জলবায়ু পরিবর্তন নাকি রাজনীতির পরিবর্তন? by মোহাম্মদ নুরাল হক
জলবায়ু পরিবর্তন, নাকি রাজনীতির পরিবর্তন? বিতর্কটি জমে উঠল এখানেই। অতি পরিচিত কোপেনহেগেন, এখন নাকি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত ‘হোপেনহেগেন-এ’ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উত্থাপিত হয়েছে এই বিতর্কটি। রাজনীতি নিয়ে বর্তমান টালমাটাল বিশ্বের অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সাধারণভাবে মৌলিক এই প্রশ্নটি।
রাজনীতিকে জলবায়ুর অংশ বলাতে অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম। আবার, অনেকেই এহেন বিতর্ক নিয়ে যারপরনাই নাখোশ। কিন্তু কে না জানে যে, সৃষ্টি জগতের সবকিছু এবং সব সৃষ্টির সব কর্মকাণ্ডই এই পৃথিবীর সামগ্রিক জলবায়ুর উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। তাই আমার মতে, যিনি এহেন মৌলিক বিষয়টি সামনে এনেছেন, তিনি নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ নিয়ে মানব সমাজে এই মুহূর্তে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকাই পালন করেছেন।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে যদি রাজনীতি হতে পারে, তাহলে জলবায়ু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে না, এমনটি ভাবা সঠিক নয়। বিগত দশকের পর দশক ধরে জলবায়ু নিয়ে রাজনীতি অবশ্যই হয়েছে। আর, আজ এ রাজনীতির পঙ্কে গলা পর্যন্ত ডুবে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ এর ফল বেশ ভালোভাবে হাড়ে হাড়েই প্রত্যক্ষ করছি। একবিংশ শতাব্দীতে কে না জানে যে, আত্মঘাতী এ রাজনীতির ফল হলো পৃথিবী জোড়া মানব জাতির নিশ্চিত ধ্বংস। যারা এহেন রাজনীতিতে জড়িত তারা ভেবে করছে নাকি না ভেবেই করছে তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এই রাজনীতিবিদরা নিঃসন্দেহে নিজেরাই নিজেদেরও সম্ভাব্য ধ্বংস ডেকে আনছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এহেন নীতি-গতিতে তাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও যাবতীয় অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করা।
এক্ষেত্রে, আমরা অধুনা বহুল সমালোচিত বিশ্বের মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট স্বনামধন্য মিঃ জঙ্গলের (গত্. ইঁংয) হুঙ্কারসর্বস্ব ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ (ধিত্ ধমধরহংঃ ঃবত্ত্ড়ত্) বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এহেন ‘সস্তা হুঙ্কারে’ সহজেই আন্দোলিত হয়ে বাংলাদেশসহ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই এখন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রতিনিয়ত খাবি খাচ্ছে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে। বাস্তবে এই বিষয়ে আমাদের অবস্থান এখন ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ আর কী। কিন্তু, ওদিকে ওস্তাদ/গুরু নির্দেশিত পথে চলতে গিয়ে এখন বিষয়টির কোনো রকম কূল-কিনারাই করতে পারছি না আমরা বাংলাদেশীরা। অথচ, ওদের ‘ভানুমতির খেল’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ বিষয়টি আমাদের তো কোনো কাজেই আসছে না, বরং দিনের পর দিন নানাবিধ নানামুখী সন্ত্রাসের চাপে আমাদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ইদানীংকালের পাকিস্তান-আফগানিস্তান এবং ইরাক।
যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৮ সালের গ্রীষ্ম মৌসুমের প্রায় চার মাসে ডিক চেনিরা ইরাকের শুধু তেল সম্পদ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এর আগে-পরের ও অন্য খাতগুলোর হিসাবে না হয় নাইই বা গেলাম। এদিকে, একই সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব জনগোষ্ঠীই তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির অব্যাহত নিদারুণ চাপে দিনের পর দিন কীভাবেই না নাকাল হয়েছে। এরপরও ওইসব ওস্তাদ/গুরুদের সুপরিকল্পিত ছক অনুযায়ী দিনের পর দিন তথাকথিত সন্ত্রাসের তো কোনো আশু সমাধানই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উপরন্তু, একে একে নানাবিধ নতুন নতুন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে আমাদের এই বিশ্ব। আর উপায়ান্তর না দেখে বিশেষ করে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নীতি-নির্ধারকরা এখন বাধ্য হয়ে এহেন মহা পারঙ্গম ওস্তাদ/গুরুদের অঙ্গুলি হেলনে ওঠ-বসে রত থাকাতেই আপাতত মহা সন্তুষ্ট। বাস্তবে, এতদিনে গঙ্গার পানি এতদূর গড়িয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য অন্য আর কোনো উপায়ও আমাদের নীতি-নির্ধারকরা হাতড়িয়ে পাচ্ছেন না।
স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের রাজনীতি যখন মূলত ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদকেন্দ্রিক তখন জলবায়ু নামক জ্বলন্ত বিষয়টি এর বাইরে থাকে কী করে? কারণ, ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, মানুষের অন্তর-আত্মার বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে মানুষকে সার্বিকভাবে অথর্ব জড়বস্তুতে পরিণত করে। আসলে ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদের লোভ-লালসা মানুষকে একবার পেয়ে বসলে তা থেকে বেরিয়ে আসা কখনোই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। কোনো এক রাজদরবারে রাজার বিশ্বস্ত একজন বরকন্দাজ ছিল। একদিন রাজা জানতে পারলেন যে, ক্ষমতার আশপাশে থাকার সুবাদে বরকন্দাজ মহাশয় অবৈধ অর্থ অর্জনে ব্যস্ত। উপায়ান্তর না দেখে রাজা তাকে রাজবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ঢেউ গণনার কাজ দিলেন, যাতে করে সে কোনোভাবেই অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করতে না পারে। কিছুদিন যেতে না যেতেই রাজা খবর পেলেন, বরকন্দাজ মহাশয় সেখানেও অবৈধ অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে। জানা গেল, নদীতে যারা নৌকা নিয়ে চলে, ঢেউ ভাঙার অপরাধ ও রাজার ভয় দেখিয়ে সে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে মহা সুখে, দেদারছে।
সাধারণ জনগোষ্ঠী যেমন জলবায়ুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, ঠিক তেমনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ সাধারণ মানুষেরও ভাববার বিষয়। জলবায়ুর ভালো-মন্দ প্রভাবে সাধারণ মানুষ কখনও খুশি হয় আবার কখনও রুষ্ট হয়। তা বাংলাদেশের যে কোনো কোণেই হোক না কেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ জনগণের নামকাওয়াস্তে পরিচালিত হয় বলে, এর অস্তিত্ব সাধারণ জনগোষ্ঠীর আয়ত্তের বাইরে। মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিষয় দুটি বুঝি বেওয়ারিশ। যখন যে যেভাবেই হস্তগত করতে পারে তখন এগুলো তার। অহরহ তাই তো দেখা যায় যে, বিশ্বজুড়ে রাজনীতির বলি মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয় অর্থ-সম্পদ দিয়ে। কী করুণ মানবিক চিত্র, তাই না? সে যাই হোক, এই হলো আজকের বাংলাদেশসহ তথাকথিত উন্নত বিশ্বের বাস্তবতা।
তাই, জলবায়ু সম্মেলনে বহুল আলোচিত ও প্রস্তাবিত আপাত জঘন্য রাজনীতিটি হলো, মানুষের জীবন বিপন্ন করার বিনিময় হবে টাকা। আর সে টাকাও বণ্টন করা হবে সাক্ষী গোপালসম বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও চোরের সাক্ষী গাঁইটকাটা অন্যান্য নামি-দামি বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে। যে টাকা অতীতের মতো নিঃসন্দেহে লাভের গুড় পিঁপড়ায় যেভাবে খায়, ঠিক সেভাবেই খাবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরাসহ বিশ্বের তথাকথিত বাঘা বাঘা নেতৃবৃন্দ মনে করেন, তৃতীয় বিশ্বের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব বোঝে না। কী অদ্ভুত বুঝ এদের, তাই না?
