০০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত মস্কো যাতায়াত করেছি—কখনো ছয় মাস, কখনো এক বছর থেকেছি, লাভ হয়নি কিছুই। শেষে ওদিক আর বাড়াইনি। অগত্যা পরিবেশসংকট নিয়ে আবার লিখতে শুরু করি এবং ক্রমে এই সত্য স্বচ্ছতর হতে থাকে যে মার্ক্স ও ডারউইনকে বাদ দিয়ে জায়মান এই সংকটের পূর্বাপর বোঝা ও নিরসনের পথ খোঁজা বৃথা। এই সংকটের কেন্দ্রে আছে মানুষ এবং সেই যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের হোতা। গোটা জীবজগতের সঙ্গে মানুষের উৎপত্তির প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন ডারউইন আর সমাজ বিকাশের সূত্রগুলো মার্ক্স—দুটিই বস্তুত পরস্পরজড়িত, যে জন্য একদা সামাজিক ডারউইনবাদের উদ্ভব। জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের যেসব উপাত্ত ডারউইন উদ্ঘাটন করেছেন, তাতে আছে জীবের অত্যধিক বংশবৃদ্ধির প্রবণতা, প্রকৃতির সীমিত খাদ্যভান্ডার। ফলে ‘জীবনের জন্য সংগ্রাম’ এবং অযোগ্যের বিলুপ্তি ও যোগ্যতরের উদ্বর্তন। এটি ঘটে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ার আওতায় আর মানুষ তা অতিক্রম করেছে উন্নত মস্তিষ্কের কল্যাণে। ধর্ম মানুষকে প্রেম ও নৈতিকতা শেখাতে চেয়েছে, বিজ্ঞান জুগিয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপাত্তগুলো, অর্থাৎ অত্যধিক বংশবৃদ্ধি খাদ্যাভাব, নিত্যদিনের সংগ্রাম ও যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, কিন্তু মানুষ সেগুলো গ্রহণ করেনি। কেন করেনি এবং কীভাবে করা সম্ভব, তা দেখিয়েছেন মার্ক্স। এই দুটি তত্ত্বের আলোকে পরিবেশসংকট নিয়ে একটি বই লিখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখানেও দেরি হয়ে গেল। তাতে ক্ষতি নেই, পশ্চিমে এমন বই হয়তো লেখা হয়ে গেছে বা অচিরেই হবে। বেলামি ফস্টারের মার্ক্স একোলজি বইটি পড়েছি, কিন্তু যথেষ্ট মনে হয়নি, মার্ক্সের সময় প্রকৃতি ও পরিবেশ আজকের মতো এতটা বিপর্যস্ত হয়নি। মার্ক্স কমিউনিজমে মানুষ ও প্রকৃতি—উভয়ের শোষণলুপ্তি আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সে তো দীর্ঘ সময়ের বিষয়। প্রকৃতি এখন সরোষে প্রত্যাঘাতে উদ্যত, আমাদের এতটা সময় আর মঞ্জুর করবে না। পশ্চিমের পরিবেশবাদীরা সমস্যা সমাধানের হাস্যকর সব ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন, তাতে নির্বাচনে ‘ভালো মানুষকে’ ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার কথাও আছে। কিন্তু নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতা মেলে না। ব্যাপারটি বহুগুণ কঠিন, দুঃসাধ্যও বলা যায়। বালককালে রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ কবিতাটি আবৃত্তি করতাম, তারই কয়েক পঙিক্ত মনে পড়ছে: ‘উষা-দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা। ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/ এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।’
যেভাবে বেড়ে উঠি
বছর দুই কাটল এবং বুঝতে পারলাম, কলেজে শিক্ষকতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আবশ্যক। ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বেছে নিলাম উদ্ভিদবিদ্যা। এটা ছিল জীবনের ভরকেন্দ্রের আরেকটি শিফট। অচিরেই বুঝতে পারলাম, এত দিনে পণ্ডিত হওয়ার বদলে হয়েছি পণ্ডিতম্মন্য। ইতিহাস, রাজনীতি বাদ দিলাম, নিজের পাঠ্যবিষয়টিও যে এতটা বিস্তৃত ও শাখাবিভক্ত, আগে তা বুঝতে পারিনি। ইংরেজি, অর্থনীতি, সমাজবিদ্যার চৌকস ছাত্রদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে নিজের পল্লবগ্রাহিতা টের পাই, শিক্ষকদের জ্ঞানের পরিধি দেখে অবাক হই। ঠিক করলাম বিশেষজ্ঞ হব। জীবনের অঙ্গনে আলো ফেললেন ডারউইন পাঠ্যবইয়ের পাতা থেকে, তাঁকে বসালাম মার্ক্সের পাশে। ঠিক করলাম ডারউইন-ঘেঁষা কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা করব। বিদেশে চিঠিপত্র লেখা শুরু হলো, একজন গুরুও জুটে গেলেন। বিষয় নির্বাচিত হলো এক্সপেরিমেন্টাল টেক্সোনমি। কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী জুটল না, বড়ই আঘাত পেলাম। ফিরে গেলাম পুরোনো কলেজে। উদ্ভিদবিদ্যার স্নাতক কোর্স খুলে ছাত্রছাত্রীদের টেক্সোনমি বোঝানোর জন্য বনবাদাড়ে নিয়ে ঘোরা শুরু হলো, হার্বেরিয়ামের সংগ্রহ বাড়তে লাগল এবং সেই সঙ্গে বিদেশযাত্রার স্বপ্নও। কিন্তু সবকিছু ভেস্তে গেল ১৯৬২ সালের ছাত্র-বিক্ষোভে, মাস কয়েক কাটল জেলে, তারপর বছর খানেক পুলিশি নজরদারিতে। হলো না বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা, বাকি জীবনের জন্য আটকা পড়ে গেলাম পল্লবগ্রাহিতার ফাঁদে এবং এখনো তা-ই আছি।
চোরাপথে ভারতে গিয়ে গবেষণাটি শেষ করা যেত, কিন্তু এই সহজ বিকল্প মনে এল না। চলে এলাম ঢাকার নটর ডেম কলেজে এবং লিখতে লেগে গেলাম ঢাকার পথতরুর ইতিবৃত্ত শ্যামলা নিসর্গ—কিন্তু কেন? উত্তর আজও জানি না। বইটি শেষ হলে আবার ফিরে এল বিশেষজ্ঞ হওয়ার বাসনা। সহায় হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, বিষয় ঠিক হলো পূর্ব বাংলার ক্যারোফাইটা। টেক্সোনমি থাকল, বাদ পড়ল এক্সপেরিমেন্টাল আর সেই সঙ্গে ডারউইনের প্রস্থান ও লিনিয়ামের প্রবেশ। আসলে তা নয়, লিনিয়ানের তৈরি জীবজগতের শ্রেণীবিন্যাস ছিল বিবর্তনের যথার্থ প্রমাণে ডারউইনের বড় সহায়। ক্যারোফাইটা একটি জলজ শৈবাল ও জলমগ্ন থাকে সারা বছর। ঘুরে বেড়াতে লাগলাম নদীনালা ও হাওর-বাঁওড়। ফাদার টিম তাঁর ল্যাব আমাকে ছেড়ে দিলেন। কাজ করতাম ছুটির দুই দিন—শনি ও রবি, সকাল থেকে সন্ধ্যা, কর্মদিবসে ফাঁকফোকরে। কিন্তু কাজটা শেষ করতে পারলাম না। চলে গেলাম রাশিয়ায় ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে।
রাশিয়ায় যাওয়ার অনেকগুলো কারণ ছিল: সমাজতন্ত্রে বসবাস, ডারউইন জাদুঘর ও মার্ক্সের সমাধি প্রব্রজ্যা, বইয়ে পড়া কিউ গার্ডেন ও ভার্সাই উদ্যান দেখা। তাড়া ছিল এ জন্য যে সম্ভবত ইউরোপ দেখার এটাই আমার শেষ সুযোগ। বিদেশবাস আমার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই অশেষ সুফলপ্রদ হয়েছিল। অনুবাদসূত্রে মার্ক্স-এঙ্গেলস ও লেনিনের কিছু মৌলিক রচনা পড়তে পেরেছিলাম, ডারউইনের জন্মস্থান ও কর্মস্থল থেকে ভবিষ্যৎ কাজকর্মের জন্য প্রভূত অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম, লন্ডন ও প্যারিসের পার্কগুলোর সৌন্দর্য উদ্যানশিল্পে আবিষ্ট করেছিল, নিত্যদিনের অনুবাদকর্মের সুবাদে গদ্যরচনার প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল এবং সর্বোপরি পশ্চিমের ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমাজজীবনের ফারাক প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম। পরবর্তীকালের লেখায় এসব অভিজ্ঞতা আমাকে পর্যাপ্ত সহায়তা জুগিয়েছে এবং সব কূপমণ্ডূকতা থেকে আমাকে মুক্ত রেখেছে। সমাজতন্ত্রের পতন ও পরবর্তী পরিবর্তনগুলো দেখা দুঃসহ হলেও আমার জন্য ছিল এক দুর্লভ সৌভাগ্যও।
