কালান্তরের কড়চা-সেনা অভ্যুত্থানের পর গণ-অভ্যুত্থানের চক্রান্ত, কোনোটাই সফল হচ্ছে না by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ভোরে ঘুম থেকে উঠেই দেশ থেকে চার-চারটি মৃত্যুর খবর পাওয়া কম ট্রাজিক ব্যাপার নয়। তার ওপর এগুলো আবার স্বাভাবিক মৃত্যুও নয়। বলা হয়েছে, পুলিশের গুলিতে এই মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ গুলি করতে গেল কেন? ২৯ জানুয়ারি ছিল ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির গণবিক্ষোভ, গণমিছিল ইত্যাদি করার দিবস। ঢাকায় এই দিবস ২৯ তারিখে পালন করা সম্ভব হয়নি। ওইদিন আওয়ামী লীগেরও সমাবেশ থাকার ফলে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে ঢাকায় কিছু হয়নি।
কয়েকটি জেলায়, উপজেলায় হয়েছে। ঢাকায় এই বিক্ষোভে সমাবেশ ও মিছিল করা হয়েছে ৩০ তারিখ সোমবার।
বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে দুজন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকায় সোমবার যে তেমন কিছু ঘটেনি, তার প্রধান কারণ, বিএনপি এখানে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নিয়মকানুন ভাঙতে পারেনি। পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মিছিলের রুটস ঠিক করেছে। মহানগর আওয়ামী লীগও এই দিন সমাবেশ ডেকেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তাদের অফিসের সামনে, বিএনপির গণমিছিলের রুটস থেকে দূরে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা ছিল কম।
কালের কণ্ঠের জন্য যখন এই কলামটা লিখছি, তখন ঢাকায় ৩০ তারিখের মধ্যাহ্ন। টেলিভিশনের খবরে এবং ঢাকার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা জেনেছি, তাহলো ঢাকার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিকেলে মিছিল-সমাবেশ শুরু হলে অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। তাও নির্ভর করে বিএনপির আচার-আচরণের ওপর। যদি তারা গণতান্ত্রিক নিয়মরীতি মেনে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিং-মিছিল করে, তাহলে ঢাকায় শান্তি ভঙ্গের কোনো কারণ নেই। আমি হয়তো আগাম লিখে দিতে পারি, ঢাকায় ৩০ জানুয়ারি কোনো অঘটন ঘটেনি।
কিন্তু বিএনপি যদি আগে থেকেই মারদাঙ্গা করার, পুলিশকে ইট-পাটকেল মারার, বাস, গাড়ি, ট্রাক, লরি পোড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তাহলে পুলিশকে অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। বিএনপি মনে করতে পারে, এভাবে রাজপথে মারদাঙ্গা বাধিয়ে পুলিশকে উস্কে দিয়ে নিজেদের মিছিলে কিছু হতাহত তৈরি করতে পারলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সৃষ্টি হবে সরকারের বিরুদ্ধেদ; সমর্থন ও সহানুভূতি যাবে তাদের দিকে। এই ধারণাটা ভুল। এককালে তা হতো, যখন পুলিশ সত্যই কলোনিয়াল যুগের অভ্যাস থেকে কথায় কথায় শান্তিপূর্ণ গণমিছিলেও লাঠি-গুলি চালাত এবং দেশের মানুষ ঘটনাস্থলে কী ঘটেছে, তা সহজে জানতে পারত না।
বর্তমানে নয়া প্রযুক্তির কল্যাণে অবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মানুষ এখন ঘরে বসে ভয়াবহ রণক্ষেত্রে কী ঘটছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা দেখে, রাস্তাঘাটের মারদাঙ্গার দৃশ্য তো দেখেই। ফলে সহজেই বিচার করতে পারে- এই মারদাঙ্গার জন্য কোন পক্ষ দায়ী। যেমন ২৯ জানুয়ারি চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ ও দিনাজপুরে কী ঘটেছে, তা এই সুদূর লন্ডনে বসেও টেলিভিশনের খবরে আমরা দেখেছি।
যাঁরা তা লন্ডনে বসেও দেখেছেন, তাঁরা কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, 'সম্ভবত বিএনপি নেতারাই চেয়েছিলেন, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের মতো আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটুক। মারা তো যাবে সাধারণ মানুষ। কিন্তু লাভ তাদের। তাদের আন্দোলন জোরদার হবে। কিন্তু এবার সে আশায় গুড়েবালি। আমরা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, কারা এই মারদাঙ্গার জন্য দায়ী। যদি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও মিছিল করার ইচ্ছাই বিএনপি নেতাদের মনে থাকত, তাহলে মিছিলের প্রত্যেকটি লোকের হাতে মারাত্মক লাঠি-বল্লম কেন? পুলিশের প্রতি উসকানিমূলক আচরণ ও স্লোগান কেন?'