কিন্তু, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সার্বিক বুঝ যে কখনই ভোঁতা নয় এবং জাতি হিসেবে বাংলাদেশীরা যে ফকির-মিসকিনের জাতি নয় তার উদাহরণ পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়ে হলেও এখানে আবারও উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি। ঘটনাটি সিডর-পরবর্তী সময়ের। গত ২৮ নভেম্বর ২০০৭, নয়াদিগন্তের শেষ পাতায় ছোট একটি খবর। প্রখর রোদ। অনেক মানুষের ভিড়ে ব্যাগ হাতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার কলারন গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধা আমেনা বেগম, দুর্দশা-দুর্গত মানুষের জন্য হেলিকপ্টারে ত্রাণ আসবে সেই অপেক্ষায়। অনেক অপেক্ষার পর হেলিকপ্টার দেখা দিল। কিন্তু উপযুক্ত জায়গার অভাবে নামতে পারল না সেখানে। চলে গেল অন্যত্র, সুবিধামত স্থানে নামার জায়গায়। বৃদ্ধা আমেনা বেগমসহ হতাশা সমবেত সবার। চরম হতাশার মধ্যেও বৃদ্ধা বললেন, ‘জীবনে এই পেরথম হেলিকপ্টার দ্যাখলাম’। পাশ থেকে একজন যুবক সাংবাদিক পরিস্থিতি হাল্কা করতে বললেন, ‘চাচী, আইজ তো বুশের তেরান পাওয়া গ্যালো না। এখন কি করবান’। ত্রাণ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে বৃদ্ধা আমেনা বেগম তাত্ক্ষণিক বলে উঠলেন, ‘ভালাই হইছে, বাবা। বুশের তেরান মুই খামু না।’ ‘কিন্তু কেন, কী হইছে?’—আশ্চর্যন্বিত হয়ে প্রশ্ন সাংবাদিক বন্ধুর। বৃদ্ধা আমেনা বেগমের দৃঢ় কণ্ঠে আরও সহজ-সরল উত্তর, ‘হুনছি, বুশ ব্যাডায় মানুষটা নাকি ভালা না’।
তবে আশার কথা হলো, এই তো সেদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি কেন জানি একটি বাস্তব প্রস্তাবনায় বললেন যে, উন্নত বিশ্ব কর্তৃক জলবায়ু দূষিতকরণের কারণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় না কেন? এতে করে সময়ের ব্যবধানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ও উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যার ভারসাম্য কিছুটা হলেও ফেরানো যেতে পারে। এখানে ক্রমাগত বিরূপ জলবায়ুর জন্য ভারসাম্যহীন জনসংখ্যাই যে প্রধানত দায়ী তা উন্নত বিশ্বকে আজ নীতিগতভাবে মেনে নিতেও হবে।
ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষ হলো। ফলাফল অতীতের ধারাবাহিকতায় যা ছিল তাই। বানরের সেই পিঠা ভাগের মতো অবস্থা আর কি, ‘তোমার একটা, আমার দুইটা—আমার দুইটা, তোমার একটা।’ আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কী চমত্কার তথাকথিত সভ্য জগতে আমাদের এই বিশ্ব ব্যবস্থা!
