রাজনীতি-সংঘাত নয়, সমঝোতার পথে চলুন

মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যে স্থিতিশীল রাজনীতি ৩ বছর দেশের মানুষের আশা জাগিয়েছিল তাতে সহসা ছেদ পড়ল গত কয়েক দিনের ঘটনাবলিতে। এ কথা সত্য_ বিরোধী দল সংসদে যায়নি, সরকার ও বিরোধীদের আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্কে গণতান্ত্রিক পাটাতনগুলো মুখর হয়ে ওঠেনি।


এমনকি সংসদের বাইরেও সমঝোতা ও বোঝাপড়ার পথে প্রধান দলগুলোকে খুব বেশি উৎসাহী হতে দেখা যায়নি। কিন্তু যে কোনো সময়ের তুলনায় শান্ত ছিল রাজনীতির মাঠ। ঘন ঘন হরতাল হয়নি, রাজপথের সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে খুন-জখমের প্রতিযোগিতাও তুলনামূলক কম ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। সরকারও বিরোধীদের দমনে কঠোর মনোভাবাপন্ন হয়নি। মাঝে মধ্যে হরতালের খবরে বিরোধী দলকে সরকার, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। সবাই হরতাল, জ্বালাও-পোড়াওয়ের বিকল্প কর্মসূচি খুঁজে নিতে পরামর্শ দিয়েছে বিরোধী দলের উদ্দেশে। ধারণা করা হয়, বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে এ পরামর্শের ছাপ পড়েছে। হরতালের বিকল্প হিসেবে রোডমার্চসহ নানা ধরনের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচির দিকেই তারা বেশি মনোনিবেশ করেছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়। কিন্তু বিএনপির গণমিছিলকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সহসা সবাইকে চিন্তিত করে তুলেছে। ২৯ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারাদেশে গণমিছিল কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল বিএনপি। একই দিন ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ ডেকেছিল আওয়ামী লীগও। দুই কর্মসূচি সঙ্গত কারণেই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বলে অভিহিত হয়েছে। দুই কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সংঘাত বাধতে পারে_ এমন অজুহাতে পুলিশ ২৯ জানুয়ারি মিছিল-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি মিছিল কর্মসূচি পিছিয়ে ৩০ জানুয়ারি দিনক্ষণ ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগও একই দিন কর্মসূচি ঘোষণা করে। ঢাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির মধ্যেই ঘটে গেছে আরও কিছু নিন্দনীয় ঘটনা। ২৯ তারিখ গণমিছিল করতে গিয়ে বিএনপির শত শত কর্মী আহত হয়েছেন। লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে দলটির চারজন কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। গণতান্ত্রিক কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের বাধাদান অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মিছিলে গুলি চালনার ঘটনা নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। সবাই স্বীকার করবেন, শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালনার মতো অসহিষ্ণু পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে না। সরকার ও বিরোধী দল এমন কোনো চূড়ান্ত অবস্থান নিয়ে ফেলেনি যা একই দিনে পরপর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির দিকে রাজনীতিকে ঠেলে দিতে পারে। তদুপরি রাজনীতি যতই অসহিষ্ণু হয়ে উঠুক_ মিছিলে পুলিশের গুলি চালনাকে কেউ-ই সমর্থন করবেন না। এ ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করতে পারছে না বলেই অনেকের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেক বেশি। দেশ ও রাজনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য তাদের আন্তরিক উদ্যোগও প্রত্যাশিত। নানা সমস্যা সত্ত্বেও আপাত অর্থে যে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল তা অনেকের জন্যই সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সন্তোষজনক পরিস্থিতিটিকে জিইয়ে না রেখে রাজনীতিকে সংঘর্ষের দিকে টেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কম নয়। বিরোধী দল রাজনীতির মাঠকে উত্তপ্ত করতে চাইবে, কর্মসূচিও দেবে। কিন্তু যতক্ষণ সে কর্মসূচি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ, ততক্ষণ শুধু তাতে অনুমোদন করা নয়, সহযোগিতা দেওয়াও সরকারের কর্তব্য। কিন্তু তা না করে সরকার ভিন্ন পথই অবলম্বন করছে। আমরা মনে করি, গত কয়েক দিনে যে হঠাৎ সংঘাতের দেখা মিলল তা ভবিষ্যতে অনুসৃত হওয়া উচিত নয়। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকাই প্রত্যাশিত। বিরোধী দলকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। যখন সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে তখনই নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিবদমান বিষয়গুলো, বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুর সুরাহা দ্রুত সংসদেই হয়ে যাওয়া উচিত। আমরা রাজনীতিকে রাস্তায় নয়_ আলোচনার টেবিলে ও সংসদে দেখতে চাই। রক্তপাতে নয়, সমঝোতার পথেই এগিয়ে যাক দেশ, সেটিই প্রত্যাশিত।

No comments

Powered by Blogger.