টিভি নিউজে বিএনপির সভা-মিছিলের ছবি দেখে যাঁরা আমাকে প্রশ্নটি করেছেন, তাঁদের আমি নিজের ধারণার কথাটাও জানিয়েছি। বাংলাদেশে বিভিন্ন ছোট-বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে বাস করে আমি বড় হয়েছি। দেখেছি, কোনো আন্দোলনে যখন জনসমর্থন থাকে না, তখন সেই তথাকথিত আন্দোলনের নেতারা ভায়োলেন্সের আশ্রয় নেন। একাত্তরের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার কোলাবরেটর হওয়ার পর থেকে দেশে জামায়াতিদের জনসমর্থন ক্রমশ বিলীয়মান। ফলে কোথাও অর্থ ঢেলে এবং সাধারণভাবে খুন, জখম, হাতকাটা, রগকাটা ইত্যাদি সহিংস পন্থার আশ্রয় নিয়ে তারা জনগণের মনে ভয় ঢুকিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়।
জামায়াত ও শিবিরের ক্যাডারদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পর থেকেই দেখা যাবে, বিএনপির রাজনীতিতেও ভায়োলেন্স ঢুকেছে। হত্যার রাজনীতিতে জামায়াতিরা দক্ষ। বিএনপির মধ্যেও এই হিংসার রাজনীতির বিষ ঢুকিয়েছে জামায়াত। লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরের ২৯ জানুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, লক্ষ্মীপুরে (এমনকি চাঁদপুরেও) জামায়াতিদের শক্ত ঘাঁটি আছে। গণমিছিলে জনতার চেয়ে তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মী ও ক্যাডারদের উপস্থিতিই ছিল বেশি।
আন্দোলনকে কিভাবে হিংসার পথে টেনে নিয়ে যেতে হয়, তা জামায়াতিরা জানে এবং তারা তা দেখিয়েছে। কিন্তু আগের মতো তারা যে আর সফল হচ্ছে না তার কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার এবার ক্ষমতায় আসার পর শক্ত হাতে জামায়াতের মুখোশধারী জঙ্গি মৌলবাদী দলগুলোকে অনেকটাই দমন করেছে এবং পুলিশও আগের মতো নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় না থেকে উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে শক্তি প্রদর্শনে দ্বিধা করছে না। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও এই শক্তির উদ্বোধন এখন দরকার।
লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু শোকাবহ। গুলি না চালিয়ে রাবার বুলেট বা কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত কি না, তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। যদি তদন্তে দেখা যায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়াবাড়ি করেছে, তাহলে অভিযুক্ত পুলিশদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, আন্দোলনের নামে যারা লাঠিসোঁটা, বোমা-গ্রেনেড নিয়ে দলের ক্যাডারদের রাস্তায় নামায় এবং গাড়িঘোড়া-বাস এমনকি মানুষও পোড়াতে শুরু করে, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ট্রাজিক মৃত্যুর ব্যাপারে তারাও কতটা দায়ী, সে সম্পর্কে তদন্ত করে তার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু পুলিশ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই গুলি করে হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছে কি না, তাও তদন্ত করে দেখা হবে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ তা তদন্ত করে দেখুক ভালো কথা। তদন্ত হওয়া উচিত। তবে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুরের ঘটনায় কনস্পিরেসি থিয়োরিটি খাটবে বলে আমার মনে হয় না।
বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডাররা যেভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় পুলিশের ওপর হামলা, এমনকি তাদের গুরুতর আহত-নিহত করার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে, তাতে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য অতি সতর্ক ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠলে বিস্ময়ের কিছু নেই। সম্প্রতি এক পুলিশ অফিসার কোনো প্রকার অ্যাকশনে না থাকা সত্ত্বেও একা পেয়ে জামাতিরা তাকে যেভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, মাওবাদী ও তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিরা ছাড়া এ কাজ আর কেউ করে না।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানী কলকাতা বা রাজ্যের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে পুলিশ মোটামুটি শান্তপ্রিয় এবং শক্তির বাড়াবাড়ি দেখাতে আগ্রহী নয়। কিন্তু রাজ্যের মাওবাদী সন্ত্রাস-উপদ্রুত এলাকাগুলোতে পুলিশের চরিত্রে নিষ্ঠুরতা এবং তুচ্ছ কারণেও শক্তি প্রয়োগে আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাওবাদী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে হাতে পেলেই হত্যা করে। একজন ছা-পোষা কনস্টেবলের কাছ থেকে পর্যন্ত তারা অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাঁকে বিনা কারণে মেরে ফেলে।
এই মাওবাদীদের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ এত বেশি সতর্ক হয়েছে যে, কাউকে মাওবাদী সন্দেহ হলেই তারা আগেই তাকে মেরে ফেলতে চায়। তার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটা মাওবাদী এলাকার পুলিশের মধ্যে এক ধরনের নার্ভাসনেস। এই নার্ভাসনেস থেকে অনেক সময় তারা অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা দেখায়।
বাংলাদেশেও জঙ্গি মৌলবাদী দমনে নিযুক্ত বা বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডারদের ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের 'আন্দোলনের' মোকাবিলায় রত পুলিশের মধ্য এই ধরনের 'নার্ভাসনেস' দেখা দিয়েছে তা আমি বলি না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের নার্ভাসনেস থেকেও যে পুলিশ অতি তৎপরতা ও নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে, তার সম্ভাবনা সম্পর্কেও পুলিশের উচ্চ কর্তৃপক্ষকে অবহিত হতে বলি। পুলিশের মধ্যে এ ধরনের নার্ভাসনেস যাতে দেখা না দেয় তারও ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
মাত্র দুই দিন আগেই সেনা অভুত্থান ঘটিয়ে সরকার উচ্ছেদের চক্রান্ত সফল হয়নি। দেখা গেছে, এই সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্তের পেছনেও মূল হোতা ছিল কিছু মৌলবাদী তথা জামায়াতপন্থী অফিসার। জামায়াতের মিত্র হিসেবে বিএনপি এ দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। এখন সেনা অভ্যুত্থানের বদলে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটানোর চক্রান্ত চলছে। আর মাত্র দুই বছর বাকি আগামী সাধারণ নির্বাচনের। তার জন্য অপেক্ষা করতে চায় না বিএনপি-জামায়াত জোট। কারণ, আগামী নির্বাচনে তারা জয়ী হবে, তার ষোলো আনা নিশ্চয়তা নেই। তাই গণ-আন্দোলনের নামে রাজপথে মারদাঙ্গার আন্দোলন। কিন্তু পেছনে জনসমর্থন নেই। ৩০ জানুয়ারির ঢাকার মিটিং-মিছিলেও এই সমর্থনের আভাস মেলেনি। মানুষ তামাসা দেখতে ভিড় করেছে। সমর্থন জানাতে নয়। কারণ, তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের সব মুখ চেনা।
এ ছাড়া এই রোডমার্চ, মিছিল-সমাবেশের আসল উদ্দেশ্যটা কি? বাংলাদেশের মানুষ তা অনেক আগেই জেনে গেছে। উদ্দেশ্য, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতক-দালালদের বিচার ও দণ্ডদানের আয়োজন ভণ্ডুল করা। আর এই বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে যে সরকার তাকে কখনো সেনা অভ্যুত্থান, কখনো গণ-আন্দোলনের নামে রক্তক্ষয়ী চক্রান্ত দ্বারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। দেশে পঁচাত্তরের মতো আরেকটি মহাট্র্যাজেডি ঘটানো। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হবে না। চক্রান্ত বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।