তবুও এতকিছুর পর, বাংলাদেশে আজ আমরা যা চাই তা হলো, মানুষে মানুষে সমতার ভিত্তিতে জলবায়ু সমস্যার ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর প্রভাব বিশ্লেষণ ও নির্ণয়ে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মালিক-শ্রমিক ও শহর-গ্রামের ভেদাভেদ কোনোভাবেই করা যাবে না। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে অতীতের মতো বৈষম্যমূলক আচরণে কখনই প্রকৃত সমাধান মিলবে না। আর ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের অভাবে, আজ হোক কাল হোক, একে একে সবাইকেই ডুবতে হবে। কেউ প্রশান্ত মহাসাগরে, কেউ আটলান্টিক মহাসাগরে, কেউ আরব সাগরে, কেউবা ভারত মহাসাগরে আবার কেউ কেউ বঙ্গোপসাগরে।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার মতো মৌলিক বিষয় নিয়ে যদি রাজনীতি হতে পারে, তাহলে জলবায়ু নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে না, এমনটি ভাবা সঠিক নয়। বিগত দশকের পর দশক ধরে জলবায়ু নিয়ে রাজনীতি অবশ্যই হয়েছে। আর, আজ এ রাজনীতির পঙ্কে গলা পর্যন্ত ডুবে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ এর ফল বেশ ভালোভাবে হাড়ে হাড়েই প্রত্যক্ষ করছি। একবিংশ শতাব্দীতে কে না জানে যে, আত্মঘাতী এ রাজনীতির ফল হলো পৃথিবী জোড়া মানব জাতির নিশ্চিত ধ্বংস। যারা এহেন রাজনীতিতে জড়িত তারা ভেবে করছে নাকি না ভেবেই করছে তা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, এই রাজনীতিবিদরা নিঃসন্দেহে নিজেরাই নিজেদেরও সম্ভাব্য ধ্বংস ডেকে আনছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এহেন নীতি-গতিতে তাদের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও যাবতীয় অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করা।
এক্ষেত্রে, আমরা অধুনা বহুল সমালোচিত বিশ্বের মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট স্বনামধন্য মিঃ জঙ্গলের (গত্. ইঁংয) হুঙ্কারসর্বস্ব ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ (ধিত্ ধমধরহংঃ ঃবত্ত্ড়ত্) বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এহেন ‘সস্তা হুঙ্কারে’ সহজেই আন্দোলিত হয়ে বাংলাদেশসহ প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই এখন অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রতিনিয়ত খাবি খাচ্ছে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে। বাস্তবে এই বিষয়ে আমাদের অবস্থান এখন ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ আর কী। কিন্তু, ওদিকে ওস্তাদ/গুরু নির্দেশিত পথে চলতে গিয়ে এখন বিষয়টির কোনো রকম কূল-কিনারাই করতে পারছি না আমরা বাংলাদেশীরা। অথচ, ওদের ‘ভানুমতির খেল’ ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ বিষয়টি আমাদের তো কোনো কাজেই আসছে না, বরং দিনের পর দিন নানাবিধ নানামুখী সন্ত্রাসের চাপে আমাদের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ইদানীংকালের পাকিস্তান-আফগানিস্তান এবং ইরাক।
যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৮ সালের গ্রীষ্ম মৌসুমের প্রায় চার মাসে ডিক চেনিরা ইরাকের শুধু তেল সম্পদ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এর আগে-পরের ও অন্য খাতগুলোর হিসাবে না হয় নাইই বা গেলাম। এদিকে, একই সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব জনগোষ্ঠীই তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির অব্যাহত নিদারুণ চাপে দিনের পর দিন কীভাবেই না নাকাল হয়েছে। এরপরও ওইসব ওস্তাদ/গুরুদের সুপরিকল্পিত ছক অনুযায়ী দিনের পর দিন তথাকথিত সন্ত্রাসের তো কোনো আশু