১৯৭২ সালে প্রগতি প্রকাশনের কাজকর্ম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে পড়ি এবং মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসের স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দিই। এতেও আমার লাভের পুঁজি ভারী হয়েছে। স্কুলশিক্ষকতায় এখানেই হাতেখড়ি। শিশুমন ও তাদের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হয়েছিল এবং কিছু পরীক্ষার চেষ্টাও করেছিলাম। এ জগৎ বড়ই কৌতূহলোদ্দীপক, তবে তাতে নির্বিশেষ আত্মোৎসর্গ প্রয়োজন। ইতিপূর্বে অনেক বছর কলেজে শিক্ষকতা করেছি, কিছু লিখেছিও। ফলে একটা ভিত্তি তৈরি হয়েও ছিল। বছর দুই সেখানে ছিলাম, কিন্তু ছাত্রাভাবে একসময় সেটি বন্ধ হয়ে যায়। উচিত ছিল দেশে ফিরে এ ধরনের কোনো স্কুলে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রকৃতির মাঝখানে শিক্ষকতা; কিন্তু তত দিনে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে আর বাস্তবতাও ছিল প্রতিকূল।
ওরে বিহঙ্গ
দেশে ফিরি ১৯৯৫ সালে। তারপর পেনশন ও স্থায়ী স্টে-পারমিটের আশায় ২০০০ সাল পর্যন্ত নিয়মিত মস্কো যাতায়াত করেছি—কখনো ছয় মাস, কখনো এক বছর থেকেছি, লাভ হয়নি কিছুই। শেষে ওদিক আর বাড়াইনি। অগত্যা পরিবেশসংকট নিয়ে আবার লিখতে শুরু করি এবং ক্রমে এই সত্য স্বচ্ছতর হতে থাকে যে মার্ক্স ও ডারউইনকে বাদ দিয়ে জায়মান এই সংকটের পূর্বাপর বোঝা ও নিরসনের পথ খোঁজা বৃথা। এই সংকটের কেন্দ্রে আছে মানুষ এবং সেই যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের হোতা। গোটা জীবজগতের সঙ্গে মানুষের উৎপত্তির প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেছেন ডারউইন আর সমাজ বিকাশের সূত্রগুলো মার্ক্স—দুটিই বস্তুত পরস্পরজড়িত, যে জন্য একদা সামাজিক ডারউইনবাদের উদ্ভব। জীবজগতের ক্রমবিবর্তনের যেসব উপাত্ত ডারউইন উদ্ঘাটন করেছেন, তাতে আছে জীবের অত্যধিক বংশবৃদ্ধির প্রবণতা, প্রকৃতির সীমিত খাদ্যভান্ডার। ফলে ‘জীবনের জন্য সংগ্রাম’ এবং অযোগ্যের বিলুপ্তি ও যোগ্যতরের উদ্বর্তন। এটি ঘটে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ার আওতায় আর মানুষ তা অতিক্রম করেছে উন্নত মস্তিষ্কের কল্যাণে। ধর্ম মানুষকে প্রেম ও নৈতিকতা শেখাতে চেয়েছে, বিজ্ঞান জুগিয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের উপাত্তগুলো, অর্থাৎ অত্যধিক বংশবৃদ্ধি খাদ্যাভাব, নিত্যদিনের সংগ্রাম ও যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, কিন্তু মানুষ সেগুলো গ্রহণ করেনি। কেন করেনি এবং কীভাবে করা সম্ভব, তা দেখিয়েছেন মার্ক্স। এই দুটি তত্ত্বের আলোকে পরিবেশসংকট নিয়ে একটি বই লিখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখানেও দেরি হয়ে গেল। তাতে ক্ষতি নেই, পশ্চিমে এমন বই হয়তো লেখা হয়ে গেছে বা অচিরেই হবে। বেলামি ফস্টারের মার্ক্স একোলজি বইটি পড়েছি, কিন্তু যথেষ্ট মনে হয়নি, মার্ক্সের সময় প্রকৃতি ও পরিবেশ আজকের মতো এতটা বিপর্যস্ত হয়নি। মার্ক্স কমিউনিজমে মানুষ ও প্রকৃতি—উভয়ের শোষণলুপ্তি আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সে তো দীর্ঘ সময়ের বিষয়। প্রকৃতি এখন সরোষে প্রত্যাঘাতে উদ্যত, আমাদের এতটা সময় আর মঞ্জুর করবে না। পশ্চিমের পরিবেশবাদীরা সমস্যা সমাধানের হাস্যকর সব ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন, তাতে নির্বাচনে ‘ভালো মানুষকে’ ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার কথাও আছে। কিন্তু নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতা মেলে না। ব্যাপারটি বহুগুণ কঠিন, দুঃসাধ্যও বলা যায়। বালককালে রবীন্দ্রনাথের ‘দুঃসময়’ কবিতাটি আবৃত্তি করতাম, তারই কয়েক পঙিক্ত মনে পড়ছে: ‘উষা-দিশাহারা নিবিড় তিমির আঁকা। ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/ এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।’
No comments