২০১২ সাল ১৯৭৫ সাল নয়। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সতর্ক ও জাগ্রত। তথাপি সব চক্রান্তের মোকাবিলায় বর্তমান সরকারকে আরো কঠোর ও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
লন্ডন, ৩০ জানুয়ারি ২০১২ সোমবার
বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরে দুজন করে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। দিনাজপুর ও কিশোরগঞ্জে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছে। ঢাকায় সোমবার যে তেমন কিছু ঘটেনি, তার প্রধান কারণ, বিএনপি এখানে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নিয়মকানুন ভাঙতে পারেনি। পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মিছিলের রুটস ঠিক করেছে। মহানগর আওয়ামী লীগও এই দিন সমাবেশ ডেকেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তাদের অফিসের সামনে, বিএনপির গণমিছিলের রুটস থেকে দূরে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা ছিল কম।
কালের কণ্ঠের জন্য যখন এই কলামটা লিখছি, তখন ঢাকায় ৩০ তারিখের মধ্যাহ্ন। টেলিভিশনের খবরে এবং ঢাকার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যা জেনেছি, তাহলো ঢাকার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। বিকেলে মিছিল-সমাবেশ শুরু হলে অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। তাও নির্ভর করে বিএনপির আচার-আচরণের ওপর। যদি তারা গণতান্ত্রিক নিয়মরীতি মেনে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিং-মিছিল করে, তাহলে ঢাকায় শান্তি ভঙ্গের কোনো কারণ নেই। আমি হয়তো আগাম লিখে দিতে পারি, ঢাকায় ৩০ জানুয়ারি কোনো অঘটন ঘটেনি।
কিন্তু বিএনপি যদি আগে থেকেই মারদাঙ্গা করার, পুলিশকে ইট-পাটকেল মারার, বাস, গাড়ি, ট্রাক, লরি পোড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তায় বের হয়, তাহলে পুলিশকে অবশ্যই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। বিএনপি মনে করতে পারে, এভাবে রাজপথে মারদাঙ্গা বাধিয়ে পুলিশকে উস্কে দিয়ে নিজেদের মিছিলে কিছু হতাহত তৈরি করতে পারলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সৃষ্টি হবে সরকারের বিরুদ্ধেদ; সমর্থন ও সহানুভূতি যাবে তাদের দিকে। এই ধারণাটা ভুল। এককালে তা হতো, যখন পুলিশ সত্যই কলোনিয়াল যুগের অভ্যাস থেকে কথায় কথায় শান্তিপূর্ণ গণমিছিলেও লাঠি-গুলি চালাত এবং দেশের মানুষ ঘটনাস্থলে কী ঘটেছে, তা সহজে জানতে পারত না।
বর্তমানে নয়া প্রযুক্তির কল্যাণে অবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মানুষ এখন ঘরে বসে ভয়াবহ রণক্ষেত্রে কী ঘটছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় তা দেখে, রাস্তাঘাটের মারদাঙ্গার দৃশ্য তো দেখেই। ফলে সহজেই বিচার করতে পারে- এই মারদাঙ্গার জন্য কোন পক্ষ দায়ী। যেমন ২৯ জানুয়ারি চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, কিশোরগঞ্জ ও দিনাজপুরে কী ঘটেছে, তা এই সুদূর লন্ডনে বসেও টেলিভিশনের খবরে আমরা দেখেছি।
যাঁরা তা লন্ডনে বসেও দেখেছেন, তাঁরা কেউ কেউ আমাকে বলেছেন, 'সম্ভবত বিএনপি নেতারাই চেয়েছিলেন, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুরের মতো আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটুক। মারা তো যাবে সাধারণ মানুষ। কিন্তু লাভ তাদের। তাদের আন্দোলন জোরদার হবে। কিন্তু এবার সে আশায় গুড়েবালি। আমরা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, কারা এই মারদাঙ্গার জন্য দায়ী। যদি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও মিছিল করার ইচ্ছাই বিএনপি নেতাদের মনে থাকত, তাহলে মিছিলের প্রত্যেকটি লোকের হাতে মারাত্মক লাঠি-বল্লম কেন? পুলিশের প্রতি উসকানিমূলক আচরণ ও স্লোগান কেন?'