সমাধানই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। উপরন্তু, একে একে নানাবিধ নতুন নতুন সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে আমাদের এই বিশ্ব। আর উপায়ান্তর না দেখে বিশেষ করে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নীতি-নির্ধারকরা এখন বাধ্য হয়ে এহেন মহা পারঙ্গম ওস্তাদ/গুরুদের অঙ্গুলি হেলনে ওঠ-বসে রত থাকাতেই আপাতত মহা সন্তুষ্ট। বাস্তবে, এতদিনে গঙ্গার পানি এতদূর গড়িয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য অন্য আর কোনো উপায়ও আমাদের নীতি-নির্ধারকরা হাতড়িয়ে পাচ্ছেন না।
স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশের রাজনীতি যখন মূলত ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদকেন্দ্রিক তখন জলবায়ু নামক জ্বলন্ত বিষয়টি এর বাইরে থাকে কী করে? কারণ, ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, মানুষের অন্তর-আত্মার বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে মানুষকে সার্বিকভাবে অথর্ব জড়বস্তুতে পরিণত করে। আসলে ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদের লোভ-লালসা মানুষকে একবার পেয়ে বসলে তা থেকে বেরিয়ে আসা কখনোই সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
একটা মজার গল্প মনে পড়ে গেল। কোনো এক রাজদরবারে রাজার বিশ্বস্ত একজন বরকন্দাজ ছিল। একদিন রাজা জানতে পারলেন যে, ক্ষমতার আশপাশে থাকার সুবাদে বরকন্দাজ মহাশয় অবৈধ অর্থ অর্জনে ব্যস্ত। উপায়ান্তর না দেখে রাজা তাকে রাজবাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ঢেউ গণনার কাজ দিলেন, যাতে করে সে কোনোভাবেই অবৈধ অর্থ সংগ্রহ করতে না পারে। কিছুদিন যেতে না যেতেই রাজা খবর পেলেন, বরকন্দাজ মহাশয় সেখানেও অবৈধ অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে। জানা গেল, নদীতে যারা নৌকা নিয়ে চলে, ঢেউ ভাঙার অপরাধ ও রাজার ভয় দেখিয়ে সে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে মহা সুখে, দেদারছে।
সাধারণ জনগোষ্ঠী যেমন জলবায়ুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, ঠিক তেমনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ সাধারণ মানুষেরও ভাববার বিষয়। জলবায়ুর ভালো-মন্দ প্রভাবে সাধারণ মানুষ কখনও খুশি হয় আবার কখনও রুষ্ট হয়। তা বাংলাদেশের যে কোনো কোণেই হোক না কেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ জনগণের নামকাওয়াস্তে পরিচালিত হয় বলে, এর অস্তিত্ব সাধারণ জনগোষ্ঠীর আয়ত্তের বাইরে। মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিষয় দুটি বুঝি বেওয়ারিশ। যখন যে যেভাবেই হস্তগত করতে পারে তখন এগুলো তার। অহরহ তাই তো দেখা যায় যে, বিশ্বজুড়ে রাজনীতির বলি মানুষের জীবনের মূল্য নির্ধারিত হয় অর্থ-সম্পদ দিয়ে। কী করুণ মানবিক চিত্র, তাই না? সে যাই হোক, এই হলো আজকের বাংলাদেশসহ তথাকথিত উন্নত বিশ্বের বাস্তবতা।
তাই, জলবায়ু সম্মেলনে বহুল আলোচিত ও প্রস্তাবিত আপাত জঘন্য রাজনীতিটি হলো, মানুষের জীবন বিপন্ন করার বিনিময় হবে টাকা। আর সে টাকাও বণ্টন করা হবে সাক্ষী গোপালসম বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও চোরের সাক্ষী গাঁইটকাটা অন্যান্য নামি-দামি বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে। যে টাকা অতীতের মতো নিঃসন্দেহে লাভের গুড় পিঁপড়ায় যেভাবে খায়, ঠিক সেভাবেই খাবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরাসহ বিশ্বের তথাকথিত বাঘা বাঘা নেতৃবৃন্দ মনে করেন, তৃতীয় বিশ্বের নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব বোঝে না। কী অদ্ভুত বুঝ এদের, তাই না?