টিভি নিউজে বিএনপির সভা-মিছিলের ছবি দেখে যাঁরা আমাকে প্রশ্নটি করেছেন, তাঁদের আমি নিজের ধারণার কথাটাও জানিয়েছি। বাংলাদেশে বিভিন্ন ছোট-বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে বাস করে আমি বড় হয়েছি। দেখেছি, কোনো আন্দোলনে যখন জনসমর্থন থাকে না, তখন সেই তথাকথিত আন্দোলনের নেতারা ভায়োলেন্সের আশ্রয় নেন। একাত্তরের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার কোলাবরেটর হওয়ার পর থেকে দেশে জামায়াতিদের জনসমর্থন ক্রমশ বিলীয়মান। ফলে কোথাও অর্থ ঢেলে এবং সাধারণভাবে খুন, জখম, হাতকাটা, রগকাটা ইত্যাদি সহিংস পন্থার আশ্রয় নিয়ে তারা জনগণের মনে ভয় ঢুকিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়।
জামায়াত ও শিবিরের ক্যাডারদের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পর থেকেই দেখা যাবে, বিএনপির রাজনীতিতেও ভায়োলেন্স ঢুকেছে। হত্যার রাজনীতিতে জামায়াতিরা দক্ষ। বিএনপির মধ্যেও এই হিংসার রাজনীতির বিষ ঢুকিয়েছে জামায়াত। লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরের ২৯ জানুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, লক্ষ্মীপুরে (এমনকি চাঁদপুরেও) জামায়াতিদের শক্ত ঘাঁটি আছে। গণমিছিলে জনতার চেয়ে তাদের ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মী ও ক্যাডারদের উপস্থিতিই ছিল বেশি।
আন্দোলনকে কিভাবে হিংসার পথে টেনে নিয়ে যেতে হয়, তা জামায়াতিরা জানে এবং তারা তা দেখিয়েছে। কিন্তু আগের মতো তারা যে আর সফল হচ্ছে না তার কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার এবার ক্ষমতায় আসার পর শক্ত হাতে জামায়াতের মুখোশধারী জঙ্গি মৌলবাদী দলগুলোকে অনেকটাই দমন করেছে এবং পুলিশও আগের মতো নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় না থেকে উচ্ছৃঙ্খলতা দমনে শক্তি প্রদর্শনে দ্বিধা করছে না। গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতিতেও এই শক্তির উদ্বোধন এখন দরকার।
লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু শোকাবহ। গুলি না চালিয়ে রাবার বুলেট বা কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারত কি না, তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। যদি তদন্তে দেখা যায় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়াবাড়ি করেছে, তাহলে অভিযুক্ত পুলিশদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, আন্দোলনের নামে যারা লাঠিসোঁটা, বোমা-গ্রেনেড নিয়ে দলের ক্যাডারদের রাস্তায় নামায় এবং গাড়িঘোড়া-বাস এমনকি মানুষও পোড়াতে শুরু করে, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুরের ট্রাজিক মৃত্যুর ব্যাপারে তারাও কতটা দায়ী, সে সম্পর্কে তদন্ত করে তার রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা উচিত।
পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা কিছু পুলিশ সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই গুলি করে হত্যার ঘটনাটি ঘটিয়েছে কি না, তাও তদন্ত করে দেখা হবে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ তা তদন্ত করে দেখুক ভালো কথা। তদন্ত হওয়া উচিত। তবে চাঁদপুর-লক্ষ্মীপুরের ঘটনায় কনস্পিরেসি থিয়োরিটি খাটবে বলে আমার মনে হয় না।
বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডাররা যেভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় পুলিশের ওপর হামলা, এমনকি তাদের গুরুতর আহত-নিহত করার সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে, তাতে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য অতি সতর্ক ও অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠলে বিস্ময়ের কিছু নেই। সম্প্রতি এক পুলিশ অফিসার কোনো প্রকার অ্যাকশনে না থাকা সত্ত্বেও একা পেয়ে জামাতিরা তাকে যেভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, মাওবাদী ও তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিরা ছাড়া এ কাজ আর কেউ করে না।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানী কলকাতা বা রাজ্যের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে পুলিশ মোটামুটি শান্তপ্রিয় এবং শক্তির বাড়াবাড়ি দেখাতে আগ্রহী নয়। কিন্তু রাজ্যের মাওবাদী সন্ত্রাস-উপদ্রুত এলাকাগুলোতে পুলিশের চরিত্রে নিষ্ঠুরতা এবং তুচ্ছ কারণেও শক্তি প্রয়োগে আগ্রহ বেশি দেখা যায়। এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মাওবাদী সন্ত্রাসীরা পুলিশকে হাতে পেলেই হত্যা করে। একজন ছা-পোষা কনস্টেবলের কাছ থেকে পর্যন্ত তারা অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তাঁকে বিনা কারণে মেরে ফেলে।
এই মাওবাদীদের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য পুলিশ এত বেশি সতর্ক হয়েছে যে, কাউকে মাওবাদী সন্দেহ হলেই তারা আগেই তাকে মেরে ফেলতে চায়। তার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায় না। বিশ্লেষকেরা বলেছেন, এটা মাওবাদী এলাকার পুলিশের মধ্যে এক ধরনের নার্ভাসনেস। এই নার্ভাসনেস থেকে অনেক সময় তারা অনাবশ্যক নিষ্ঠুরতা দেখায়।
বাংলাদেশেও জঙ্গি মৌলবাদী দমনে নিযুক্ত বা বিএনপি-জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডারদের ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওয়ের 'আন্দোলনের' মোকাবিলায় রত পুলিশের মধ্য এই ধরনের 'নার্ভাসনেস' দেখা দিয়েছে তা আমি বলি না। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের নার্ভাসনেস থেকেও যে পুলিশ অতি তৎপরতা ও নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে, তার সম্ভাবনা সম্পর্কেও পুলিশের উচ্চ কর্তৃপক্ষকে অবহিত হতে বলি। পুলিশের মধ্যে এ ধরনের নার্ভাসনেস যাতে দেখা না দেয় তারও ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
মাত্র দুই দিন আগেই সেনা অভুত্থান ঘটিয়ে সরকার উচ্ছেদের চক্রান্ত সফল হয়নি। দেখা গেছে, এই সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্তের পেছনেও মূল হোতা ছিল কিছু মৌলবাদী তথা জামায়াতপন্থী অফিসার। জামায়াতের মিত্র হিসেবে বিএনপি এ দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। এখন সেনা অভ্যুত্থানের বদলে গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটানোর চক্রান্ত চলছে। আর মাত্র দুই বছর বাকি আগামী সাধারণ নির্বাচনের। তার জন্য অপেক্ষা করতে চায় না বিএনপি-জামায়াত জোট। কারণ, আগামী নির্বাচনে তারা জয়ী হবে, তার ষোলো আনা নিশ্চয়তা নেই। তাই গণ-আন্দোলনের নামে রাজপথে মারদাঙ্গার আন্দোলন। কিন্তু পেছনে জনসমর্থন নেই। ৩০ জানুয়ারির ঢাকার মিটিং-মিছিলেও এই সমর্থনের আভাস মেলেনি। মানুষ তামাসা দেখতে ভিড় করেছে। সমর্থন জানাতে নয়। কারণ, তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের সব মুখ চেনা।
এ ছাড়া এই রোডমার্চ, মিছিল-সমাবেশের আসল উদ্দেশ্যটা কি? বাংলাদেশের মানুষ তা অনেক আগেই জেনে গেছে। উদ্দেশ্য, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও ঘাতক-দালালদের বিচার ও দণ্ডদানের আয়োজন ভণ্ডুল করা। আর এই বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে যে সরকার তাকে কখনো সেনা অভ্যুত্থান, কখনো গণ-আন্দোলনের নামে রক্তক্ষয়ী চক্রান্ত দ্বারা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা। দেশে পঁচাত্তরের মতো আরেকটি মহাট্র্যাজেডি ঘটানো। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সফল হবে না। চক্রান্ত বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।
২০১২ সাল ১৯৭৫ সাল নয়। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সতর্ক ও জাগ্রত। তথাপি সব চক্রান্তের মোকাবিলায় বর্তমান সরকারকে আরো কঠোর ও শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
লন্ডন, ৩০ জানুয়ারি ২০১২ সোমবার
No comments