কিন্তু, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের সার্বিক বুঝ যে কখনই ভোঁতা নয় এবং জাতি হিসেবে বাংলাদেশীরা যে ফকির-মিসকিনের জাতি নয় তার উদাহরণ পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়ে হলেও এখানে আবারও উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি। ঘটনাটি সিডর-পরবর্তী সময়ের। গত ২৮ নভেম্বর ২০০৭, নয়াদিগন্তের শেষ পাতায় ছোট একটি খবর। প্রখর রোদ। অনেক মানুষের ভিড়ে ব্যাগ হাতে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার কলারন গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধা আমেনা বেগম, দুর্দশা-দুর্গত মানুষের জন্য হেলিকপ্টারে ত্রাণ আসবে সেই অপেক্ষায়। অনেক অপেক্ষার পর হেলিকপ্টার দেখা দিল। কিন্তু উপযুক্ত জায়গার অভাবে নামতে পারল না সেখানে। চলে গেল অন্যত্র, সুবিধামত স্থানে নামার জায়গায়। বৃদ্ধা আমেনা বেগমসহ হতাশা সমবেত সবার। চরম হতাশার মধ্যেও বৃদ্ধা বললেন, ‘জীবনে এই পেরথম হেলিকপ্টার দ্যাখলাম’। পাশ থেকে একজন যুবক সাংবাদিক পরিস্থিতি হাল্কা করতে বললেন, ‘চাচী, আইজ তো বুশের তেরান পাওয়া গ্যালো না। এখন কি করবান’। ত্রাণ না পাওয়ার দুঃখ ভুলে বৃদ্ধা আমেনা বেগম তাত্ক্ষণিক বলে উঠলেন, ‘ভালাই হইছে, বাবা। বুশের তেরান মুই খামু না।’ ‘কিন্তু কেন, কী হইছে?’—আশ্চর্যন্বিত হয়ে প্রশ্ন সাংবাদিক বন্ধুর। বৃদ্ধা আমেনা বেগমের দৃঢ় কণ্ঠে আরও সহজ-সরল উত্তর, ‘হুনছি, বুশ ব্যাডায় মানুষটা নাকি ভালা না’।
তবে আশার কথা হলো, এই তো সেদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি কেন জানি একটি বাস্তব প্রস্তাবনায় বললেন যে, উন্নত বিশ্ব কর্তৃক জলবায়ু দূষিতকরণের কারণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ না দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় না কেন? এতে করে সময়ের ব্যবধানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ও উন্নত বিশ্বে জনসংখ্যার ভারসাম্য কিছুটা হলেও ফেরানো যেতে পারে। এখানে ক্রমাগত বিরূপ জলবায়ুর জন্য ভারসাম্যহীন জনসংখ্যাই যে প্রধানত দায়ী তা উন্নত বিশ্বকে আজ নীতিগতভাবে মেনে নিতেও হবে।
ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শেষ হলো। ফলাফল অতীতের ধারাবাহিকতায় যা ছিল তাই। বানরের সেই পিঠা ভাগের মতো অবস্থা আর কি, ‘তোমার একটা, আমার দুইটা—আমার দুইটা, তোমার একটা।’ আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কী চমত্কার তথাকথিত সভ্য জগতে আমাদের এই বিশ্ব ব্যবস্থা!
তবুও এতকিছুর পর, বাংলাদেশে আজ আমরা যা চাই তা হলো, মানুষে মানুষে সমতার ভিত্তিতে জলবায়ু সমস্যার ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর প্রভাব বিশ্লেষণ ও নির্ণয়ে ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মালিক-শ্রমিক ও শহর-গ্রামের ভেদাভেদ কোনোভাবেই করা যাবে না। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে অতীতের মতো বৈষম্যমূলক আচরণে কখনই প্রকৃত সমাধান মিলবে না। আর ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের অভাবে, আজ হোক কাল হোক, একে একে সবাইকেই ডুবতে হবে। কেউ প্রশান্ত মহাসাগরে, কেউ আটলান্টিক মহাসাগরে, কেউ আরব সাগরে, কেউবা ভারত মহাসাগরে আবার কেউ কেউ বঙ্গোপসাগরে।
লেখক : পেনশনার
haquenoor@yahoo.com
No comments